শোভনলাল চক্রবর্তী
১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পুরস্কার লাভ করছেন, তখনই ইউরোপ এবং অনেক দেশেই বেজে যায় বিশ্বযুদ্ধের দামামা৷ রবীন্দ্রনাথ এমন এক ব্যক্তি, যার সঙ্গে আমরা রাজনীতির সংযোগ কল্পনা করতে পারি না৷ কিন্ত্ত বাস্তবটা মোটেও এ-রকম নয়৷ রবীন্দ্রনাথ শুধু যে রাজনীতি সচেতন ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন নতুন এক ধরনের রাজনীতি- সহনশীল রাজনীতির প্রবক্তা৷ ১৯১৭ সালে জাপানে দেওয়া এক বক্তৃতায় যে ভাষায় সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির সমালোচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ, তা যে গীতাঞ্জলি-র স্রষ্টার, তা যেন মেনে নিতেই কষ্ট হয়৷ তাঁর মতে, সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি, “feeds upon their dead flesh and grows fat upon it, so long as the carcasses remain fresh, but they are sure to rot at last, and the dead will take their revenge by spreading pollution far and wide and poisoning the vitality of the reader.”
এই কঠোর সমালোচনার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যবাদের রাজনীতির স্বরূপ তুলে ধরেছেন৷ পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তা নানা ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে গেলেও এই তীব্র সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মানসিকতা মোটেই পাল্টায়নি৷ কিন্ত্ত রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দর্শন বিতর্কিত এই কারণেই যে, সাম্রাজ্যবাদকে তিনি ফেলেছেন জাতীয়তাবাদের সঙ্গে একই সূত্রে৷ জাপানের একাধিক জায়গায় বক্তৃতায় তিনি সাম্রাজ্যবাদ শব্দটি উচ্চারণই করেননি৷ করেছেন জাতীয়তাবাদ কথাটি৷ তাঁর মতে, উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাই বিশ্বযুদ্ধসহ সকল রাজনৈতিক সংঘর্ষের মূল কারণ৷ এটি রবীন্দ্র দর্শনের সীমাবদ্ধতা বলেও অনেকে মনে করেন৷ কেননা রবীন্দ্রনাথ পুঁজির বাড়বাড়ন্ত, শ্রেণি সংঘাত ইত্যাদি মার্কসীয় তত্ত্ব নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন, কিন্ত্ত মূল উৎস হিসেবে জাতীয়তাবাদী আবেগকেই দেখেছেন৷ জাতীয়তাবাদী আবেগ সম্পর্কে তাঁর যে একটি বিভ্রান্ত অবস্থান ছিল সেটি তিনি নিজেও যে অস্বীকার করেছেন তা নয়৷ অনেকের মতে, জাতীয়তাবাদ যে গঠনমূলকও হতে পারে, মানবিকতার পূজারী রবীন্দ্রনাথ তা উপলব্ধি করেননি৷ চারপাশের যুদ্ধ বিগ্রহ, অন্ধ জাতীয়তাবাদের প্রকোপ কবিমনকে বিভ্রান্ত করেছিল৷ যে অন্ধ জাতীয়তাবাদের বিরূপ সমালোচনা করেছেন, তার থেকে উত্তরণের উপায়ও তিনি পরিষ্কার বলে যাননি৷
১৯৩০ সালে স্টালিন সময়কালেই রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া ভ্রমণ করে এতই অভিভূত হয়েছিলেন যে, তিনি এই ভ্রমণকে ‘তীর্থ দর্শনের’ মতো পবিত্র মনে করেছেন৷ সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণকে তিনি “পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান” বলে বিবেচনা করে তার বিভিন্ন দিকের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন৷ তিনি বলেছেন, “যেটা আমার চোখে ভালো লেগেছে, সে হচ্ছে এই ধনগরিমার সম্পূর্ণ তিরোভাব”(রাশিয়ার চিঠি)৷ রবীন্দ্রনাথের চোখ ‘ভিন্ন চোখ’ নয়, বরং মানবিকতার চোখ৷ ‘রাশিয়ার চিঠি’তে সোভিয়েত শাসন ব্যবস্থার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেও বলশেভিক দলের ক্ষমতায় আসার সহিংস বিপ্লব পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর বিরাগ ছিল৷ রবীন্দ্রনাথের রচনায় মার্কসবাদ সম্পর্কে বিশেষ কোনো আলোচনা পাওয়া যায় না৷ কোনো কোনো লেখায় সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সামান্য কিছু বক্তব্য আছে৷ ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটোই৷ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিপীড়ন, শোষণ, হত্যাযজ্ঞ কবিমনকে বিক্ষুব্ধ করেছে, পীড়িত করেছে৷ আবার তিনিই শ্রেণি সীমাবদ্ধতার কারণে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমালোচনাও করেছেন৷ প্রথমে জীবনে রবীন্দ্রনাথও যে ইংরেজদের মধ্যে উদারতা দেখেছেন সে-কথা তিনি নিজেই উল্লেখ করে গেছেন, কিন্ত্ত গান্ধীর অবৈজ্ঞানিকতা, তাঁর আধুনিক সভ্যতা বর্জন, বিদেশি বস্ত্র পোড়ানো, চরকা নিয়ে বাড়াবাড়ি, জন্মনিয়ন্ত্রণের আবশ্যকতার ব্যাপারে উদাসীনতা– এসবের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের কোনো সমর্থন তো নয়ই, আগ্রহও ছিলো না৷ গ্রামকে উন্নত না করলেও যে দেশের উন্নতি নেই– এই সত্য রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও কাজ উভয়ের ভেতরেই গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিলো৷ গান্ধি এবং তাঁর রাজনীতি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দ্বৈত আচরণ ছিল৷ কিন্ত্ত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গান্ধীর সম্পর্ক ছিলো উভয়পক্ষ থেকেই প্রচুর সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের৷ স্বাধীনতার জন্য আত্মশক্তির বিকাশ চাই, একথা রবীন্দ্রনাথ গান্ধীর মতোই জোর দিয়ে বলেছেন৷ মহাত্মা উপাধিটি তো রবীন্দ্রনাথেরই দেওয়া৷ বেশ কয়েকবার গান্ধীর আমন্ত্রণে কংগ্রেসের অধিবেশনেও এসেছেন তিনি৷ কিন্ত্ত গান্ধীর রাজনীতিকে রবীন্দ্রনাথ ব্যঙ্গ করেছেন বহুবার৷
তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিগত মতপাথর্ক্য একটা সময়ে এসে অনেক বড় আকার ধারণ করে৷ বয়কট ও স্বদেশি আন্দোলন, কবির মতে, নেতিবাচক ছাড়া আর কিছু নয়৷ কোনও পণ্য কোনও বিশেষ এলাকায় উৎপন্ন বা সৃষ্ট বলেই তার বর্জন জরুরি, এ-ধরনের রাজনীতিতে রবীন্দ্রনাথ স্বচ্ছন্দবোধ করতেন না৷ ১৯২৫ সালের একটি প্রবন্ধে স্বদেশী আন্দোলনকে ‘চরকা-সংস্কৃতি’ বলে বিদ্রুপ করে রবীন্দ্রনাথ কঠোর ভাষায় তার বিরোধিতা করেন৷ তাঁর এই মনোভাবের তীব্রতম প্রকাশ ‘ঘরে ও বাইরে’ উপন্যাস, যেখানে গান্ধীবাদী আন্দোলনের সমালোচনাই করা হয়েছে৷ অনেক সাহিত্য সমালোচকের মতে, এর চেয়ে বেশি স্পষ্ট এবং খোলামেলা রাজনৈতিক বক্তব্য তিনি অন্য কোনও গল্প, উপন্যাসে দেননি৷ যদিও এই কটাক্ষ গান্ধিবাদীরা খুব ভালোভাবে নেয়নি৷ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি প্রাঙ্গণে বিলেতি পণ্য পুড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন তাঁরা, যদিও তার জন্য রবীন্দ্র চিন্তায় বদল এসেছিল বলে প্রমাণ নেই৷ ফলস্বরূপ, যে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সূচনা কবি নিজে করেছিলেন রাখিবন্ধন প্রচলনের মাধ্যমে, পরবর্তীকালে তিনি নিজেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে যান ও সরে আসেন৷
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু কবিতা রচনা করেছিলেন এবং পথে নেমে সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গেয়েছিলেন একের পর এক দেশাত্মবোধক গান৷ তাঁর গানে অথবা কোনও কোনও কবিতার মধ্যেই স্বদেশিরা খুঁজে পেয়েছিলেন দেশের জন্য আত্মদানের উদ্দীপনা৷ এ আন্দোলনের সময়েও রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া গেছে সাংস্কৃতিকভাবে সোচ্চার হতে৷ ‘গীতবিতান’-এর স্বদেশ পর্যায়ের বেশির ভাগ গানই সেই সময়ে লেখা ওগীত৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ যখন স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তখন ভারত সরকারের মুখ্যসচিব চিঠি দিয়ে তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বক্তৃতা দেওয়া থেকে বিরত থাকার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন৷ অসহযোগ আন্দোলনের একটা পর্যায়ে গান্ধীকে লেখা খোলা চিঠিতে অহিংস আন্দোলন সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ তাঁর লেখনী থেকে উঠে এসেছিল, “আপনার শিক্ষা বিধাতার সাহায্য নিয়ে অহিংসার পথে লড়াইয়ের শিক্ষা৷ কিন্ত্ত, এমন লড়াই শুধু নায়কদের জন্য সম্ভবপর, সাধারণের জন্য নয়৷ সাধারণ মানুষ মুহূর্তের উন্মাদনায় উদ্দীপ্ত হয় বারবার৷ তাই, অন্যায়ভাবে সে উদ্যম প্রতিহত হলে অপমানজনক সন্ত্রাস আর হিংসা সহজেই সেই লড়াইয়ের পথ হয়ে উঠতে পারে৷”
‘সভ্যতার সংকট’ এবং অন্য অনেক লেখাতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর মূল রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন৷ তাঁর দর্শনের মূল কথা হল আন্তর্জাতিকতাবাদ৷ ‘মনুষ্য’ নামক জাতিটি যখন ধরাধামে আবির্ভূত হয়, তখন ছিল না দেশ-মহাদেশের সীমা৷ দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ সবই মানুষের সৃষ্টি এক কাল্পনিক বিভেদ৷ তাই এর উপর ভিত্তি করে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া অথবা বিভেদের বীজ বপন করা অর্থহীন৷ ধর্ম, বর্ণ, জাত, জাতীয়তাবাদের নামে মানুষকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে দেওয়ার বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি ছিল তাঁর, তিনি মনে করতেন কেবলমাত্র আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধ মনুষ্যত্বের উন্নতি ঘটাতে পারে৷ তাঁর সংশয় যে অমূলক ছিল না, তার প্রমাণ দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ৷ তাঁর এই মনোভাবের সর্বোৎকৃষ্ট বহিঃপ্রকাশ গোরা উপন্যাস, যেখানে মূল চরিত্র গোরা নিজে এক গোঁড়া হিন্দু ও চরম ভারতীয় হিসেবে বড়ো হয়, কিন্ত্ত আদতে যে স্কটিশ দম্পতির সন্তান৷ উপন্যাসের শেষলগ্নে এসে সে তার জন্মপরিচয় জানতে পারে এবং বোঝে তার পালিতা মা-ই ভারত মাতার মূর্ত প্রতীক, যিনি নিজে ধর্মপরায়ণ হিন্দু পরিবারের সদস্য হলেও খ্রিষ্টান ইউরোপীয় দম্পতির অনাথ সন্তানের দায়িত্ব নেন নির্দ্বিধায়, মানবিকতার খাতিরে৷ তাই তো গোরা অকপটে স্বীকার করে নিতে পারে, ‘মা, তুমিই ভারতবর্ষ’৷ প্রকৃত জাতীয়তাবাদ যে অন্য সম্প্রদায় বা অন্য দেশের মানুষকে ঘৃণা করতে শেখাতে পারে না, বরং তাদের বুকে টেনে নিতে বলে, এই উপন্যাসটি তার জলজ্যান্ত উদাহরণ৷ রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতপক্ষে একটাই পরিচয়, তিনি মানবতাবাদী৷ তাঁর সাহিত্য থেকে রাজনৈতিক দর্শন, সর্বত্রই এর সগৌরব উপস্থিতি৷ রাজনীতি যে মানুষের জন্যই, ক্ষমতার জন্য নয়– এই উপলব্ধিতে রবীন্দ্রনাথের দেরি হয়নি৷ এমন কোনও রাজনীতির কথা তিনি মাথায় আনতে চাননি, যাতে বিপন্ন হতে পারে মানবিকতা৷ তাই সময় সময় তাঁকে কাল্পনিক (ইউটোপিয়ান) রাজনৈতিক দর্শনের সমর্থক বলে ব্যঙ্গ করা হলেও দুনিয়াজোড়া বর্তমান সময়ের অস্থির উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিপরীতে তাঁর মতাদর্শ এক অনন্য প্রাসঙ্গিকতার পতাকা বহন করতে সমর্থ হয়েছে৷