• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

পেশাদার খুনিরাই বাবাকে খুন করেছে, দাবি নিহত সাংসদ আনোয়ারুল আজিমের মেয়ের

কলকাতা, ২৪ মে:  বাংলাদেশের ঝিনাইদহের সাংসদ ও আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুল আজিম আনারকে খুনের তদন্ত যতই এগোচ্ছে, ততই বেরিয়ে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। যা যে কোনও ক্রাইম থ্রিলারকেও হার মানায়। ঝিনাইদহ-৪ আসনের এই সংসদের খুনের পরিকল্পনা করা হচ্ছিল দুই মাস আগে থেকেই। প্রথমে বাংলাদেশেই খুন করার পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু, নিজের দেশে খুন হলে

কলকাতা, ২৪ মে:  বাংলাদেশের ঝিনাইদহের সাংসদ ও আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ারুল আজিম আনারকে খুনের তদন্ত যতই এগোচ্ছে, ততই বেরিয়ে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। যা যে কোনও ক্রাইম থ্রিলারকেও হার মানায়। ঝিনাইদহ-৪ আসনের এই সংসদের খুনের পরিকল্পনা করা হচ্ছিল দুই মাস আগে থেকেই। প্রথমে বাংলাদেশেই খুন করার পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু, নিজের দেশে খুন হলে সহজেই পুলিশের নাগালে পড়ে যেতে পারে অভিযুক্তরা। সেজন্য পরবর্তীতে পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ভারতেই খুন করার ব্লু প্রিন্ট তৈরি করে সাংসদের বাল্য বন্ধু আক্তারুজ্জামান। আনোয়ারুল আজিমকে কোথায় খুন করা হবে, সেটাও ঠিক হয়ে যায় মাস খানেক আগে। এজন্য নিউটাউনে একটি অভিজাত আবাসনের ফ্লাট ভাড়া নেওয়া হয়। এবং সেখানে আওয়ামী লীগ সাংসদকে আনার জন্য আক্তারুজ্জাম তাঁর বান্ধবী শিলাস্তি রহমানকে হানিট্র্যাপ হিসেবে ব্যবহার করেন। খুনের জন্য আনা হয় এক কসাইকে। খুনের পর ওই ফ্ল্যাটে রীতিমতো উৎসব শুরু করে আততায়ীরা। রাতে রান্না করা হয় মাংস। তবে সেটা আনওয়ারুলের দেহাংশ নয়। বাজার থেকে খাওয়ার মাংস কিনে এনে ফ্ল্যাটে রান্না করে তারা।

জিহাদ হাওলাদার নামে ২৪ বছর বয়সি ওই যুবক মূলত বাংলাদেশের খুলনার বাসিন্দা। সে চোরাই পথে ভারতে প্রবেশ করে। জেরায় সে খুনের কথা স্বীকার করেছে। মৃতদেহ ভাঙড়ের পোলেরহাট এলাকায় একটি খালে ফেলা হয় বলে সে জানিয়েছে। ধৃত কসাইয়ের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে ভাঙড়ের কৃষ্ণমাটির খালে ডুবুরি নামিয়ে দেহাংশের খোঁজে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পুলিশ সৈয়দ আমানুল্লাহ, শিলাস্তি রহমান ও ফয়সাল আলী নামে তিনজনকে আগেই গ্রেফতার করেছে। খুনের কিনারা করতে সিআইডির একটি দল বৃহস্পতিবারই ঢাকা পৌঁছে গিয়েছে। সেখানেই ধৃতদের জেরা করবেন গোয়েন্দারা।

আজিমকে খুনের প্রায় দুই মাস আগে জিহাদকে মুম্বই থেকে কলকাতায় ডেকে আনে অভিযুক্তরা। তাকে জেরা করে জানা গিয়েছে, আখতারুজ্জামানের নির্দেশেই জিহাদ সব কাজ করেছিল। তাদেরকে সুপারি হিসেবে পাঁচ কোটি টাকা ধার্য করা হয়। খুনের আগে অগ্রিম হিসেবে দেওয়া হয় আড়াই কোটি টাকা। মোট ছয়জন এই খুনের সঙ্গে জড়িত বলে তদন্তে এখনও পর্যন্ত জানা গিয়েছে। আখতারুজ্জামানের সুপারিতে জিহাদ ছাড়াও এই খুনের চক্রান্তে যুক্ত ছিল আরও চারজন। তারা সবাই বাংলাদেশী নাগরিক। এই খুনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশে সৈয়দ আমানুল্লাহ, শিলাস্তি রহমান ও ফয়সাল আলী নামে তিনজনকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে। এদের মধ্যে সৈয়দ আমানুল্লাহ সম্পর্কে আখতারুজ্জামানের বেয়াই। তাদের পাতা ফাঁদে পা দেন সাংসদ আনোয়ারুল আজিম আনার। এবং তাদের পাতা ফাঁদে ফেলার জন্য টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয় শিলাস্তি রহমানকে।

জানা গিয়েছে, আক্তারুজ্জামানও বাংলাদেশে যথেষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার দাদা সেখানকার কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র শহিদুল ইসলাম সেলিম। আক্তারুজ্জামান মূলত আমেরিকার নাগরিক হলেও তিনি বাংলাদেশে চোরাকারবারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। এই পথে তিনি বিপুল টাকা রোজগার করে সে। সেজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা শাহিন নিয়মিত বাংলাদেশে আসত। এই অবৈধ ব্যবসার জোরেই বাংলাদেশ ও ভারতে বিপুল সম্পত্তি করেছে সে। তাঁর কোটচাঁদপুরের বাড়িটি এখন রীতিমতো একটি বাগান বাড়িতে পরিণত হয়েছে। এই এলাকায় আক্তারুজ্জামান এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে শাহীনই শেষ কথা। কিন্তু ব্যবসায়িক লেনদেন নিয়ে আজিমের সঙ্গে বিরোধের জেরেই পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে খুন করার পরিকল্পনা করে আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীন।

বাংলাদেশ পুলিশ আরও জানিয়েছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে শাহিন ও আমানুল্লাহর। নিউটাউনের সঞ্জীবনী গার্ডেনের যে ফ্ল্যাটে আজিমকে হত্যা করা হয়েছে, সেটারও মালিক শাহিনই। তবে ফ্ল্যাটটা সে বেনামে কিনেছিল। ওই ফ্ল্যাটটি থেকেই চোরাচালান ও অপরাধ জগতের কর্মকাণ্ড চালাত শাহিন। হত্যার পর শাহিন প্রথমে বাংলাদেশে ছিল। পরে নিখোঁজ সাংসদের খোঁজে দুই দেশজুড়ে প্রশাসনিক তৎপরতা আঁচ করে গত ২০ মে ঢাকা থেকে ফ্লাইট ধরে দিল্লি হয়ে কাঠমান্ডুতে গা ঢাকা দেয় বলে সূত্রের খবর। এবং সেখান থেকে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও তার বেয়াই সৈয়দ আমানুল্লাহ খুনের পর বাংলাদেশেই ফিরে আসে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে তদন্ত শুরু করেছে।

আওয়ামী লীগ সাংসদকে খুনের জন্য নিউটাউনের অভিজাত আবাসন সঞ্জীবা গার্ডেনের বি ইউ ব্লকের ৫৬ নম্বর ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিল আনারের বাল্যবন্ধু এবং বর্তমানে মার্কিন নাগরিক আক্তারুজ্জামান শাহিন। একটি রিপোর্টে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘শিলাস্তি রহমান আদতে আক্তারুজ্জামান শাহিনের বান্ধবী। এই মহিলাকেই ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করেছিল সে। সব পরিকল্পনা করে শাহিন ১০ মে ঢাকায় ফিরে এলেও শিলাস্তি থেকে যায় কলকাতাতেই। ১৩ তারিখেই খুন করা হয় আনারকে। খুনের পর সে ১৫ তারিখে কলকাতা থেকে বিমান ধরে ঢাকায় ফেরে।

এদিকে ১২ তারিখ কলকাতায় আসেন আজিম। তাঁর আসার অন্তত ১০ দিন আগে কলকাতায় আসে দুই অভিযুক্ত। গত ২ মে থেকে ১৩ মে পর্যন্ত কলকাতার সদর স্ট্রিটের একটি হোটেলে ছিল। শহরে এসেই তারা খুনের ছক সাজাতে থাকে। তারা সদর স্ট্রিটের হোটেল ছাড়ে আজিম আসার এক দিন পরেই। গোয়েন্দাদের অনুমান, এই ১০ দিন ধরে শহরে থেকে খুনের পরিকল্পনা সাজাচ্ছিল অভিযুক্তরা।

বাংলদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আখতারুজ্জামানকে প্রথমে অজ্ঞান করে ফেলা হয়। এরপর তাঁকে শ্বাসরোধ করে খুন করে দুষ্কৃতীরা। মৃত্যু নিশ্চিত করতে ভারী বস্তু দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়। এরপর দেহ টুকরো টুকরো করে হাড় ও মাংস আলাদা করে ফেলা হয়। এরপর দেহাংশগুলি একাধিক পলিথিন ব্যাগে ভরে ফেলে ওই ঘাতকরা। সেই মাংসের টুকরো আলাদা আলাদা ট্রলিতে করে ফ্ল্যাটের পাচার করা হয়। সেই খণ্ডিত দেহে যাতে পচন না ধরে, সেজন্য প্রথমে দেহের খণ্ডিত অংশে রাসায়নিক ছড়িয়ে ফ্রিজে রাখা হয়। এরপর হলুদ সহ মাংসের মশলা ব্যবহার করে দেহ বাইরে পাচার করা হয়। যাতে রাস্তায় ধরা পড়লে সেটি খাওয়ার মাংস বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। দেহাংশ পাচারের জন্য অনেক আগেই একটি সাদা গাড়ি বুক করা হয়।

এদিকে এই খুনের ঘটনায় আজ মুখ খুললেন নিহত সাংসদ আনোয়ারুল আজিম আনারের মেয়ে মুমতারিন ফিরদৌস ডরিন। তিনি কর্মসূত্রে মূলত ঢাকায় থাকেন। বৃহস্পতিবার রাতে তিনি ঢাকা থেকে ঝিনাইদহের বাড়িতে ফেরেন। সেখানে তিনি একটি সাংবাদিক বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে তিনি দাবি করেন, তাঁর বাবাকে পেশাদার খুনিরাই খুন করেছে। খুনিদের অতীত ইতিহাস দেখলেই সেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। তাদের বিরুদ্ধে আগেও একাধিক অভিযোগ ছিল। তিনি বলেন, “আমার বাবাকে হত্যার ঘটনায় যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা এর আগে আরও অনেক নিরীহ মানুষকে খুন করেছে। তারা এই অঞ্চলের পেশাদার খুনি। তাদের আগের রেকর্ড দেখলেই সব বেরিয়ে আসবে।”

তিনি বলেন, বাবাকে খুঁজে পেতে সহযোগিতা করেছে প্রশাসন। খুনিদের হত্যার তদন্তে সহযোগিতা করছে হাসিনা সরকার। তিনি দাবি করেন, খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। পাশাপাশি, তাঁর বাবার মৃতদেহ দ্রুত খুঁজে বের করার জন্য সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। যাতে আমার মতো আর কেউ বাবাকে না হারায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাবা হত্যার তদন্ত করছেন। আমি বিশ্বাস করি, তিনি আমার বাবার হত্যার বিচারও করতে পারবেন। এখন আমি আমার বাবার মরদেহ উদ্ধারে প্রশাসনের সহযোগিতা চাই।”