মোদির বিকশিত ভারতে দারিদ্র্য আর বেকারত্বের রোজনামচা

পুলক মিত্র: খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয়৷ হোয়াটসঅ্যাপে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ তাতে বিকশিত ভারত (উন্নত ভারত) গড়ার জন্য পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল৷ এই বার্তা আমাদের মধ্যে এক ভাবনার জন্ম দিয়েছিল৷ তা হল, কীভাবে আমাদের বিকশিত ভারত গড়ে তুলতে হবে৷ সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদের বুঝতে হবে, বর্তমানে ভারত কতটা উন্নত অবস্থায় রয়েছে?

এ নিয়ে আলোচনা করতে হলে, প্রথমে আমাদের অবশ্যই একটি জরুরি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে৷ তা হল: ভারত কী? দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তাঁর ‘দ্য ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’ বইয়ে ‘ভারত মাতা’ কে, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন৷ ইদানিংকালে আমাদের দেশের মানুষের অনেকেই গর্বের সঙ্গে প্রায়ই বলছেন, ‘ভারত মাতা কী জয়’৷ নেহরু আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ভারত শুধুমাত্র একটি ভূমি নয়, এর নদী, এর পর্বতমালা, এর মাটি, যা আমাদের লালনপালন করে চলেছে, সবকিছুই আমাদের অত্যন্ত প্রিয়৷ ভারত হল, লক্ষ লক্ষ মানুষের, যাঁরা আমাদের এই প্রিয় দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছেন৷ এর জয়ের অর্থ হল, এই দেশের মানুষের জয়৷ এর মানুষকে বাদ দিয়ে ভারত কখনই বিকশিত হতে পারে না৷

উন্নয়নের নানা সূচক রয়েছে৷ সেই সূচকগুলির মধ্যে রয়েছে, আয়ের স্তর, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জীবনযাত্রার মান (বিদু্যৎ বা নিরাপদ পানীয় জলের নূ্যনতম পরিষেবা) প্রভৃতি৷ এছাড়া, কর্মসংস্থানের সুযোগ, দারিদ্রসীমা, অসাম্য, প্রযুক্তিগত অবস্থান প্রভৃতিকেও উন্নয়নের সূচক হিসেবে ধরা হয়৷


এখানকার মানুষের উন্নয়নের মূল্যায়ন করতে হলে, মানব উন্নয়ন অবশ্যই মূল মাপকাঠি হওয়া উচিত৷ মানব উন্নয়ন রিপোর্ট (হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট) ২০২৩-২৪ অনুযায়ী, বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হল ১৩৪তম৷ ২০২১-এ এই স্থান ছিল ১৩৫ নম্বরে৷ এখানে উল্লেখযোগ্য হল, ২০১৫ থেকে ২০২২, এই ৭ বছরে ভারতের এইচডিআই অর্থাৎ মানব উন্নয়ন সূচক মাত্র ৪ ধাপ অতিক্রম করেছে৷ এইচডিআই-এ ভারতের স্থান এখনও শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও বাংলাদেশের নীচে রয়েছে৷ এর অর্থ হল, ভারতের বহু আলোচিত আর্থিক অগ্রগতিকে মানব উন্নয়নে রূপান্তরিত করা যায়নি, অথচ এর সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে মানুষের সক্ষমতা ও কল্যাণ৷ এই সূচকগুলি খতিয়ে দেখলে মনে হতেই পারে যে, ভারত অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যাশিত স্তরে পৌঁছতে পারছে না৷ সেক্ষেত্রে আগামী ২৫ বছরে উন্নত ভারত গড়ে তোলা সম্ভব কি?

ভারত এখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম আর্থিক শক্তির দেশ৷ কিন্ত্ত আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের মাথাপিছু গড় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন মাত্র ২৮৫০ মার্কিন ডলার৷ লুক্সেমবার্গ, আয়ারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড এবং নরওয়েতে এই জিডিপি ১ লক্ষ ডলারের বেশি৷ মাথাপিছু জিডিপি-র ক্ষেত্রে বিশ্বে ভারত এখন ১৪৯তম স্থানে রয়েছে৷ মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ভারত এখন বিকশিতের চেয়ে অনেক পিছিয়ে৷

আর্থিক অগ্রগতির হারের ক্ষেত্রে আগের সরকারের তুলনায় অনেক পিছিয়ে গিয়েছে ভারত৷ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজনও বলেছেন, শক্তিশালী আর্থিক অগ্রগতির যে ধুয়ো তোলা হচ্ছে, তা বিশ্বাস করলে বড় ভুল হবে৷ আইএমএফ-এর কার্যনির্বাহী ডিরেক্টর কৃষ্ণমূর্তি সুব্রহ্মনিয়াম ৮ শতাংশ অগ্রগতির যে কথা বলেছেন, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছে আইএমএফ৷ আইএমএফ বলেছে, ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে কৃষ্ণমূর্তি তাঁর বক্তব্য জানিয়েছেন৷ এর সঙ্গে আইএমএফ একমত নয়৷ আইএমএফ-এর কোনও কর্তাই আগামী ৫ বছরের জন্য ভারতের অগ্রগতির হার ৬.৫ শতাংশের বেশি বলেননি৷
পরিবার পিছু ব্যয়ের সমীক্ষা থেকে যে তথ্য সামনে এসেছে, তাতে দারিদ্র্য হ্রাসের (৫% বা তার কম, চরম দারিদ্র্য দূরীকরণের কথা ভুলে যান) দাবিও অতিরঞ্জিত৷ প্রথমত মাথাপিছু ব্যয়ের হার বৃদ্ধি আগের সরকারের তুলনায় কম৷ দ্বিতীয়ত, গ্রামাঞ্চলের উচ্চবিত্ত শ্রেণি এবং শহরের ধনীদের মতামতের ভিত্তিতে এই সমীক্ষা রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে৷

আর্থিক মাপকাঠিতে যেখানে ভারতের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে, তা হল আয়ের ক্ষেত্রে চরম অসাম্য৷ ভারতে আয় ও সম্পদে অসাম্য সংক্রান্ত এক রিপোর্টে (২০২২-২৩) বলা হয়েছে, দেশের জাতীয় আয়ের ২২.৬ শতাংশ গিয়েছে ১ শতাংশ ধনীর পকেটে, যা গত ১০০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ৷ ভারতে আয়ের ক্ষেত্রে আর্থিক অসাম্য বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি৷
একদিকে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ধনীদের দেশ হয়ে উঠেছে৷ অন্যদিকে, দেশের বিপুল অংশের মানুষের কাছে বেঁচে থাকার নূ্যনতম সুযোগসুবিধা পৌঁছয় না৷

বিভিন্ন সমীক্ষা (২০২০-২১) অনুযায়ী, ৬২ শতাংশ ভারতীয় পরিবার প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে এলপিজি ব্যবহার করে থাকে৷ রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলি উজ্জ্বলা যোজনার সাফল্য নিয়ে প্রচারে ব্যস্ত৷ গ্রামাঞ্চলে অর্ধেক পরিবার এখনও জ্বালানি কাঠ, গোবর প্রভৃতিকে জ্বালানি হিসেবে করে৷ গ্রামাঞ্চলে এখনও পুরোপুরি ধোঁয়ামুক্ত জ্বালানি পৌঁছয়নি৷

জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুযায়ী, ৫ বছরের কম বয়সী ৩৫.৫ শতাংশ শিশুর বয়সের তুলনায় উচ্চতা বাড়ছে না, ৫ বছরের কম বয়সী ১৯.৩ শতাংশ শিশুর উচ্চতার তুলনায় ওজন কম, ৫ বছরের নীচে থাকা ৩২.১ শতাংশ শিশুর বয়সের তুলনায় ওজন কম এবং ৬৭.১ শতাংশ শিশু রক্তশূন্যতার শিকার৷

একইভাবে, ১৫-৪৯ বছর বয়সী ৫৭ শতাংশ মহিলা রক্তাল্পতায় ভুগছেন৷ তাই বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১১১ নম্বরে থাকার মধ্যে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই৷ এইসব তথ্য কেউ অস্বীকার করতেই পারেন৷ কিন্ত্ত এই সমীক্ষার নেতিবাচক দিকগুলি খতিয়ে দেখতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক একটি প্যানেল গঠন করতে বাধ্য হয়েছিল৷

‘বিশ্বের দ্রুততম আর্থিক অগ্রগতি’র দেশে এখন তরুণ বেকারের হার (২০-২৪ বছর বয়সী ৪৪%, সিএমআইই অনুযায়ী) বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি৷ ৬ কোটির বেশি মানুষ (২০১৭-১৮ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের মধ্যে) কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন৷

নরেন্দ্র মোদির সরকার ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতকে ‘উন্নয়নশীল’ দেশ থেকে ‘উন্নত’ দেশে পরিণত করার কথা ঘোষণা করেছেন৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই লক্ষ্যকে আকাশ কুসুম কল্পনা মনে হতে পারে এবং সেটাই স্বাভাবিক ভাবনা৷

২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা কিংবা শিল্পোৎপাদনকে মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি-র ২৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া শুধুই কথার কথা রয়ে গিয়েছে৷ এর মধ্যেই আগামী ৫ বছরের মধ্যে ভারতকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতির দেশে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী৷

ভারত যদি ৫ ট্রিলিয়ন ডলার কিংবা পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণতও হয়, তবুও ভারত এই গ্রহের অন্যতম অসাম্যের দেশ হয়ে থাকবে৷

এক্ষেত্রে মনে পড়ছে গান্ধিজির সেই কথা, যা আজও চিরন্তন৷ জাতির জনক বলেছিলেন, ‘দরিদ্রতম এবং দুর্বলতম মানুষের মুখগুলো মনে করার চেষ্টা করুন, যাঁদের আপনি দেখছেন এবং নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি যে এগোনোর কথা ভাবছেন, এটা তাঁর কোনও কাজে আসবে কি না৷ এর থেকে তাঁর কোনও লাভ হবে কি না? এতে তাঁর জীবন এবং ভাগ্যের কোনও পরিবর্তন হবে কি না?’ অন্য কথায় বললে, দেশের কোটি কোটি মানুষের ক্ষুধা ও অনাহার থেকে মুক্তি ঘটবে কিনা?