পুলক মিত্র
৭ দফার ভোট ক্রমশ শেষের পথে৷ রাজনৈতিক দল বা বিভিন্ন জোট এখন ভোট-পরবর্তী দৃশ্যপট কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে হিসেব-নিকেশ শুরু করে দিয়েছে৷ বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতাদের প্রচারের ধারাও ক্রমশ বদলাচ্ছে৷ সাধারণত দেখা যায়, প্রথম দিকে প্রচারে যতটা ঝাঁঝ, উগ্র সুর লক্ষ্য করা যায়, ভোট যত শেষের দিকে এগোতে থাকে, তা ক্রমশ স্তিমিত হতে থাকে৷
তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর টিম এর ব্যতিক্রম৷ ৪ জুনের পরের পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তার পরিবর্তে তাঁরা সেইসব নেতাদের দূরে সরিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, কয়েক মাস আগেও যাঁদের তাঁরা বন্ধু বলে মনে করতেন৷
যেমন ওড়িশা৷ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার মাত্র ১১ দিন আগে ৫ মার্চ ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পটনায়েকের সঙ্গে এক মঞ্চে দেখা গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে এবং সেখানে নবীনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছিলেন তিনি৷ এরপর সংবাদমাধ্যমে এই খবরও ছড়াতে থাকে যে, এবারের ভোটে ভারতীয় জনতা পার্টি এবং বিজু জনতা দল একসঙ্গে নির্বাচনে লড়াই করতে পারে৷ ৫ মার্চ বিজু পটনায়েকের ১০৮তম জন্মবার্ষিকীতে এই জল্পনাও তৈরি হয় যে, নবীনের বাবাকে ভারত রত্নে ভূষিত করা হতে পারে৷
কিন্ত্ত, মাত্র ১৫ দিনের মধ্যেই গোটা পরিস্থিতি বদলে যায়৷ দুই দল আলাদাভাবে নির্বাচনে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেয়৷ এখানেই শেষ নয়৷ ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করতে শুরু করেন মোদি৷ ক্রমশ সেই আক্রমণ অত্যন্ত বেপরোয়া হতে থাকে৷ চড়া সুরে নবীনকে নিশানা করতে থাকেন তিনি৷
একইভাবে, নির্বাচনী প্রচারের সময় প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জগনমোহন রেড্ডিকে আক্রমণ করতে থাকেন৷ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সমালোচনা করা যেতেই পারে৷ কিন্ত্ত সমালোচনার বদলে সেই আক্রমণ যদি ব্যক্তিগত হয়ে ওঠে, তাহলে কী বলা যেতে পারে? কোনওরকম চার্জ গঠন ছাড়াই জগনমোহনকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে আক্রমণ করছেন গেরুয়া শিবিরের নেতারা৷
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, নবীনের বিজু জনতা দল এবং জগন মোহনের ওয়াইএসআর কংগ্রেস বিভিন্ন সময়ে বিজেপির পাশে থেকেছে৷ রাজ্যসভার নির্বাচনে যেখানে বিজেপির সংখ্যার আধিক্য ছিল না, সেখানে সমর্থন দিতে এগিয়ে এসেছিল এই দুই দল৷ তাই এই দুই দল আর ইন্ডিয়া জোটের শরিকদের আক্রমণের সুর কি একরকম হতে পারে?
জগনমোহন কখনও প্রধানমন্ত্রী মোদির বিরুদ্ধে কদর্য শব্দ প্রয়োগ করেননি, যেমনটি করেছিলেন তেলুগু দেশম পার্টির সুপ্রিমো চন্দ্রবাবু নাইডু, ২০১৯-এর নির্বাচনের সময়৷ নাইডু তখন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন৷ এখন মোদি সেই নাইডু এবং জন সেনার পবন কল্যাণের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন৷
যদি কোনও দল সংসদে গরিষ্ঠতা না পায়, অর্থাৎ সংসদ ত্রিশঙ্কু হলে, সেক্ষেত্রে বিজেডি এবং ওয়াইএসআর কংগ্রেসের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে৷ এদের চড়া সুরে আক্রমণ করার অর্থ, নিজের পায়ে কুড়ুল মারা? সেরকম পরিস্থিতি তৈরি হলে, ইন্ডিয়া জোটকে সমর্থন বিজেডি-র পক্ষে অনেক স্বস্তিদায়ক হতে পারে৷ কংগ্রেস অন্তত নবীনের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে না৷ ওড়িশায় বিজেপির উত্থান এখন বিজেডি-র কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
অন্ধ্রপ্রদেশেও কংগ্রেস দুর্বল শক্তি৷ তবে সেখানে পরিস্থিতি কিছুটা আলাদা৷ অন্ধ্রে কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জগনমোহনের বোন শর্মিলা৷ তবুও তেলুগু দেশম পার্টির শরিক হওয়া কোনও দলকে ওয়াইএসআর কংগ্রেস সমর্থন নাও দিতে পারে৷
টিডিপি তেলেঙ্গনায় ২০১৮-র বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ও বাম দলগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল৷
এর পিছনে যুক্তিও ছিল৷ গত ১০ বছরে মোদি সরকার অন্ধ্রপ্রদেশকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দেয়নি, যা কংগ্রেস প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷ যদি দলের আসন সংখ্যা ২৭২-এর নীচে নেমে আসে, তখন বিজেপি কী করবে? বিজেডি এবং ওয়াইএসআর কংগ্রেসের মতো দলগুলি নিরপেক্ষ থাকতে পারে (এমনকি ইন্ডিয়া জোটকে বাইরে থেকে সমর্থন দানে বিরত থাকতে পারে)৷
ভোট পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি অঙ্ক কষা শুরু করে দিয়েছে৷ সে কারণে নীতীশ কুমারকে খুব বেশি আক্রমণের পথে যাচ্ছেন না তেজস্বী যাদব৷ আরজেডি দূরে সরে গেলেও, নীতীশকে আবার ফেরানোর সব পথ খোলা রাখছে জেডিইউ৷
২০১৮-র মে মাসে কর্নাটক এবং ২০১৭-র মার্চ মাসে গোয়ার বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরনোর আগে থেকেই ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’-এ নেমে পড়েছিল কংগ্রেস ও বিজেপি৷ কংগ্রেস তড়িঘড়ি জনতা দল (সেকু্যলার) নেতা এইচ ডি কুমারস্বামীকে সমর্থন দেওয়ার কথা ঘোষণা করে (যদিও মাত্র ৩৬টি আসনে জিতেছিল এই দল)৷ এভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে বদলা নিয়েছিল কংগ্রেস৷ এর আগে, গোয়াতেও একই কৌশল নিয়েছিল বিজেপি৷
যাই হোক, এখন ৪ জুনের দিকেই সবার নজর৷ বিভিন্ন সমীক্ষার ফল বিজেপিকে চাপে ফেলে দিয়েছে৷ দক্ষিণ ভারতে বিজেপির ফল শোচনীয় হতে পারে৷ এমন ইঙ্গিত মিলেছে৷ বিজেপির সবচেয়ে বড় ভরসা হল উত্তরপ্রদেশ৷ ওই রাজ্যেও খুব একটা স্বস্তিতে নেই মোদির দল৷ বিরোধীরা সেখানে অন্তত ৩০টি আসন পেতে পারে৷ তাই ভোটযুদ্ধের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর শরীরীভাষায় যে আত্মবিশ্বাস লক্ষ্য করা গিয়েছিল, তা এখন অনেকটাই কমতে শুরু করেছে৷ তাই আঞ্চলিক দলগুলির সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে৷