বাংলাদেশে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে, অন্তবর্তী সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা চলছে

বাসুদেব ধর, ঢাকা, ৬ আগস্ট: অবশেষে বিকেল তিনটার দিকে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। মঙ্গলবার বিকেল তিনটার দিকে এই ঘোষণা দেন তিনি। রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে এ নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। আন্দোলনকারী ছাত্রনেতারা আজ তিনটার মধ্যে সংসদ ভেঙে দেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন।

ছাত্র-জনতার গণবিস্ফোরণের মুখে সোমবার (০৫ আগস্ট) পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে গেছেন শেখ হাসিনা। এমন পরিস্থিতিতে তিন বাহিনী প্রধান এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সেখানে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংসদ বিলুপ্তির কথা বলেছিলেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। আন্দোলনকারীদের প্রত্যাশা ছিল রাতের মধ্যেই সংসদ বিলুপ্তির ঘোষণা আসবে। কিন্তু মঙ্গলবার দিন পেরিয়ে দুপুর হলেও এই ঘোষণা আসেনি। তখন সংসদ বিলুপ্তি ঘোষণা করতে বিকেল ৩টার মধ্যে সময়সীমা বেঁধে দেয় বৈষম্যবিরােধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে ছাত্র-জনতাকে শান্তিপূর্ণ অবস্থানের আহ্বান জানায় তারা।

এছাড়া বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে সংসদ বিলুপ্ত না করলে বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের হুমকি দেয় আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয় সারজিস আলম। সংসদ বিলুপ্তির ঘোষণা আসায় শেষ পর্যন্ত অপ্রীতিকর পরিস্থিতি আর হয়নি। গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছিল। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়নি।


এদিকে একইসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে আশা প্রকাশ করেছেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও শিগগিরই দেশে ফিরে আসবেন।

অন্তবর্তী সরকার এখনো গঠিত হয়নি, আজ সন্ধ্যায় এ নিয়ে বৈঠক চলছে বঙ্গভবনে। এ বৈঠকে ছাত্র নেতারা ছাড়াও উপস্থিত রয়েছেন সেনা প্রধান জেনারেল । ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, আগামিকাল অন্তবর্তী সরকার শপথ নিতে পারে। অন্তবর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেল শান্তি বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেছেন ছাত্র নেতারা। তারা বলেছেন, এ ব্যাপারে তারা ড. ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেছেন, তিনি সম্মতিও জ্ঞাপন করেছেন। এ ছাড়া সরকারের সদস্য হিসেবে আরও কয়েকজনের নাম দেওয়া হয়েছে।

এদিকে সারাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক হামলা চলছে বলে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ জানিয়েছে। বলা হয়েছে, গত দুদিনে অন্তত ৩০টি জেলায় হিন্দুদের বাড়িঘর, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ও মন্দিরে নির্বিচারে হামলা চালানো হয়েছে। লুটপাটের পর অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। মহিলাদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। অন্তত চারজন নিহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মিশনগুলোর রাষ্ট্রদূতেরা সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর উপাসনালয় ও লোকজনের ওপর হামলার খবরে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন। তাঁরা চলমান ছাত্র আন্দোলনে যুক্তদের পাশাপাশি অন্যরা সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
ক্ষুব্ধ আওয়ামি লিগ নেতারা

জনরোষের মুখে শুধু বোনকে নিয়ে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার ঘটনা মানতে পারছেন না আওয়ামি লিগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও মন্ত্রীরা। তাঁরা বলছেন, তিনি দেশ ছেড়ে যদি যাবেনই, তাহলে শেষ মুহূর্তে দলের নেতা-কর্মীদের কেন আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি দাঁড় করালেন ?

শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ আগে থেকেই ভারতে অবস্থান করছেন। ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় দেশের বাইরে থাকেন। শেখ রেহানার ছেলে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিও আগেই বাংলাদেশ ছেড়েছেন।

প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দিয়ে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাঁর মন্ত্রিসভার ছয়জন সদস্য এবং আওয়ামি লিগের কেন্দ্রীয় কমিটির পাঁচ নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, শেখ হাসিনা সোমবারই (০৫ আগস্ট) দেশ ছাড়বেন, এটা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি। এ ছাড়া তিনি পদত্যাগ করতে পারেন, এমন কোনো ইঙ্গিতও দেননি।

শেখ হাসিনা দেশ ছাড়বেন, গতকাল দুপুরের দিকে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এমন খবর শোনার পর মন্ত্রিসভার সদস্য এবং দলের নেতা-কর্মীরা অনেকটা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। এরপর মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য ও নেতা-কর্মী নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে থাকেন। অবশ্য পরিস্থিতির কারণে দু-একজন রোববার রাতে ও গতকাল সকালে দেশ ছেড়েছেন। কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের দেশের বাইরে পাঠিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রহমানসহ বেশির ভাগ মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতা দেশেই ছিলেন। গতকাল সন্ধ্যার পরও কারও কারও মুঠোফোন খোলা ছিল। তবে বিকেলের দিকে ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবিরসহ অনেকের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। কেউ কেউ ধারণা করছেন, তারা হয় নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন, নতুবা বিদেশে যাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন।

জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সংসদ এলাকাতেই গতকাল দুপুর পর্যন্ত ছিলেন বলে সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে। তবে এরপর তিনি কোথায় গেছেন, তা কেউ বলতে পারছেন না। বিকেলের পর থেকে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

মন্ত্রিসভার সদস্য ও কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, জনরোষের মুখে সবাইকে রেখে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার ঘটনায় তাঁরা হতাশ, বিপর্যস্ত ও ভেঙে পড়েছেন। তাঁরা মনে করছেন, শেখ হাসিনার একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত এবং জেদের কারণে দল ও নেতা-কর্মীরা বিপদে পড়েছেন। তিনি নিজের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও অন্যদের রেখে গেছেন বিপদে।