– প্রবীর মজুমদার
‘জোট ধর্ম’— ভারতের রাজনীতিতে এই কথাটি বিজেপি-র প্রয়াত নেতা ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর। কিন্তু নরেন্দ্র মোদিকে কখনও জোটসঙ্গীদের উপর ভরসা করতে হয়নি। ফলে কাউকে সন্তুষ্ট করারও দরকার পড়েনি। রবিবার নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে ফিরে এল জোট সরকার। এবার অটল বিহারী বাজপেয়ীর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী নরেন্দ্র মোদিকে প্রথমবারের মতো সরকার চালাতে জোট ধর্ম পালন করতে হবে। দেশের নির্বাচনী ইতিহাসের প্রায় ৩২ বছর কেটেছে জোট সরকারের শাসনে। বাকি ৩১ বছর কেন্দ্রীয় সরকার এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ কোনও না কোনও দলের হাতে ছিল।
গত দশবছর কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী মোদীর নেতৃত্বে এনডিএ সরকার ক্ষমতায় থাকলেও, তাঁর দল বিজেপি কিন্তু লোকসভায় এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। এবারের হিসাবটা আলাদা। অন্ধ্রপ্রদেশের তেলুগু দেশম (টিডিপি) ১৬ আর বিহারের জনতা দল ইউনাইটেডের (জেডিইউ) ১২ আসন ছাড়া, শিবসেনা আর এনসিপির একাংশ, আপনা দল ইত্যাদি না থাকলে বিজেপি এবার ২৪০ আসনে জিতেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার থেকে ৩২ আসনে পিছিয়ে ছিল। মোদী প্রায় ১২ বছর সাত মাস গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তারপর দশ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কখনওই জোটসঙ্গীদের চাপের কথা ভাবতে হয়নি। তাই প্রশ্ন উঠছে, জোটের দলগুলোর আলাদা আলাদা চাহিদার সঙ্গে কি তিনি টানা পাঁচ বছর মানিয়ে নিতে পারবেন?
যদিও রাজনীতি বা কূটনীতিতে তিনি যে কতটা সক্ষম তা আর নতুন করে বলে দেওয়ার দরকার নেই। মোদী মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণে যা দেখা গেল, তাতে আপাতত পদ বন্টনে হয়ত কোনও সমস্যা হয়নি, কিন্তু সরকারের নীতি ও কর্মপন্থা নিয়ে ভবিষ্যতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিহার ও অন্ধ্রপ্রদেশে এই দুই রাজ্যই কিন্তু বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত রাজ্যের মর্যাদার দাবিদার। কিন্তু জোটভুক্ত দলের জন্য এহেন বিশেষ ব্যবস্থা করতে গেলে অন্যান্য রাজ্যগুলো কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? কাজেই অপেক্ষা। কী হয়, কী হয়? তাছাড়া বিহার ও অন্ধ্রপ্রদেশের সরকার জাতিভিত্তিক আদমশুমারি শুরু করেছে। যাতে বিজেপি-র সোজাসুজি সম্মতি নেই। অন্ধ্রে অবশ্য জগন্মোহন রেড্ডির পূর্বতন সরকার এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল।
চন্দ্রবাবু বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করলেও এখনও মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেননি। তাই দেখা দরকার, তিনি এব্যাপারে কোন পথে হাঁটেন। এর বাইরেও ‘শরিকি ঝামেলায়’ পড়তে হতে পারে মোদীর মিলিজুলি সরকারকে। তার মধ্যে থাকতে পারে জাত-ভিত্তিক জনগণনা। ইউনিফর্ম সিভিল কোড বিরোধিতা ও ওয়ান নেশন, ওয়ান ভোট। তা ছাড়া, শরিকদের প্রভাব থাকা বিভিন্ন রাজ্যকে স্পেশাল স্টেটাস প্রদানের দাবিও উঠবে৷ এই মর্মেও ইতিমধ্যেই নিজেদের মনোবাসনা প্রকাশ করেছেন নীতীশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নাইডু৷ এই দাবি মানলে যে অন্য গেরুয়া-রাজ্যও তেমন দাবি করবে বা না দিলে ক্ষোভ বাড়বে, তা নিয়ে বিশেষ সন্দেহ নেই — তা ভালোই জানেন বিজেপি নেতৃত্ব।
ফলে, সমস্যা এখানেও। প্রধান চারটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক — স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, অর্থ ও বিদেশ বিজেপি-র নিজের হাতে রেখেছে। নীতীশের দলকে রেল মন্ত্রক দেওয়া হয়নি। রাজি নয় টিডিপি-র দাবি অনুযায়ী, তাদের লোকসভার স্পিকার পোস্ট দিতেও। একই কথা প্রযোজ্য সড়ক পরিবহণ ও হাইওয়েজ়
মন্ত্রকের ক্ষেত্রেও। এমনকী বিজেপি এমন কোনও মন্ত্রক হাতছাড়া করতে চায় না, যার সঙ্গে ভোটের যোগাযোগ রয়েছে, দাবি সূত্রের। যেমন দরিদ্র, নারী, কৃষক ও যুব সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনও মন্ত্রক।
এখানেই শেষ নয়। বারবার জোটসঙ্গী বদলানোর পর বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারকে অনেকেই ‘পাল্টুরাম’ বলে সম্বোধন করে থাকেন। ফলে ইতিমধ্যেই গুঞ্জনছেয়ে গেছে তিনি কী করতে চলেছেন ? ওদিকে ২০১৮ সালে টিডিপির এনডিএ ত্যাগ করার কারণই ছিল অন্ধ্রপ্রদেশকে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত রাজ্যের মর্যাদা না দেওয়া। টিডিপি মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পর্যন্ত এনেছিল। সেইসময় অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু কেন্দ্রের সমালোচনা করে বলেছিলেন যে তাঁরা দলের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না, নিচ্ছেন রাজ্যের স্বার্থে।
যদিও মোদী জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতায় জড়িয়ে পড়া বিজেপির প্রথম প্রধানমন্ত্রী নন। তাঁর পূর্বসূরি অটলবিহারি বাজপেয়ী এই বিষয় সামলাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। অটল বিহারী বাজপেয়ী ১৯৯৬ সালে প্রথম ১৬ দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। বিজেপির আসন সেবার ছিল মাত্র ১৬১টি। ফলে সরকার গড়তে জোটের শরিকদের সমর্থন প্রয়োজন ছিল। ১৯৯৮ সালের মার্চে শিরোমণি অকালি দল (এসএডি), সমতা পার্টি, এআইএডিএমকে এবং বিজেডিসহ বিভিন্ন দলের সমর্থনে বাজপেয়ী আবার প্রধানমন্ত্রী হন। সেই বাজপেয়ী সরকার এক বছর সাত মাস টিকে ছিল।
১৯৯৯ সালে বিজেপি ১৮২টি আসন পায়, অটল বিহারী বাজপেয়ী কেন্দ্রের ক্ষমতায় ফেরেন। জোট সরকার গড়ে প্রধানমন্ত্রী হয়ে এক প্রকার কাটার মুকুট পরে সরকার চালাতে হয়েছিল তাকে। বাজপেয়ী তার দক্ষতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যক্তিত্বের কারণে টালমাটাল জোট নিয়েও পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করেন। এর মাধ্যমে তিনি ভারতে প্রথমবারের মতো অ-কংগ্রেসীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছর পূর্ণ করার রেকর্ড গড়েন। বাজপেয়ীকে সরকার টিকিয়ে রাখতে বেশ কয়েকজন আদর্শবিরোধী বা আদর্শহীন রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়েছিল। তিনি যাকে বলতেন ‘জোট ধর্ম’, তা পালন করতে সোজা চলে গিয়েছিলেন ক্ষুব্ধ মমতা ব্যানার্জির বাড়িতে।
তৎকালীন এনডিএ জোটের সদস্যা মমতা বাংলার কিছু ‘রুগ্ন’ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বন্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। কালীঘাটের বাড়িতে বাজপেয়ী মমতার মায়ের সঙ্গে বসে গল্প করেন অনেকক্ষণ। আলোচনা হয় তাঁর মেয়ের গুণ নিয়েও। পাশাপাশি বাজপেয়ী মমতার রগচটা, হঠকারী স্বভাব নিয়ে অভিযোগও করেন। মা নাকি হালকা হাসির মধ্যেই স্বীকার করেন সেসব দোষ। রণং দেহি মমতা ততক্ষণে বিগলিত। বিচক্ষণ নেতা তাঁর রাজধর্ম
পালন করে ফিরে এলেন দিল্লি, মমতা রইলেন এনডিএতেই।
যদিও বছরখানেক পরে বেরিয়ে এসে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠন করার দিকে নজর দেন। সফল হতে অবশ্য আরও প্রায় এক
দশক লেগেছিল। বিরোধী ইন্ডিয়া ব্লক এবার বেশ শক্তিশালী। এর মধ্যে বিজেপির নেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ফলে সরকার টিকিয়ে রেখে ইন্ডিয়া ব্লককে মোকাবিলা করতে বেগ পেতে হবে বিজেপিকে। ইন্ডিয়া ব্লকের চেয়ে অবশ্য দলের সংখ্যায় এনডিএ জোট বড়। এই দুই ডজনের বেশি দলকে সন্তুষ্ট
রেখেই ১৮ দলের জোট ইন্ডিয়া ব্লককে সামলাতে হবে বিজেপিকে।
পরিস্থিতি তেমন হলে সরকার উল্টে দিতেও পিছপা হবে না ইন্ডিয়া জোট। ইন্ডিয়া জোটের নজর আপাতত থাকবে বিজেপির জোটসঙ্গীদের উপরে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে জনতা দল ইউনাইটেড এবং তেলেগু দেশম পার্টির উপর। কারণ (দুটি দল মিলিয়ে) ২৮টি আসন ঝুলিতে রাখা এন চন্দ্রবাবু নাইডু এবং নীতিশ কুমারের সমর্থন ছাড়া সরকার গড়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে।
জোটের রাজনীতির অঙ্ক খুব সহজ। যে দল সমর্থন করছে, সেই সমর্থনের বদলে তারা কিছু সুযোগ সুবিধা পেতে চায়। এখন সেই দাবিদাওয়া না মিটলে তারা অন্যদের দিকে তাকাবে। চন্দ্রবাবু নাইডু এবং নীতিশ কুমারের কাছ থেকে কংগ্রেস প্রত্যাশা করতেই পারে। এর কারণ খুব সহজ। এরা দুজনেই নিজেদের স্বার্থ ভাল বোঝেন এবং তার উপর ভিত্তি করে অতীতে বারবার তাদের জোট বদল করতেও দেখা গিয়েছে। স্বার্থ পূরণ না হলে তারা বেরিয়ে আসতে দ্বিধা করবেন না।
এনডিএ জোটের বড় খেলোয়াড় চন্দ্রবাবু নাইডু এবং নীতীশ কুমার উভয়ই যথাক্রমে ১৬ ও ১২টি আসন পেয়েছেন। তারা এখন কেন্দ্রে সরকার গঠন এবং চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিজেপির জন্য অত্যাবশ্যক মিত্র হয়ে উঠেছেন। তারপরে রয়েছেন চিরাগ পাসোয়ানের মতো অন্যান্য সহযোগীরা-যারা চার-পাঁচটি আসন নিয়ে এনডিএ জোটের সংখ্যা আসন সংখ্যা ২৯৫তে পৌঁছে দিয়েছেন। এই জোটের অংশীদারদের খোশমেজাজে রাখতে হবে বিজেপিকে, আর এতে বাজপেয়ীর মতো স্পর্শ প্রয়োজন হবে বিজেপির।
ইতিহাস বলে যে জোট ধৰ্ম মেনে, শরিকদের সামান্য খুশি করেও চালানো যায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাহীন সরকার। কিন্তু সকলের হাত ধরে পথ চলা কঠিন। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে এই ‘যত মত, তত পথ’ অবলম্বনকারী নেতাদের নিয়ে সরকার পরিচালনা করতে কি পারবেন মোদী-অমিত শাহের মত নেতৃত্ব, যাঁরা এতদিন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে রাজত্ব চালালেন? ভবিষ্যৎ জবাব দেবে। রাজনীতির মাঠে গোলমুখ সামান্য খুলে যাওয়ার অপেক্ষায় ওত পেতে রয়েছে ইন্ডিয়া জোট ।