সব্যসাচী চ্যাটার্জি: সামনেই লোকসভা নির্বাচন৷ বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের জনপ্রতিনিধি হওয়ার লড়াই৷ এই লড়াইয়ে সামিল আমরা সকলেই৷ কেউ জড়িত প্রত্যক্ষভাবে, কেউ বা পরোক্ষভাবে৷ কিন্ত্ত তা নিয়ে অবশ্য কিছু মানুষের কোন মাথা ব্যাথা নেই, বলা ভালো সময় নেই৷ তাঁরা এ শহরের ‘মুটিয়া’ সম্প্রদায়৷ সভ্য সমাজের ব্যবহূত সরঞ্জাম বহনের দায় যাদের৷ প্রতিদিন হাজারো জিনিসের ভার তাঁদেরই কাঁধে৷ কারোর মাথায় ৫০ কেজি, কেউ আবার প্রখর রোদে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন মালবাহী ভ্যান৷ বেতন বলতে নির্দিষ্ট কিছু নেই৷ নেই কোনও সংগঠনও৷ কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে বাড়ি যাওয়া হয় না সেই ভাবে৷ কারণ কাজ না করলে পয়সা দেবে কে! তবুও ওঁদের মুখের হাসি অমলিন৷ কিন্ত্ত তাঁরা সকলেই বঞ্চিত৷ বঞ্চিত সকল ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে৷ শহরের প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলা হোক কিংবা বড় বাজার, হামেশাই চোখে পড়বে এই মুটিয়াদের উপস্থিতি৷ শহরের ব্যস্ততার মাঝে নিজেদের কাজ করে যান রফিকুল চাচা, আনসারি ভাইদের মতো ‘মুটিয়া’রা৷
সরকারি রেশন থেকে সরকারি ভাতা কিংবা সরকারের প্রতিশ্রুতি মতো পাকা বাড়ি, রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারের কোনও সুযোগ-সুবিধা পান না তাঁরা৷ তবুও সমাজের জন্য হাড় ভাঙা পরিশ্রম করেন দুটো টাকার আশায়৷ এদের মধ্যে অনেকেই ভিন রাজ্যের আবার কেউ আসেন হাওড়া, সোনারপুর, ডায়মন্ড হারবার থেকে৷ তাঁদেরই একজন ভূবনেশ্বর মাহাতো৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমরা কোন সরকারি সুবিধা পায় না৷ তবে শরীর অসুস্থ হলে সরাকরি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসাটুকু মেলে’’৷ ছোট্ট এক কামরার ঘরে এক সঙ্গে ২০ জন থাকেন তাঁরা৷ সেখানেই মেলে দু-মুঠো খাওয়ার৷ তবে সারাদিনের পরিশ্রমের পর রাতের বিছানা বলতে রাস্তার ফুটপাত৷ তবুও থাকে প্রাণের ভয়৷ কারণ পুলিশের নজর এড়িয়ে মদ্যপ চালকের সংখ্যা কলকাতা শহরে নেহাতই কম নয়৷ সেই ফুটপাতের ধারেই কাটে তাঁদের জীবনের শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা৷ অনেকে আবার সপরিবারে বাস করেন ফুটপাতেই৷ তবে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নেতা-মন্ত্রী কারোর সময় নেই তাঁদের কথা শোনার মতো৷
এ দেশে ভোট আসে, ভোট যায়৷ ভোটের আগে মেলে প্রতিশ্রুতিও৷ তবে ভোট শেষে সকলেই ভোকাট্টা৷ সরকারি সুযোগ-সুবিধা তো দূরস্ত, বিপদে-আপদেও পাশে পাওয়া যায় না কাউকে৷ ৩৪ বছরের বাম রাজত্বের পতন থেকে শুরু করে মোদি সরকারের উত্থান, রাজনৈতিক পালা বদলের সাক্ষী থেকেছেন এই ‘মুটিয়া’রা৷ অন্যদিকে কেন্দ্র সরকার সম্প্রতি নতুন নাগরিকত্ব আইন লাগু করেছে দেশজুড়ে৷ যেই আইনে ভারতের প্রতিবেশী দেশ থেকে ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে এ দেশে আসা মানুষদের স্থান দেওয়া হবে৷ যদিও সেই আইনে উল্লেখ নেই মুসলিমদের কথা৷ তবে খাতায় কলমে ‘মুটিয়া’রা এ দেশের নাগরিক হলেও দিন কাটে বহিরাগতদের মতো৷ না আছে স্থায়ী ঠিকানা, না আছে সম্মান৷ তাঁদের এই পরিযায়ী জীবনের সঙ্গী বলতে একমাত্র মালবহনের ‘ভার’৷