নিজস্ব প্রতিনিধি— তৃণমূল সুপ্রিমো তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর রাজ্যের শাসক দলে সবচেয়ে প্রভাবশালী হলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তিনি রাজ্য রাজনীতির অন্যতম ভরকেন্দ্র৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর তাঁকে ঘিরেই রাজ্যের শাসক দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যথেষ্ট উন্মাদনা রয়েছে৷ সেই তিনি এবার ভোটযুদ্ধের অন্যতম সেনাপতি৷ সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে ভালোবাসেন৷ দলীয় প্রার্থীদের হয়ে গোটা রাজ্যজুড়ে তিনি প্রচার করছেন৷ কখনও উত্তরে, তো কখনও দক্ষিণে৷ প্রতিটি সভা-সমাবেশে উপচে পড়ছে ভিড়৷ এক বেসরকারি সংবাদ চ্যানেলের মুখোমুখি হয়ে লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে তৃণমূল কংগ্রেসের রণকৌশল কেমন হবে, তার কিছুটা হদিশ দিলেন৷ প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিলেন স্ট্রেট ব্যাটে৷ সাফ জানিয়ে দিলেন, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের আসন গতবারের তুলনায় এবার অনেকটাই বাড়বে৷ কারণ, বিরোধীরা যতই কুৎসা করুক না কেন, বাংলা এখনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসকেই চায়৷
ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্র থেকে এবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে সম্প্রতি বিজেপিতে যোগদান করেছেন বিচারক অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়৷ ডায়মন্ড হারবার প্রসঙ্গে অভিজিৎ বলেছিলেন, অভিষেকের ঘনিষ্ঠ দু’জনকে গ্রেফতার করলেই তৃণমূলের এই সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হেরে যাবেন৷ এদিন অভিষেক তার জবাবে বলেন, ডায়মন্ড হারবারের ভোট জুনের ১ তারিখ৷ ওইদিন পর্যন্ত তাঁকে যদি গৃহবন্দি করেও রাখা হয়, তিনি যদি একবারও ডায়মন্ড হারবারে পা নাও দেন, তারপরেও ফল তৃণমূলের অনুকূলে আসবে৷ সেই সঙ্গে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার জন্য খোলা চ্যালেঞ্জ জানান অভিষেক৷ মানুষই বিচার করবেন, ডায়মন্ড হারবার থেকে কে সংসদে যাবেন৷ স্বাভাবিকভাবে তাঁর জয়ের ব্যাপারে অভিষেক যথেষ্ট প্রত্যয়ী৷
লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই রাজ্যে ইডি এবং সিবিআই তৎপরতা বাড়ছে৷ এই প্রসঙ্গে অভিষেক বলেন, এবারই নতুন নয়৷ ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপি সিবিআই, ইডি এবং সংবাদমাধ্যমের একাংশকে সামনে রেখে তৃণমূলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করেছিল৷ কিন্ত্ত তৃণমূলের ভাবমূর্তি নষ্ট করা সম্ভব হয়নি৷ যদিও বিজেপি চেয়েছিল, ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের মনোবল ভাঙতে৷ কিন্ত্ত সে কাজে বিজেপি কোনওভাবেই সফল হয়নি৷ কারণ মানুষ তার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বুঝেছে, বিজেপি কী ধরনের রাজনীতি করছে দেশজুড়ে৷ ফলে, সিবিআই-ইডি যতই তৃণমূল নেতাদের ডাকবে, ততই মনোবল বাড়বে৷ অনেকে সিবিআই ও ইডির ভয়ে বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন৷ কিন্ত্ত তাঁর পক্ষে মাথা নীচু করা সম্ভব হবে না বলে, অভিষেক দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়ে দেন৷ বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্কের রসায়ন প্রসঙ্গে, মুখ খুলেছেন অভিষেক৷ এ প্রসঙ্গে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘বিজেপির সঙ্গে সেটিং থাকলে আমাকে নিশ্চয় এতবার ডাকত না৷ শুধু আমাকেই নয়, আমার স্ত্রী, বাবা-মা কাউকেই ছাড়েনি৷ নেহাতই আমার বাচ্চা দুটো ছোট৷ তা না হলে ওদেরকেও ডাকত৷
খোলামেলা একান্ত সাক্ষাৎকারে সন্দেশখালি প্রসঙ্গে অভিষেক তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন৷ এ প্রসঙ্গে অভিষেক বলেন, সন্দেশখালি নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে৷ মনে রাখতে হবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ শেখ শাহজাহানকে গ্রেফতার করেছে৷ যদিও এফআইআর করেছিল ইডি৷ হাইকোর্ট যদি লক্ষ্মণরেখা টেনে দেয়, তাহলে পুলিশ কী করবে? এখনও পর্যন্ত শিবপ্রসাদ হাজরা ও উত্তম সর্দারকে সিবিআই তাদের হেফাজতে নেয়নি কেন? এদেরকেও পুলিশ গ্রেফতার করেছে৷ আমি বলার পর হয়তো, সিবিআই তাদের হেফাজতে নেবে৷ তৃণমূল কাউকে রেয়াত করেনি৷ পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক সবার বিরুদ্ধেই দল ব্যবস্থা নিয়েছে৷ কিন্ত্ত বিজেপি কিছুই করেনি৷ কুলদীপ সিং সেঙ্গার, ব্রিজভূষণ, বিএস ইয়েদুরাপ্পা তাদের ক্ষেত্রে অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিজেপি কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি৷ এদিকে মুখে বড় বড় কথা বলছে৷ মহারাষ্ট্রে বিজেপি সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী বড়সড় দুর্নীতিতে যুক্ত৷ তাঁর বিরুদ্ধেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বিজেপি৷
সিএএ-এনআরসি রাজনৈতিক গিমিক ছাড়া কিছু নয়, এমনটাই মনে করেন অভিষেক৷ পাঁচ বছর লাগল রুল ফ্রেম করতে৷ খালি ফর্ম ফিলাপ করতে ছাড়া আর কিছুই বলার নেই৷ তৃণমূল কংগ্রেস মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ৷ সে কারণে তৃণমূল কংগ্রেস মনে করে, সবাই ভারতের নাগরিক৷ নতুন করে আবার নাগরিকত্ব কীভাবে প্রমাণ করতে হবে? কারণ এই সব মানুষদের ভোটেই তো কেউ প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, কেউ মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, কেউ বা সাংসদ-বিধায়ক হয়েছেন৷ এই এনআরসি গিমিকের ফলে টালিগঞ্জের এক যুবক আত্মহত্যা করল৷ এর দায় কি বিজেপি নেবে?
বাংলার প্রতি কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে সরব হয়ে অভিষেক বলেন, উত্তরপ্রদেশে ৫২ লক্ষ ভুয়ো কার্ড পাওয়া গিয়েছিল৷ উত্তরপ্রদেশের টাকা তো কেন্দ্র বন্ধ করেনি৷ মধ্যপ্রদেশে তো আবারও দুর্নীতি হয়েছে৷ সেখানে চার চাকার গাড়ি রয়েছে, এমন লোকও বাড়ি পেয়েছে, সেখানেও তো কেন্দ্র টাকা বন্ধ করেনি৷ আসলে রাজনৈতিকভাবে বিজেপি বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে বাংলাকে ভাতে মারার চেষ্টা করছে৷ বিজেপির এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ রুখে দাঁড়াবে এবং ভোটবাক্সে এর প্রতিশোধ নেবে৷
প্রথম থেকেই তৃণমূল কংগ্রেস ইলেক্টোরাল বন্ডের বিরোধিতা করে আসছে৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্টেট স্পনসর ইলেকশন ফান্ডের কথা বলেছিলেন৷ কিন্ত্ত তা কার্যকর করা হয়নি৷ কংগ্রেসের সঙ্গে জোট প্রসঙ্গে অভিষেক জানান, কংগ্রেসের বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করে উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল৷ জোটের কথা অনেক আগে থেকেই আলোচনা করলে তবে সঠিক প্রস্ত্ততি নেওয়া সম্ভব৷ ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সকলে মিলে একসঙ্গে কাজ করা৷ দিল্লিতে কংগ্রেসের সঙ্গে যে বৈঠক ছিল, সেই বৈঠকে তৃণমূলের প্রস্তাব ছিল জুলাই-আগস্টের মধ্যে আসন রফা চূড়ান্ত করে ফেলা৷ কংগ্রেস কথাও দিয়েছিল৷ কিন্ত্ত শেষ পর্যন্ত কথা রাখল না৷ কারণ, কংগ্রেস অপেক্ষা করছিল পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য৷ কংগ্রেস ভেবেছিল যে পাঁচ রাজ্যের মধ্যে তিনটি রাজ্যে কংগ্রেস জয়ী হবে৷ তারপর শরিক দলগুলির সঙ্গে আসন নিয়ে দর কষাকষি করবে৷ কিন্ত্ত বাস্তবে কংগ্রেসের ভরাডুবি হওয়ায় বেকায়দায় পড়তে হয় এই দলকে৷ দিল্লি, পাঞ্জাব, বাংলা, তেলেঙ্গানা এই চারটি রাজ্যে যদি ১৫০ আসন থাকে, তাহলে তা নিয়ে পরে আলোচনা করা যেত, কিন্ত্ত বাকি ৪৮০ আসন নিয়ে কংগ্রেস তো আগেই আলোচনা সেরে ফেলতে পারত? কিন্ত্ত কংগ্রেসের মধ্যে সদিচ্ছার অভাব ছিল৷ তৃণমূলের পক্ষ থেকে আসন রফা নিয়ে চূড়ান্ত ডেটলাইন দেওয়া হয়েছিল ৩১ ডিসেম্বর৷ কিন্ত্ত কংগ্রেসের গা ছাড়া মনোভাবের জন্য কোনওকিছুই সম্ভব হলো না৷