• facebook
  • twitter
Saturday, 23 November, 2024

নীলের বাতি : লোকউৎসব চড়ক গাজনে

উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায় যত সব উদ্ভট ব্যাপার স্যাপারগুলো এখন বেশ মাঝেমাঝেই মাথায় চড়ে বসে৷ আবার যদি সেটা তাপক্লিষ্ট চৈত্রের প্রেক্ষাপট হয়, তাহলে একাই সোনায় সোহাগা৷ ষষ্ঠী না হয়েও সারা গ্রামবাংলা জুড়ে চলে নীলের বাতি দেওয়ার অনুষ্ঠান৷ ধুমধাম সহকারে পালিত হয় নীলষষ্ঠীর পুজো৷ হয়ত সেটা চতুর্থী কিংবা পঞ্চমী হয়, ষষ্ঠী কোনও সময় হয় বলে আমি দেখিনি৷ আবার

উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়

যত সব উদ্ভট ব্যাপার স্যাপারগুলো এখন বেশ মাঝেমাঝেই মাথায় চড়ে বসে৷ আবার যদি সেটা তাপক্লিষ্ট চৈত্রের প্রেক্ষাপট হয়, তাহলে একাই সোনায় সোহাগা৷ ষষ্ঠী না হয়েও সারা গ্রামবাংলা জুড়ে চলে নীলের বাতি দেওয়ার অনুষ্ঠান৷ ধুমধাম সহকারে পালিত হয় নীলষষ্ঠীর পুজো৷ হয়ত সেটা চতুর্থী কিংবা পঞ্চমী হয়, ষষ্ঠী কোনও সময় হয় বলে আমি দেখিনি৷ আবার এসময়েই মাথা ঘুরিয়ে দেয় বাবা ভোলানাথের দ্বিতীয় বিবাহের বর্ণনা শুনে৷ একটু দেখে নেব কি এই এমন দিন যখন স্বয়ং ভোলানাথকে আসতে হয় নীলধ্বজ রাজার ঘরে৷ নন্দী ভৃঙ্গী আর হাজার সন্ন্যাসীর তাণ্ডব নৃত্যে তখন ভূপাতিত রসাতল৷ দক্ষযজ্ঞ শেষ, সতীর প্রাণহীন দেহ কাঁধে মহাকালের তাণ্ডব নৃত্য৷ নারদ মুনির মধ্যস্ততায় রাজা নীলধ্বজের কন্যা নীলাবতীর বিবাহ সম্পন্ন হয়৷ আর সেই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই চৈত্র সংক্রান্তির শেষ দিন এসে যায়, গ্রামবাংলা মেতে ওঠে চড়ক মেলায়৷ কোনও ক্ষ্যাপা বাউলের গলায় শোনা যায়, ‘দেখবি আয় পুতুল নাচ চড়ক মেলাতে’ গান৷ যাই হোক, নীল ষষ্ঠী, নীল দেবী চণ্ডিকা বা নীলের বাতি যাই ধোঁয়াশা তৈরি করুক না কেন, গ্রামবাংলা আক্ষরিক অর্থেই নীল ষষ্ঠীকে তাদের ঘরের উৎসব বলে সেই প্রাচীনকাল থেকে আজও সমানভাবে পালন করে আসছে৷ দেখে নেব নীল আর চড়কের আবহে দগ্ধ দাহন উপেক্ষা করে বাংলার উদ্দীপনা ঠিক কোথায় পেঁৗছয় এই সময়টায়৷
হিন্দু সনাতন শাস্ত্রে বিভিন্ন পুরাণ মত বিশ্লেষণে আমরা গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের ঐতিহাসিক লোকজ সংস্কৃতির ধারক নীল চণ্ডিকা পূজা বা নীল ষষ্ঠীর গানে মেতে উঠতে দেখি নীল উৎসবে৷ কালের পরিবর্তনে আজ বিলুপ্তপ্রায় নীল ষষ্ঠী উৎসব দিন দিন ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে৷ গ্রামবাংলা ঠিক চৈত্র মাসের এই সময় তাই বাংলার ঘরে ঘরে চলে নানান দেবদেবীর আরাধনা৷ বিশেষত শিব-পার্বতীর ধ্যানেই মত্ত থাকে বিভিন্ন জনপদ৷ নীল পূজা বা নীল ষষ্ঠীর উৎসব এসময় ধর্মীয়ভাবে পালিত হয় ঘরে ঘরে৷ নীল চণ্ডীর পূজা ও লোকগানের সমারোহে মেতে ওঠে লোকউৎসব৷ নীল পূজা বা নীল ষষ্ঠী হল সনাতন বঙ্গীয় রীতির এক লোকোৎসব, যা মূলত নীল-নীলাবতীর (শিব-দুর্গা) বিবাহ উৎসব৷ বাঙালি মায়েরা নিজেদের সন্তানের মঙ্গল কামনা এবং নীরোগ সুস্থ জীবন কামনায় নীলষষ্ঠী ব্রত পালন করেন৷

চৈত্র সংক্রান্তি যদিও চড়ক উৎসবের আবহে বেঁধে রাখে সারা প্রকৃতিকে, তার আগের দিন আমরা দেখি নীল পূজার অনুষ্ঠান৷ প্রাচীনকালে পুরো চৈত্র মাস জুড়ে সনাতন ধর্মের এই লোকোৎসব চললেও কালের বিবর্তনে চৈত্রের শেষে গাজন উৎসবের অঙ্গ হিসাবেই এই নীল ষষ্ঠীর ব্রত পালন করা হয় এপার ওপার বাংলা মিলে, যা মূলত নীল-নীলাবতীর বিবাহ-অনুষ্ঠানের স্মারক বলেই পরিগণিত৷ অষ্টক গানের সুরে এই লোকউৎসব যথার্থ অর্থবহ৷ শাস্ত্রীয় পুরাণ অনুসারে নীল বা নীলকণ্ঠ মহাদেব শঙ্করের অপর নাম৷ সেই নীল বা শিবের সঙ্গে নীল দেবী চণ্ডিকা বা নীলাবতী, সতীর বিয়ের অলৌকিক আচার অনুষ্ঠান সংগঠিত হয়৷ পুরাণ কাহিনি থেকে জানতে পারা যায়, দক্ষ রাজার যজ্ঞ অনুষ্ঠানে অপমানিত দেবী পার্বতী দেহত্যাগ করেন৷ পুনরায় আবার আমরা দেখতে পাই নীলধ্বজ রাজার কাননে বিল্ববনে এক অপরূপ সুন্দরী কন্যার আবির্ভাব৷ রাজা তাঁকে নিজ কন্যা রূপে লালনপালন করে শিবের সঙ্গে বিয়ে দেন৷ নীলাবতী নিজগুণে শিবকে মোহিত করেন৷ মহামুনি নারদের মধ্যস্থতায় শিব-নীলাবতীর বিবার সম্পূর্ণ হয়৷ সাময়িক যন্ত্রণা ভুলে মহাদেব আবার মত্ত হন অঘোর ধ্যানে৷ অতঃপর দেবী নীলচণ্ডিকা মক্ষিকা রূপ ধরে ফুলের সঙ্গে মিশে জলে নিক্ষিপ্ত হন, মৃতু্যবরণ করেন৷ গ্রামবাংলার মায়েরা সন্তানের সুস্থ জীবন ও নীরোগ শরীর কামনায় নীল ষষ্ঠী ব্রত পালন করেন৷ সাধারণত চৈত্র সংক্রান্তির চড়ক উৎসবের আগের দিন নীল পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে৷

এবার একটু চড়কের রীতিনীতি দেখে নেওয়া যাক৷ চড়কে শুধু বড়শি গেঁধে নিজেদের পিঠ, জিহ্বা, পাঁজরকে ক্ষতবিক্ষত করে চড়কে ঘুরে ধর্মীয়ভাবে আশীর্বাদ গ্রহণ করা আর পূজা সমাপন করা হয়৷ নীল সন্ন্যাসী আর শিব-দুর্গার সঙ সেজে গীতিবাদ্য সহযোগে বাড়ি বাড়ি ঘরে সন্ন্যাসীরা ভিক্ষা গ্রহণ করেন, সঙ্গে থাকে সেই চিরাচরিত অষ্টক গান৷ সন্ধ্যায় মায়েরা সন্তানের কল্যাণার্থে প্রদীপ জ্বালিয়ে শিব পূজা করে সারাদিনের উপবাস ভঙ্গ করেন৷ ষষ্ঠী তিথি না হলেও তাই এদিন পালন করা হয় নীল ষষ্ঠীর উৎসব৷ উৎসবে উপস্থিত ভক্ত ও সন্ন্যাসীরা ভক্তিভরে গেয়ে ওঠে নীলের সঙ্গে নীলদেবীর বিবাহের গান— ‘ শুন সবে মন দিয়ে হইবে শিবের বিয়ে / কৈলাসেতে হবে অধিবাস৷’ কিংবা ‘নারদ চলল গিরি রাজের গৃহেতে / শোনো ওগো গিরি রাজা, হইবা আমার আজ, জামাই তোমার হবে দিগম্বর’ ইত্যাদি৷
বিবাহের পর নীলের গানে থাকে গৃহী সংসারী হর-পার্বতীর কথা, শিব গৌরীর প্রকৃতি সাজানো, ভিখারি শিবের সঙ্গে অন্নপূর্ণা শিবানীর দ্বান্দ্বিক সহাবস্থানের কাহিনী৷ গানের প্রথম অংশ দলপতি বালারা এবং পরবর্তী অংশ অন্য নীলসন্ন্যাসীরা গেয়ে থাকেন৷ গানের শেষে গৃহস্থরা সন্ন্যাসীদের চাল-পয়সা, ফলমূল সন্ন্যাসীদের হাতে সমর্পন করে৷ হিন্দু রমনীরা শিব মন্দিরে নীলপূজা সমাপন করে নীলের বাতি জ্বালিয়ে জলগ্রহণ করে, ব্রত ভঙ্গ হয়৷ পরদিন সংক্রান্তি, এবার একটু চড়ক দর্শন করা যাক, দেখে নেব, একটু রীতিনীতি, তার স্বরূপ৷

পুঁথি বিশ্লেষণ করে জানা যায়, এই দিনে শিব-উপাসক বাণরাজা দ্বারকাধীশ কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মহাদেবের শরণাপন্ন হন৷ কঠিন ধ্যানে শিবকে সন্ত্তষ্ট করেন৷ ভক্তিসূচক নানান আচার অনুষ্ঠান নৃত্যগীতাদি ও নিজ গাত্ররক্ত দ্বারা শিবকে তুষ্ট করে অভীষ্ট সিদ্ধ করেন৷ সেই স্মৃতিতে শৈব সম্প্রদায় এই দিনে শিবপ্রীতির জন্য উৎসব করে থাকেন৷ যার প্রধান অঙ্গই হল এই চড়ক পূজা বা হাজরা উৎসব৷

চড়ক পূজা চৈত্রসংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনে পালিত হয়৷ এ পূজার প্রধান উদ্দেশ্য নীল দেবীর পূজা অর্চনা করা৷ গ্রামবাংলায় যা নীলষষ্ঠী বা নীলপূজা হিসাবে পরিগণিত হয়ে থাকে৷ বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান আগের দিন রাত থেকেই শুরু হয়ে যায়৷ চড়ক গাছ প্রথমে ধুয়েমুছে সাফ করে রাখা হয়৷ পরে একটি জলভরা পাত্রে একটি শিবলিঙ্গ আর সিঁদুর মাখানো একটি কাঠের তক্তা রাখা হয়৷ আপামর ভক্তের সাধের সেই শিবের পাটা তখন সাক্ষাৎ ভোলানাথ৷ পতিত ব্রাহ্মণের দায়িত্বে বাবা বুড়োশিবের পূজাআচ্চা সমাপন হয়ে থাকে৷ এ পুজোর বেশ কিছু বিশেষ অঙ্গ, যেমন কুমীর পুজো, জ্বলন্ত আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, কাঁটা, ছুরির ওপর ক্রমাগত লাফানো ইত্যাদি বিশেষ আগ্রহ জাগায় গেঁয়ো মানুষের মনে৷ এছাড়া বাণ ফোঁড়া, চড়ক গাছে ঝুলে থেকে ঘোরা, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে তখন বেঁধানো থাকে লৌহশলাকা৷ কোথাও কোথাও দানো-বারনো বা যাকে হাজরা পূজা বলা হয়ে থাকে সেসব অনুষ্ঠিত হয় এ সময়৷ নীলপূজার অনুষঙ্গ হিসাবে এসময় মধ্যরাত্রিতে শিবের বিশেষ পূজার অঙ্গকে হাজরা পূজা বলে৷ দেবাদিদেব শিবের উৎসবকে কেন্দ্র করে ত্রিভুবনের সমস্ত দেবতাদের আমন্ত্রণ করা হয় উৎসবে সামিল হওয়ার জন্য৷ দেবতাদের উদ্দেশ্যে পোড়া শোল মাছ নিবেদন করা হয়৷ শৈব ভক্ত চেলাদের গর্জনে তখন চলছে মহামিলন উৎসব৷ চৈত্রের দাহন তখন কিছুই করতে পারে না৷ ভক্তের পাশে তখন স্বয়ং ভোলানাথ আছেন, তাই না৷ ওদিকে পড়ন্ত দুপুরের শেষলগ্নে চলতে থাকে চড়ক গাছে ঝোলানো শলাকা বেঁধানো বেচারা ভক্তের আকুল চিৎকার— ‘জয় বাবা ভোলেনাথের চরণে সেবা লাগে, হর হর মহাদেব৷’

আমার নিবন্ধের শুরুতে যত সব উদ্ভট ব্যাপার স্যাপার বলে শুরু করেছিলাম৷ আমি বলেছি ষষ্ঠী না হয়ে সেটা চতুর্থী বা পঞ্চমী তিথি থাকে৷ তাহলে নীল ষষ্ঠী বলি কেন— একটু ফিরে যাব পুরাণ বিশ্লেষণে৷ অনেকের মতে, আসলে ষষ্ঠীই এসেছিলেন নীলাবতী রূপে৷ ষষ্ঠীর উল্লেখ কিন্ত্ত পুরাণে পাওয়া যায়৷ তিনি আদি শক্তির অংশ, তাই তাঁকে দুর্গা বা আদ্যাশক্তির একটি রূপ হিসাবেই ধরা হয়৷ সুতরাং নীলাবতী একই সঙ্গে সতী অথবা ষষ্ঠী দু’জনেরই রূপ হিসেবে কল্পিত হতে পারেন৷ প্রধানত সন্তানের কল্যাণের জন্যই ষষ্ঠীর পুজো প্রচলিত বাংলা, বিহার, ওড়িশা এবং উত্তরপ্রদেশের কিছু জায়গাতে৷

তাই নীলের পুজোর দিনে ষষ্ঠীর আটনে পুজো দেওয়ার রীতিও আছে৷ নীলাবতীর বেল গাছের তলায় আবির্ভাবকে মনে রেখে বেল কাঠের একটি মূর্তি বানানো হয়৷

একটু ব্রতকথায় ফিরে যাই৷ সেই বামুন-বামুনীর গল্পের কথায়— তাদের বারবার সন্তান জন্মালেও, কোনও না কোনও দুর্ঘটনা তাদের সন্তানদের কেড়ে নিত৷ অগত্যা মনের দুঃখে তাঁরা কাশী যাত্রা করেন৷ সেখানে গঙ্গার ঘাটে এক বুড়ির ছদ্মবেশে তাঁদের দেখা দেন দেবী ষষ্ঠী রূপী দেবী চণ্ডিকা৷ সন্তান হারানোর দুঃখের কথা জেনে নিদান নেন সারা চৈত্র মাস সন্ন্যাস ব্রত রেখে সংক্রান্তির আগের দিন অর্থাৎ নীল ষষ্ঠীর দিনে শিবের পুজো করার৷ সেই রীতি মেনে আবার সন্তানলাভ করেন ওই দম্পতি৷ নীলের ব্রত শুরু৷

আস্তে আস্তে চড়ককে বিদায় দিয়ে আবার আসে সেই নতুনের ছোঁয়া, শুদ্ধ বৈশাখ খোলে নতুন দিগন্ত৷ তবুও একটা জিনিসে খটকা থাকে৷ ধর্মের কচকচানিতে না গিয়েই বলছি মহাদেব, গৌরী ত্রিকালদর্শী হলেও এই বাণফোঁড়া, আগুনে হেঁটে যাওয়া হয়ত কল্পনাও করতে পারেন না৷ এখানেই সেই চিরন্তন কথা বিশ্বাস— ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্ত্ত, তর্কে বহুদূর৷’