নয়া অবতার

আবেগ-উন্মাদনা-উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রচারে ভর করে ২০১৪ ও ২০১৯ সালে নির্বাচনে সাফল্য পেয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি৷ এবারে ভোটের প্রাক্কালে শুধু মন্দির-মসজিদের চেনা তাস খেলে তৃতীয় ইনিংসও শুরু করেছিলেন৷ তাতে বিশেষ সুবিধা না হওয়ায় বাজারে নিয়ে আসেন মোদির গ্যারান্টি কার্ড৷ দলের ইস্তাহার থেকে নানাবিধ প্রচারে সেই বায়বীয় গ্যারান্টির প্রচারেও ভোটারদের মন গলানো যাচ্ছে না দেখে হিন্দুত্বের তাস খেলতে শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী৷ সংখ্যালঘু মুসলিম নিয়ে মনগড়া অপপ্রচার চালিয়ে হিন্দুদের মনে আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা করে উন্মাদনা তৈরি করতে কসুর করেননি তিনি৷ কিন্ত্ত এতেও পরাজয়ের ভ্রুকুটি এড়ানো যাচ্ছে না দেখে শেষ দফা ভোটের আগে এবার স্বয়ং ঈশ্বরকে অস্ত্র করেছেন মোদি৷ রক্তমাংসের এই গেরুয়া নেতা এখন খোলাখুলি বলছেন, তাঁর জন্ম জৈবিক (বায়োলজিক্যাল) প্রক্রিয়ায় হয়নি৷ তাঁকে ঈশ্বর পাঠিয়েছেন৷

নতুন চালে মোদি আর নিজেকে আরএসএস সংগঠনের প্রচারক বা বিজেপির নেতা ভাবছেন না৷ তিনি নিজে সরাসরি দেবতার প্রেরিত দূত হিসাবে জাহির করতে শুরু করেছেন৷ সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, স্বয়ং পরমাত্মা নাকি তাঁকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে ভারতে পাঠিয়েছেন৷ ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত ভারত গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁকে৷ এই লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ঈশ্বর তাঁকে ফিরিয়ে নেবেন না৷ অর্থাৎ যতদিন না ভারত আমেরিকা-ব্রিটেনের মতো উন্নত হচ্ছে, ততদিন তাঁর মৃতু্য নেই৷ আর আমৃতু্য প্রধানমন্ত্রীর পদ তাঁর জন্যই বরাদ্দ থাকবে৷

দশ বছর আগে ৭৫ বছর বয়স হলেই নেতাদের অবসরের তত্ত্ব খাড়া করে পূর্বসূরী সব সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী শীর্ষ নেতাদের মাঠের বাইরে বের করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আসন কবজা করেছিলেন৷ এবার দশ বছর পর তারই তৈরি সেই ফর্মুলায় নিজের গদি যাতে হাতছাড়া না হয়ে যায় তাই নতুন এক ছক কষে ফেললেন৷ এই ছক সফলভাবে প্রয়োগ করতে পারলে তাঁর উত্তরসূরীদের পক্ষে আগামী কয়েক যুগ সুযোগ এলেও প্রধানমন্ত্রীর পদে আর বসা হয়ে উঠবে না৷ কারণ মোদির নয়া ফর্মুলা অনুযায়ী তিনিই আজীবন প্রধানমন্ত্রী থেকে যাবেন৷ তাই অনেক ভেবে চিন্তে ছলচাতুরি ও ফন্দিফিকির করে মোক্ষম চাল চেলে নিজেকে রীতিমতো অবতার রূপে হাজির করতে আসরে নেমে পড়েছেন৷ এতদিন তাঁর লক্ষ্য হিসাবে চর্চিত হতো তৃতীয় বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়া৷ এবার তা আরও বহুদূর সম্প্রসারিত করে ২০৪৭ সাল পর্যন্ত করেছেন৷ তখন তাঁর বয়স ৯৬ বছর হয়ে গেলেও গদি অাঁকড়ে থাকতে চান৷


যে অবতারকে পরমাত্মা পাঠিয়েছেন ভারতে, তাঁর কাজও তিনিই ঠিক করে দিয়েছেন৷ গত দশ বছরে মোদির শাসনে দেশে যা কিছু হয়েছে, সবই তাহলে পরমাত্মার নির্দেশেই৷ কোভিড অতিমারীর সময় মাসের পর মাস দেশ অচল করে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ভেঙে তছনছ করে লক্ষ লক্ষ মানুষের অসহায় মৃতু্য নিশ্চিত করার নির্দেশ কি পরমাত্মার ছিল? কোভিডকালে নিশ্চিত বিলাসী জীবন ঘরে বসে না কাটিয়ে পরমাত্মার প্রেরিত দূত কোটি কোটি আক্রান্তের সেবা করতে পাশে যাননি কেন? তাঁর তো মৃতু্যভয় থাকার কথা নয়৷ পরমাত্মার দূত তো সর্বত্যাগী হয়৷ তিনি সহস্রাধিক নিরাপত্তা কর্মীর ঘেরাটোপে থাকেন কেন? ৪০০ কোটি টাকার সবচেয়ে বিলাসবহুল বিমানে চড়েন কেন? ৪০ কোটি টাকার গাড়ি লাগে কেন? দিনে পাঁচ-সাতবার পোশাক বদলাতে হয় কেন? এক পোশাক দ্বিতীয়বার পরেন না কেন? পরমাত্মার প্রতিনিধির ৩ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক ব্যালান্সের প্রয়োজন কী? পরমাত্মা কি বলেছিলেন দেশে বেকারির সর্বকালীন রেকর্ড তৈরি করতে? কর্মসংস্থানে সংকট সৃষ্টি করতে? ধনকুবের বন্ধুদের সাহায্য করতে? ঋণের দায়ে কৃষকের আত্মহত্যা, ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া, শ্রমিকদের আয় না বাড়া, সবটাই কি পরমাত্মার নির্দেশ৷ বাঁচার তাগিদে দেশবাসীর সঞ্চয় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, বাড়ছে ঋণগ্রস্ততা৷ বাড়ছে আয় ও সম্পদের সীমাহীন বৈষম্য৷ পরমাত্মার নির্দেশেই কি এসব করে চলেছেন মোদি?

জব্বর গল্প ফেঁদেছেন মোদি৷ মানুষের চোখে তিনি একজন অতি ক্ষমতালোভী একনায়ক, অতিবিলাসী নেতা, ধনকুবেরদের পরমাত্মীয় একজন ব্যর্থ অযোগ্য শাসক৷ তাঁর সব গ্যারান্টিই মিথ্যাচারে ভরা৷ এখন নিজেই নিজেকে পরমাত্মার প্রতিনিধি বলছেন৷ এমন এক ‘বুজরুকি বাবা’র মুখোশ খেলার সময় এসে গিয়েছে৷