চঞ্চল বন্দ্যোপাধ্যায়
রবীন্দ্রনাথ একাধারে গীতিকার, সুরস্রষ্টা ও গায়ক৷ সংগীতের এই ত্রিধারায় সমৃদ্ধ তাঁর গান৷ বিশ্বসংগীতে এক ত্রিবেণী সঙ্গম এবং মণিকাঞ্চন যোগে অনন্য৷
একই সঙ্গে অবশ্য-বিবেচ্য তাঁর চতুর্থ পরিচয় যা স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে৷ সেটি হল, সংগীত শিক্ষক হিসেবে তাঁর প্রতিভার প্রকাশ৷ আজীবন গান রচনার পাশাপাশি শিক্ষকের ভূমিকাও নিরন্তর পালন করেছেন, নিজের সৃষ্ট সংগীতের শুদ্ধতা রক্ষার প্রয়াসে৷ তাঁর গান যেন নিখঁুতভাবে গাওয়া হয়, কোনও বিচু্যতি যেন না থাকে সুরের রূপায়নে, তা নিশ্চিত করতে শিক্ষাদানে তিনি ছিলেন অক্লান্ত৷ বিশিষ্টজনের স্মৃতিকথায় ধরা আছে স্রষ্টা-শিক্ষকের এই নিরলস আন্তরিকতার উজ্জ্বল ছবি৷
‘জীবনস্মৃতি’ ও ‘ছেলেবেলা’-য় রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, শিশুকাল থেকেই পরিবারে গানচর্চার মধ্যে বেড়ে উঠলেও, নিয়ম মেনে প্রথাগত শিক্ষালাভ তাঁর ঘটেনি, স্বভাবত অনীহার কারণে৷ ‘সে জন্য গান শেখাই হল না, লিখেছেন৷ তাই পরবর্তীকালে সংগীত শিক্ষক হিসেবে তাঁর প্রকাশ ও পূর্ন বিকাশ বিস্ময়কর মনে হতে পারে৷ বিশেষত, তিনি যখন স্বরলিপি করতে জানতেন না এবং নিজের করা সুরও ভুলে যেতেন বলে স্বীকার করেছেন একাধিকবার৷ কিন্ত্ত, এর ফলে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে মনের গভীরে উদয় হত গানের যে অখণ্ড রূপ, কথায় ও সুরে, তা নিজকণ্ঠে ধারণ করে দ্রুত অন্যের কণ্ঠে তুলে দেওয়ার অদম্য তাগিদে এই শিক্ষক-সত্তা জেগে ওঠে, পরিপূর্ণতা পায়৷ এখানেই গীতিকার, সুরকার, গায়ক ও শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ মিলেমিশে একাকার হয়ে যান এক অভিন্ন সৃষ্টি-সত্তায়৷ এই শিক্ষাদানের মাধ্যমে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের সংগীত ব্যক্তিত্বের বহুমুখী ছটা—সুগভীর মনন, আন্তরিকতা, ধৈর্য, নিষ্ঠা ও সংগীত বোধের অনন্য এক সমন্বয়ে৷ এই বর্ণাঢ্য পরিচয়ই এখানে বিশেষভাবে বিবেচ্য৷
রবীন্দ্রনাথের ‘সকল গানের কাণ্ডারী’, শিক্ষার্থী দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শিক্ষক রবীন্দ্রনাথের এক অন্তরঙ্গ ছবি পাওয়া যায় অধ্যাপক তেজেশচন্দ্র সেনের স্মৃতিকথায়—‘… গানের সুর দিয়েই তিনি দিনুবাবুকে ডেকে পাঠাতেন৷ কখনো কখনো তিনি নিজেই গানের খাতা হাতে করে, গানের সুর গুন্গুন্ করতে করতে দিনুবাবুর বাড়িতে গিয়ে হাজির হতেন৷ তারপরই শেখবার ও শেখাবার পালা আরম্ভ হত৷ … সে সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েই থাকতেন আনন্দে ভরপুর৷ উভয়েরই পা গানের তালে তালে উঠছে পড়ছে, হাতে তুড়ি বাজছে, গানের সুর আবৃত্তির পর আবৃত্তি হচ্ছে, উভয়েরই মুখ উজ্জ্বল৷ চোখে আনন্দের দীপ্তি৷ … গান শেষ হয়ে যেত, কিন্ত্ত রবীন্দ্রনাথ তখনো বসে থাকতেন—গানের কথা উঠত, সুরের কথা উঠত৷’ বোঝা যায়, শিক্ষাদানের সার্থকতায় তখন তিনি তৃপ্ত৷ কিন্ত্ত রাত্রে সুর পেয়ে বসলে ডাক পড়ত দিনেন্দ্রনাথের ছাত্রদের, জানিয়েছেন তেজেশচন্দ্র৷ এভাবেই তাঁকে রাত্রে অনেকক্ষণ ধরে শিখিয়েছিলেন ‘আরো আঘাত সইবে আমার’ গানটি৷ পরদিন রমা মজুমদারকে (নুটু) ডেকে আবার শিখিয়ে তবে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন৷
শিক্ষাদানে এই ধৈর্য বিস্মিত করেছিল মৈত্রেয়ী দেবীকে৷ ‘মায়ার খেলা-র গানের রিহার্সাল মনে পড়ে—অমিতা সেনের (খুকু) গান৷ কবি সঙ্গে গাইছেন— ‘অলি বার বার ফিরে আসে, বর বার ফিরে যায় …৷’ আমিতা একবার গাইছে, কবি আবার তাকে সংশোধন করছেন৷ … এত সহিষ্ণু শিক্ষক আমি আর দেখিনি৷’ অথচ খুকুই খুব দ্রুত গান তুলতে পারতেন বলে কবি স্বীকার করেছিলেন৷ তাঁকেও ছাড়েননি, নিখঁুত না হওয়া পর্যন্ত৷
এই অমিতা সেনের (খুকু) প্রায়ই ডাক পড়ত শিখে নেওয়ার জন্য৷ ‘যদি হায় জীবনপূরণ নাই হল মম’ তাঁকে ডেকে, অনেকটা সময় নিয়ে, বারবার গাইয়ে ও নিজে গেয়ে শিখিয়েছিলেন৷ তখন তাঁর কণ্ঠ ক্ষীণ, কাঁপা কাঁপা, ভেঙেও গিয়েছিল৷ তবু তিনি অদম্য৷ এই অসীম ধৈর্য ও নিষ্ঠায় ১৯০৬ সালে রচিত একলা চলোরে গানটি পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের কণ্ঠে তুলে দেওয়ার জন্য অরগ্যান বাজিয়ে অনেকবার গেয়েছেন এবং অনেকদিন ধরে৷
হারমোনিয়াম রবীন্দ্রনাথের পছন্দ ছিল না৷ সংগীত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে তো নয়ই৷ ‘ছেলেবেলা’-য় লিখেছেন—‘কাঁধের উপর তাম্বুরা তুলে গান অভ্যেস করেছি৷ কল-টেপা সুরের গোলামি করিনি৷’ কিন্ত্ত সদ্যরচিত দুটি গান—‘প্রথম ফুলের পাব প্রসাদখানি’ এবং ‘ওগো শেফালিবনের মনের কামনা’—দ্রুত শেখানোর তাগিদে মাধ্যমের এই বাধা মানেননি৷ এক প্রাক্তন ছাত্রের বয়ানে—পুজোর ছুটির সময় হঠাৎ একদিন সত্যকুটিরের একটি ঘরে রাখা জীর্ণ, বড় এক টেব্ল—হারমোনিয়াম বাজিয়ে বারবার নিজে গেয়ে ও তাঁকেও বারবার গাইয়ে তবেই নিষ্কৃতি দিয়েছিলেন৷
এই অস্থির নিষ্ঠায় ছাত্রী সাবিত্রী কৃষাণ-এর কাছে শোনা দক্ষিণী সুরের গান ভেঙে রচনা করলেন ‘বাসন্তী হে ভুবনমোহিনী’ এবং তাঁকে তখনই ডেকে, শিখিয়ে পড়িয়ে সেই সুরে গাওয়ালেন বাংলা কথায়৷ স্নান খাওয়ার সময় পর্যন্ত দেননি৷ সুরের একটি নোটও যেন বিলম্বের জন্য না হারায়, তা নিশ্চিত করার এই আকুলতা অভিভূত করে৷
নিজের গানের সুরের বিশুদ্ধতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে কতটা স্পর্শকাতর ছিলেন, এ প্রসঙ্গে সেই বিষয়টি উঠে আসে৷ শৈলজারঞ্জন মজুমদার জানিয়েছেন, ‘আমার মন মানে না দিন রজনী’ গানটি রবীন্দ্রনাথ নিজেই নির্বাচন করে ক্লাসে তাঁকে শেখালেন৷ এ গান আগেই দিনেন্দ্রনাথের কাছে শিখেছিলেন, এ কথা রবীন্দ্রনাথ শুনেই ভীষণ চটে গিয়ে বললেন—‘পাঁঠাটা আমার, ঘাড়ে কাটব না ল্যাজে কাটব সেটা আমিই জানি৷ আমি যে সুর শিখিয়েছি, সে সুরে গাইবে, অন্য সুরে নয়৷’ ‘দু’জনের মধ্যে সুরের কিছুটা তফাৎ ছিল’, জানিয়েছেন শৈলজারঞ্জন৷
দিনেন্দ্রনাথের করা স্বরলিপিতে এই সুরের পার্থক্য গান শেখানোয় যে কি বিড়ম্বনা সৃষ্টি করত কবির পক্ষে, তার বিবরণ দিয়েছেন নির্মলকুমারী মহলানবিশের কাছে৷ … ‘এই শ্রাবণবরিষণ পার হয়ে কী বাণী’ গানটা স্পষ্ট মনে আছে বেহাগে সুর বসিয়েছি, আর শুনি মেয়েরা গাইছে মল্লারে৷ আমি আপত্তি করাতে বলল—‘বাঃ, পরশুদিন দিনদার গানের ক্লাসে শিখেছি৷ দিন্দা ভুল সুর শিখিয়েছেন এ হতেই পারে না, আপনি ভুলে গেছেন৷’ …আমার কবির খেয়ালের চেয়ে দিনদার উপর অনেক বেশি ভরসা৷ স্রষ্টার ও শিক্ষকের এ ‘কী বেদনা সে কি জান’!
নির্মলকুমারী জানিয়েছেন, দিনেন্দ্রনাথ অনেক সময় অনুযোগ করতেন, রবীন্দ্রনাথ একই গান দু-তিনরকম সুরে শেখান৷ ভুল ধরলে লোকে বলে, স্বয়ং কবির কাছে শিখেছি৷ রবীন্দ্রনাথের জবাব— ‘নিজের স্মৃতিশক্তির ওপর একটুও বিশ্বাস নেই বলে আমিও প্রতিবাদ করতে সাহস পাইনে৷ আর তা ছাড়া আমার নিজেরই তো দেওয়া সুর৷ কাজেই আর একটা নতুন সুর দিলুমই বা৷ তাঁর মতো স্রষ্টা—শিক্ষকের একথা মনে হওয়া খুবই সংগত ও স্বাভাবিক৷ কিন্ত্ত তখন তা স্বীকৃত হয়নি৷ স্বরলিপি অনুযায়ী শিক্ষাদানের বাধ্যবাধকতার পড়ে, মনে উদয় হওয়া সেই নতুন সুরের প্রবাহ প্রকাশের পথ পেল না, হারিয়ে গেল গানের সমৃদ্ধ হবার সুযোগ৷ দুঃখজনক৷ প্রসঙ্গত, পরবর্তীকালে অনেক ক্ষেত্রে স্বরলিপি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে৷
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে বিশিষ্ট শিল্পী সাহানা দেবীকে, যিনি, রবীন্দ্রনাথের কথায়, তার গানের মূল সুরটিকে ধরতে পেরেছিলেন৷ তাই তাঁকে অনেক গান শিখিয়েছিলেন৷ শিল্পীর অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় সেই বহুমূল্য স্মৃতি—‘আমি তাঁর পায়ের কাছে বসে গান শিখেছি৷ তিনি যেমন গান শিখিয়ে আনন্দ পেতেন, তেমনই আনন্দ পেতেন গান গেয়েও৷ … শান্তিনিকেতন, কলকাতা, কাশী—যখন যেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তিনি গান শিখিয়েছেন৷ … তাঁর কাছে বসে গান শেখার যে কী আনন্দ তার কোনও তুলনা পাইনি এ-জীবনে৷ … ১৯২৩-এ বসন্ত উৎসবের জন্য বিশেষ করে শেখালেন দুটি ভাঙা গান— হিন্দি গানের সুরে কথা বসিয়ে৷ এইসব হিন্দি গানের সুর তান, ছোট ছোট দানার কাজ আমার গলায় তখন অনায়াসে খেলত৷ সেই কারণে আরও একটি হিন্দি ভাঙা গান ‘বুঝি ওই সুদূরে ডাকিল মোরে শিখিয়ে দিলেন৷’ … ১৯২৩ সালে বিসর্জন নাটকের জন্যও ‘মোট দশটা তিনি আমাকে শেখালেন জোড়াসাঁকোর ৬ নম্বর বাড়িতে৷’ (রবিবাসরীয়, ১৯/০৩/২৩)৷ সেইসব শিক্ষার এক সভ্রান্ত নিদর্শন ‘যদি তারে নাই চিনি গো’ (১৯২৫)৷ তবে শিক্ষাদানের সময় কবি তবলা খোল পাখওয়াজ পছন্দ করতেন না, বলেছেন শিল্পী৷
বিশিষ্ট গায়িকা অমিয়া ঠাকুর, সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নাতবৌ (হেমেন্দ্রনাথের নাতির স্ত্রী)৷ সুরেলা কণ্ঠে নানা কারুকাজের দক্ষতা লক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে এমন ধারার অনেক শক্ত গান শিখিয়েছিলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে৷ ‘অধিকাংশ খেলানো সুরের গান ভালবাসতেন দেখেছি৷… একেকটি গান দু-তিন দিন ধরে শেখাতেন, জানিয়েছেন, আমিয়া৷ তাঁর কণ্ঠে সেইসব সম্পদের সামান্যই রক্ষিত, দুটি রেকর্ডে—‘হে নূতন দেখা দিক আরবার’ এবং ‘সমুখে শান্তি পারাবার’ (১৯৪১)৷ তাছাড়া, ‘বড় বিস্ময় লাগে’ এবং ‘তবু মনে রেখো’— পঞ্চকন্যা অ্যালবামে লাইভ রেকডিং (১৯৭৯) এবং ‘এ পরবাসে রবে কে’ (কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিতে, ১৯৬২)৷
কত বিচিত্র পরিস্থিতিতে যে গান রচনা করে শিখিয়েছেন! বিস্ময়কর! ১৯১৬ সালে জাপান যাবার পথে চিন সাগরে তাঁর জাহাজ প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিতে পড়ে৷ অবিশ্রান্ত দুর্যোগের মধ্যে ডেক ছেড়ে কেবিনে এসে নতুন গান তৈরি করে গাইতে লাগলেন—‘তোমার ভুবনজোড়া আসনখানি৷’ ইতিমধ্যে যাত্রাসঙ্গী পিয়ার্সন ও মুুকুল দে-কেও শেখান৷ চরম বিপদে অবিশ্বাস্য এই স্থৈর্য৷
ইউরোপে যাত্রাসঙ্গী নির্মলকুমারী মহলানবিশ লিখেছেন যে ইদানিং নতুন সুর দিয়েই হাতের কাছে যে থাকত তাকে গানটা শিখিয়ে দিতেন৷ ১৯২৬ সালে ইউরোপ ভ্রমণের সময় পথে পথে অনেক গান রচনা করে ডাক দিয়ে শিখিয়েছিলেন৷ বাল্টিক সাগরে জাহাজের ডেক-এ তুলে নেওয়া ট্রেনের কামরায় এভাবেই শিখিয়েছিলেন ‘সে কোন পাগল যায় পথে তোর৷’ বুডাপেস্ট পেঁৗছেই, ‘পথ এখনও শেষ হল না৷’ আবার বোলপুর থেকে ট্রেনে আসতে আসতে মনে এল নতুন গান— ‘আনন্দ গান উঠুক তবে বাজি৷’ সঙ্গে সঙ্গে অন্য কামরা থেকে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ডেকে এনে শিখিয়েছিলেন, দু’জনে একসঙ্গে গাইলেন৷ (হিরণকুমার সান্যাল)৷ পাছে সুর ভুলে যান, তাই এত তাড়া৷
বিবাহবাসর! রাজনারায়ণ বসুর কন্যা লীলাবতীর বিবাহ উপলক্ষে তাঁর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ দুটি গান রচনা করেছিলেন—‘দুই হূদয়ের নদী একত্রে মিলিল যদি’ এবং ‘মহাগুরু, দুটি ছাত্র এসেছে তোমার৷’ তিনি নিজে পাঁচ জন গায়কের দলকে শিখিয়ে দেন, তার মধ্যে একজন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, পরে স্বামী বিবেকানন্দ৷ তাঁর সম্পাদিত ‘সংগীতকল্পতরু’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের যে দশটি গান রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ‘দুই হূদয়ের নদী’৷ বলা বাহুল্য, ঘটনাটির তাৎপর্য আলাদা৷
সুরকার রবীন্দ্রনাথকে সংগীত পরিচালকের ভূমিকাও পালন করতে হয়েছিল বহুবার৷ শান্তিনিকেতনে, কলকাতায় ও ভারতের বিভিন্ন শহরে নৃত্যনাট্য ও গীতিনাট্যের অনুষ্ঠানে গায়ক-গায়িকাদের পরিচালনার দায়িত্বে থাকার সময় পরিস্থিতি অনুযায়ী, তাদের কণ্ঠের ক্ষমতা অনুসারে এবং বড় হল ঘরে শ্রোতাদের সুবিধার কথা ভেবে, সুরের তাল, লয় ও স্কেল পরিবর্তন করেছেন৷ কোন্ কোন্ গান এককভাবে, দ্বৈতকণ্ঠে বা কোরাসে গাওয়া হবে তা-ও নির্দিষ্ট করে দিতেন৷ আবার পরীক্ষামূলক গানের সফলতার জন্য সঠিক শিল্পী নির্বাচন—এটিও তাঁর দ্বৈত কৃতিত্ব৷ গায়ক শান্তিদেব ঘোষের বয়ানে—‘১৯৩১ সলে বর্ষামঙ্গল উপলক্ষে ক্ষণিকার কৃষ্ণকলি কবিতাটিতে সুর দিলেন কীর্তন ও নানা রাগিনী মিশিয়ে—বর্তমান লেখককে দিয়েই সেই পরীক্ষা চালালেন৷ গানের বাঁধা ছন্দকে ভেঙে আবৃত্তির ধরনটিকে বজায় রেখে আমাকে সর্বসমক্ষে গাইতে হল৷’
মহাজীবনের প্রান্তরেখায় এসেও এই সৃষ্টি ও শিক্ষাদানের প্রবাহ অব্যাহত ছিল৷ জোড়াসাঁকোয় রোগশয্যায় নির্মিত শেষ দুটি গান—‘ওই মহামানব আসে’ (১৪ এপ্রিল, ১৯৪১) এবং ‘হে নূতন দেখা দিক আরবার’ (৬ মে, ১৯৪১)—প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্যে ঃ
১৷ মৈত্রেয়ী দেবী— আমাকে dictate করলে সেই আশ্চর্য গানটি— ‘ওই মহামানব আসে৷’ শান্তিদেবকে ডেকে আনা হল সন্ধ্যায়৷ তারপর তার সঙ্গে গলা রেখে সুর সংযোজন করলেন৷ … গানটান শিখিয়ে তারপর বলছেন, ‘আমার জন্মদিনের উৎসবে গানটা গাওয়া হবে৷’ অবশ্য শান্তিদেব ঘোষ বলেছেন, সুর করে শিখিয়েছিলেন পরদিন, দীর্ঘ কবিতাটি সংক্ষেপ করে৷
২৷ শান্তিদেব ঘোষ— ‘পঁচিশে বৈশাখ (পূরবী কাজে) কবিতাটির হে নূতন দেখা দিক আরবার অংশটি একটু অদল বদল করে সুর যোজনা করলেন৷ … পরের দিন সকালে পুনরায় আমার গলায় শুনে বললেন— ‘হঁ্যা এবার হয়েছে৷’ স্রষ্টা-শিক্ষকের এই অন্তিম অবদান অবিস্মরণীয়৷
সংগীত শিক্ষক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের অন্য শিক্ষককে যে নির্দেশ ও উপদেশ দিয়েছিলেন, তার গুরুত্ব অপরিসীম—রবীন্দ্রসংগীতের মর্মবাণী এখানে বিধৃত৷ বেতারে সংগীত শিক্ষার আসরে রবীন্দ্রগান শেখাবার সানন্দ অনুমতি পঙ্কজকুমার মল্লিক কবির কাছ থেকে পেয়েছিলেন৷ ‘শুধু সেই একটি নির্দেশ, গানের সঙ্গে তবলার ব্যবহার যেন মৃদু হয়, সুরের সঙ্গে মিশে গিয়ে তা যেন সুরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত করে, সুরকে ছাপিয়ে উঠে যেন অতিরিক্ত শব্দবিস্তার না করে’ (পঙ্কজকুমার মল্লিক)৷
গীতালির অন্যতম উদ্যোক্তা প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবিশকে (বুলাবাবু) এক ভাষণে বলেছেন— ‘বুলাবাবু, তোমার কাছে সানুনয় অনুরোধ—এঁদের একটু দরদ দিয়ে, একটু রস দিয়ে জান শিখিয়ো—এইটেই আমার গানে বিশেষত্ব৷ তার উপরে তোমরা যদি স্টিম রোলার চালিয়ে দাও, আমার গান চ্যাপ্টা হয়ে যাবে৷ আমার গানে যাতে একটু রস থাকে, তান থাকে, দরদ থাকে ও মীড় থাকে, তার চেষ্টা তুমি কোরো. (৩০ জুন, ১৯৪০)৷
নিজের শেখানোয় এই প্রাণের স্পর্শ থাকত যা অপরের করা স্বরলিপির কাঠামো দিতে পারে না৷ এই কারণেই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষক-মনন তাঁর সংগীতসত্তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ৷ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘কেন নয়ন আপনি ভেসে যায়’ গানটি তাঁকে কবি শ্যামলী বাড়ির সামনে বসে চার-পাঁচ দিন ধরে শিখিয়েছিলেন৷ ‘এই গান গাইলেই যেন এখনও গুরুদেবের কণ্ঠ শুনতে পাই৷ মনে হয়, সেভাবে গাইতে পারিনি আজও৷’ আন্তরিকতার প্রাণস্পর্শে সার্থক হয়ে ওঠা সেই শিক্ষা তাঁর মনে চিরস্থায়ী হয়েছিল৷ ধন্য শিক্ষাগুরু৷