মোদির ‘বিকশিত ভারত’

সংঘ পরিবার তথা আরএসএস চিলকালই ‘ব্যক্তির উর্ধ্বে সংগঠন’ নীতি মেনেই চলেছে৷ সংগঠনকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে৷ ১৯৯৯ এবং ২০০৪ সালে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে, যেখানে অটলবিহারী বাজপেয়ীর ‘সেই নেতা, যাঁর অপেক্ষায় ভারত’ স্লোগান লেখা কাটআউটগুলি ছেয়ে গিয়েছিল শহর ও গ্রামে, পছন্দ করেনি আরএসএস বাহিনী৷ এখন সেই আরএসএস’ই নীরবে ‘আয়েগা তো মোদি হি’ প্রচারের স্লোগান স্বচ্ছন্দে মেনে নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে৷ তাদের ধারণা, নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় ধারাবাহিক জয় বিশ্বস্ততার সঙ্গে গেরুয়া শিবিরের মূল আদর্শের লক্ষ্য বাস্তবায়িত করবে৷ অটলবিহারী বাজপেয়ীর মতো জোট যুগের প্রধানমন্ত্রীকে নূ্যনতম কর্মসূচির সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছিল৷ সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মোদি সরকার ৩৭০ ধারা বিলোপ, রামমন্দির নির্মাণ এবং এখন ‘অভিন্ন নাগরিক আইন’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়ে এগিয়ে যেতে সচেষ্ট৷

গত শতকের সাতের দশকের মাঝামাঝি কংগ্রেস যখন জনপ্রিয়তার শিখরে, সেই সময় কংগ্রেস সভাপতি দেবকান্ত বড়ুয়া বুক বাজিয়ে বলেছিলেন, ‘ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা এবং ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’৷ আর হালে সেই লক্ষণই ক্রমশঃ প্রকট হয়ে উঠেছে বিজেপির ক্ষেত্রে এবং তা প্রযুক্ত হচ্ছে তাদের নির্বাচনী কর্মসূচিতেও৷
৫৪৩টি আসন, ১০ লক্ষেরও বেশি বুথ, ২৮টি রাজ্য এবং ৪টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিস্তৃত ৯৬ কোটিরও বেশি ভোটার— বিশ্বের এহেন বৃহত্তম গণতন্ত্রে একটি নির্বাচনে লড়াই হচ্ছে কেবল একটিমাত্র নামে, তা হল নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি৷ ক্ষমতাসীন বিজেপির পরিচালনায় ও উৎসাহে ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচন হয়ে উঠেছে সংসদীয় গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে চূড়ান্ত প্রেসিডেন্ট-সুলভ লড়াই৷ কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ বাদ দিলে বাকি প্রতিটি রাজ্যেই একজনই প্রার্থী মূলত, যিনি এই নির্বাচনকে তাঁর নেতৃত্বের উপর গণভোট হিসেবে প্রতিপন্ন করে ফেলেছেন৷

বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহারও লেখা হয়েছে সম্পূর্ণরূপে একজন ব্যক্তিকেই কেন্দ্র করে যাবতীয় প্রতিশ্রুতি বা গ্যারান্টির ফুলঝুড়ি৷ ‘মোদি কি গ্যারান্টি’ এই ক্যাচলাইন ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি-সহ ইস্তাহারের প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে রয়েছে প্রতিশ্রুতির বন্যা৷ বিপুল এক ব্যক্তিত্বের দাপটে বিজেপি দলটি ‘এক জাতি, এক নেতা’ দামামা বাজাতে শুরু করেছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই৷


২০১৪-র নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি যখন প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেন, তা সম্ভব হয়েছিল জনমানসে ‘অচ্ছে দিন’-এর প্রতিশ্রুতির আশ্বাসে৷ ২০১৯-এর নির্বাচনে কাজে লাগানো হল সীমান্ত সমস্যা ও শহিদ জওয়ানদের সেন্টিমেন্টকে ব্যবহারে৷ পুলওয়ামা সন্ত্রাসী হামলা এবং বালাকোট প্রতিক্রিয়াকে ঘিরে এক বৃহত্তর জাতীয়তাবাদী আবেদনের প্রেক্ষাপটে৷

এবারের ভোটেও চাকরি, মুদ্রাস্ফীতি বা আয়-বৈষম্যকে কেন্দ্র করে ইসু্যভিত্তিক নির্বাচন করার কোনও লক্ষণ নেই৷ গত দশ বছরের সাফল্য ও ব্যর্থতা নিয়ে তর্ক তো কল্পনাতীত৷ এমনকি, হিন্দুত্ববাদও মূল বিজেপি ভোটারদের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ ‘বিকশিত ভারত’ প্রচারের মধ্য দিয়ে জনমনসে এমন একটা বিশ্বাস গেঁথে দেওয়া হয়েছে যে, কেবলমাত্র একজন নেতাই পারবেন ভারতকে ‘সুন্দর ভবিষ্যৎ’ দেখাতে৷

বিজেপির সাংসদ প্রার্থীরা এখন হয়ে উঠেছেন মুখবিহীন, অস্তিত্বহীন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা ফরমান জারির বিশ্বস্ত বাস্তবায়নকারী কর্মী, আমলারা হয়ে উঠেছেন কর্তব্যপরায়ণ ‘জো হুজুর’ সেবক৷ মিডিয়া হয়ে উঠেছে তোষামোদের মঞ্চ৷ ফলত, নির্বাচন হয়ে দাঁড়িয়েছে মোদি এবং এককভাবে মোদিরই ক্ষমতায় ফিরে আসার মহান আয়োজন৷

মোদি তাঁর ক্ষমতায় থাকার স্থায়ীত্বকালেরও আভাস দিয়েছেন প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে৷ ২০৩৬ সালে দেশে অলিম্পিক গেমসের আয়োজন এবং ২০৪৭ সালে স্বাধীন ভারতের অমৃতকালের সূচনার মাধ্যমে ‘মোদি-যুগ’ আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে ইতিহাসের পাতার মোগল-যুগ, কুষাণ-যুগের কথা৷ বৈচিত্র্যময় বহুদলীয় গণতন্ত্রে এমন স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব আগে কখনও দেখা যায়নি৷ বর্তমান ইঙ্গিত দিচ্ছে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে৷ তবে ইতিহাসে জনগণই পারে ভবিতব্যকে বদলে দিতে৷ ঈষান কোণের সেই মেঘ অবশ্য নজরে পড়ছে না গেরুয়া শিবির বা মোদিজির৷