ভোটপ্রচার শেষ করে কন্যাকুমারী গিয়ে ধ্যানে বসার পরই মোদির কাছে খবর এল, দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধির হার শেষ ত্রৈমাসিকে দাঁড়িয়েছে ৮.২ শতাংশ৷ সঙ্গে সঙ্গে ধ্যানের মধ্যেই ‘এক্স’ হ্যান্ডলে পোস্ট করে মোদি লিখলেন, ‘আগেই বলেছিলাম, এ তো সবে ট্রেলার দেখছেন৷ আসল ছবি বাকি আছে৷’ বোঝালেন অর্থনীতির বিপুল বিকাশের ছবি ক্রমশ প্রকাশ্য৷
তবে মোদির এই ‘বিপুল সম্ভাবনাময়’ অর্থনীতির ঠিক বিপরীত চিত্র তুলে ধরে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বার্ষিক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, দেশে বেকারি বেড়ে চলার কারণে আয় কমে গিয়ে পরিবারের সঞ্চয় বিপুল হারে কমেছে৷ একই সঙ্গে পরিবার পিছু ঋণের বোঝাও বেড়েছে বিপুল হারে৷ ইউপিএ আমলের সঙ্গে তুলনা টেনে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দেখিয়েছে, মোদির এক দশকেই পরিবার পিছু সঞ্চয় কমে ঋণের বোঝা বেড়েছে৷ সুতরাং মোদি-কথিত ‘ট্রেলার’ ভবিষ্যতে কী দেখাতে চলেছে তা বুঝিয়ে দিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, বলছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা৷
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বার্ষিক রিপোর্ট দেশে অর্থনীতির দারিদ্রপীড়িত ঋণগ্রস্ত পরিস্থিতির কথাই তুলে ধরেছে, যা বিকাশমান অর্থনীতি নয়, বরং ধসে পড়তে থাকা অর্থনীতির বেহাল দশা বলেই জানাচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা৷ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০২২-২৩ সালে দেশে পারিবারিক সঞ্চয় হার কমেছে ৫.৩ শতাংশ হারে৷ এটি একটি রেকর্ড৷ এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় খরচের পর বেঁচে যাওয়া উদ্বৃত্ত অর্থ জমিয়ে রাখে পরিবারগুলি৷ কিন্ত্ত বাস্তবে পরিবারের হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ না থাকায় সঞ্চয়ের হার কমেছে৷ বরং আয় কমে যাওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ চালাতে বাড়ছে ঋণ৷ রিপোর্ট জানাচ্ছে এই সময়ে পরিবারের ঋণের হার বেড়েছে ৫.৭ শতাংশ হারে৷ মোদি জমানায় গত এক দশক ধরে পরিবারের সঞ্চয়ের হারে বৃদ্ধি ঘটেনি৷ তা ৭.৫ শতাংশে আটকে ছিল৷ গত ২০২১-২২ সালে সেই হার কমে হয়, ৭.২ শতাংশ৷ পরের বছর ২০২২-২৩ সালে সর্বকালীন রেকর্ড হার কমে হয়ে যায় ৫.২ শতাংশ৷
পরিবারের ঋণের হার বেড়ে চলার প্রবণতা উল্লেখ করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানাচ্ছে, ইউপিএ আমলে ২০১৪-১৫ সালে পরিবারের ঋণের হার ছিল ২.৭ শতাংশ৷ গত এক দশকের মোদি জমানায় তা বেড়ে হয় ৩.৪ শতাংশ৷ ২০২৩-২৪ সালে তা রেকর্ড হারে বেড়ে হয়েছে ৫.৭ শতাংশ৷ রিপোর্টে বলা হয়েছে, পরিবারের সঞ্চয়ের হার কমে যাওয়া এবং একই সঙ্গে পরিবারের ঋণ বেড়ে চলেছে সেই সময়ে যখন দেশে বেকারি চরম হারে বেড়েছে৷ মানুষের আয় কমেছে, বেতম কমেছে৷ নিয়োগ কমে কলকারখানায় ছাঁটাই চলায় পরিবারের আয় বিপুল হারে কমে চলেছে৷
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) তার রিপোর্টে জানিয়েছে, ভারতে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা মোদি জমানায় বিপুল হারে বেড়েছে৷ যেখানে ২০০০ সালে শিক্ষিত বেকারের হার ছিল ৫৪.২ শতাংশ, ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৬৫.৭ শতাংশ৷ ভারতে নিরক্ষরের ক্ষেত্রে বেকারির হার ৩.৪ শতাংশ৷ সেখানে স্নাতকের ক্ষেত্রে বেকারির হার হল তার ন’গুণ বা ২৯.১ শতাংশ৷ এদিকে ভারতের শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়া নিয়ে আইএলও রিপোর্ট জানাচ্ছে, গত ২০১২ থেকে ২০২২ সাল এই দশ বছরে যাঁরা নিয়মিত বেতন পান, তাঁদের আয় প্রতি বছর ১ শতাংশ হারে কমেছে৷ সরকারি তথ্য উল্লেখ করে আইএলও জানাচ্ছে, নিয়মিত মজুরি মেলে যে শ্রমিকদের, তাঁদের মজুরি ২০১২ সালে ছিল মাসিক ১২ হাজার ১০০ টাকা, তা ২০২২ সালে কমে হয়েছে ১০ হাজার ৯৯৫ টাকা৷
মোদি জমানায় অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের আয় বিপুল হারে কমেছে বলে জানিয়েছে আইএলও রিপোর্ট৷ বলা হয়েছে, মূল্যবৃদ্ধির হার ধরলে কৃষিশ্রমিকের মজুরি ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল এই ১০ বছরে প্রতি বছরে ১.৩ শতাংশ হারে কমেছে৷ কেন্দ্রের কৃষিমন্ত্রক সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল ইউপিএ আমলে কৃষিশ্রমিকের মজুরি কমেনি, উল্টে বেড়েছিল৷ সেই মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৮ শতাংশ৷ অসংগঠিত ক্ষেত্রের বড় অংশ কাজ করেন ইটভাটায়৷ গত ১০ বছরে তাঁদের মজুরি বাড়েনি, একই রয়েছে৷ এইভাবে মজুরি, আয়, সঞ্চয় কমেছে৷ পরিবারে বেড়েছে শুধু ঋণ৷