মোদি-শাহের অতিমাত্রায় শুভেন্দু-নির্ভরতা, বিজেপিকে বড় মাশুল দিতে হবে না তো?

পুলক মিত্র

লোকসভা ভোটের প্রচার জোরকদমে শুরু হয়ে গিয়েছে৷ সব শিবিরের নেতারাই এখন প্রচার ময়দানে৷ তবে এই প্রচার যুদ্ধের মাঝেই নজর কেড়েছে এই রাজ্যে বিজেপির ঘরোয়া কোন্দল৷ প্রায় প্রতিদিনই প্রার্থী বাছাই নিয়ে বিজেপি কর্মীদের আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে৷ এই ক্ষোভ এখন আর দলের অন্দরমহলে সীমাবদ্ধ নেই৷ ইতিমধ্যে একাধিক জায়গায় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে পোস্টারও পড়ে গিয়েছে৷

বিজেপির বিক্ষুব্ধ শিবিরের অভিযোগ, দলের পুরনো নেতাদের বঞ্চিত করে নিজের পছন্দের লোকজনদেরই প্রার্থী করেছেন শুভেন্দু৷ এটা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট৷ প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে শুভেন্দু অধিকারীকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, জে পি নাড্ডারা৷ সেই অর্থে দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার তেমন কোনও গুরুত্বই পাননি৷ প্রার্থী বাছাই পর্বে দিল্লিতে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে৷ সেখানে শুভেন্দুর পাশাপাশি দলের রাজ্য সভাপতি হিসেবে ডাক পেয়েছিলেন সুকান্তও৷ কিন্ত্ত ওই পর্যন্তই৷ প্রার্থীদের নাম চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে সুকান্তর কোনও ভূমিকাই ছিল না৷ কার্যত একতরফাভাবেই শুভেন্দুর পছন্দের প্রার্থীদেরই অগ্রাধিকার দিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব৷


একনজরে প্রার্থী তালিকায় চোখ বোলালেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে৷ উত্তরবঙ্গ দিয়েই শুরু করা যাক৷ গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গ থেকেই বেশি সংখ্যক প্রার্থী জিতেছিলেন৷ তাই এবার উত্তরবঙ্গে খুব একটা বদল করা হয়নি৷ তবে আলিপুরদুয়ার এবং রায়গঞ্জের দুই প্রার্থীকে বদল করা হয়েছে৷ কোচবিহার থেকে জিতেছিলেন জন বার্লা৷ তিনি কেন্দ্রে মন্ত্রীও হয়েছিলেন৷ এবার তাঁকে টিকিটই দেওয়া হয়নি৷ এই কেন্দ্রে এবার প্রার্থী করা হয়েছে মাদারিহাটের দুই বারের বিধায়ক, রাজ্য বিধানসভায় বিজেপির পরিষদীয় দলের মুখ্য সচেতক মনোজ টিগ্গাকে৷ ‘আদি’ বিজেপি হলেও বিধানসভায় শুভেন্দুর কাছের লোক হিসেবেই টিগ্গার পরিচিতি৷

অন্যদিকে, রায়গঞ্জে গতবারের জয়ী প্রার্থী দেবশ্রী চৌধুরীকে দক্ষিণ কলকাতায় দাঁড় করানো হয়েছে৷ আর রায়গঞ্জে প্রার্থী হয়েছেন কার্তিক পাল৷ তিনিও শুভেন্দু-ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত৷
এবার আসা যাক, শুভেন্দুর প্রভাব থাকা দুই মেদিনীপুরে৷ পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথিতে নিজের ভাই সৌমেন্দু অধিকারীকে প্রার্থী করেছেন৷ তমলুকে আর এক ভাই দিব্যেন্দুর ছেডে় দেওয়া আসনে প্রার্থী করেছেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে৷

পশ্চিম মেদিনীপুরের দু’টি আসন হল, ঘাটাল ও মেদিনীপুর৷ ঘাটালে প্রার্থী হয়েছেন খড়্গপুর সদরের বিধায়ক হিরণ চট্টোপাধ্যায়৷ গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে শুভেন্দুর সঙ্গে যাঁরা বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন এই হিরণও৷

বিজেপির ঘরোয়া রাজনীতিতে দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের সঙ্গে শুভেন্দুর সাপে নেউলের সম্পর্ক৷ বলতে গেলে, দুজনের কেউ একে অন্যের মুখদর্শনও করতে চান না৷ রাজ্যে বর্তমানে বিজেপির শক্তি বৃদ্ধির পিছনে যাঁকে মূল কাণ্ডারি বলে মনে করা হয়, এবার সেই দিলীপ ঘোষকে তাঁর গতবারের জেতা আসন মেদিনীপুর থেকে সরিয়ে দিয়েছেন শুভেন্দু৷ এটা শুভেন্দুর সবচেয়ে বড় জয় বলে মনে করছেন তাঁর অনুগামীরা৷ প্রথমে প্রাক্তন আইপিএস ভারতী ঘোষকে প্রার্থী করতে চেয়েছিলেন শুভেন্দু৷ কিন্ত্ত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তাতে সায় না মেলায় শেষে প্রার্থী করা হয় শুভেন্দু ঘনিষ্ঠ আসানসোল দক্ষিণের বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালকে৷ যদিও শুভেন্দুর আগেই বিজেপিতে এসেছিলেন অগ্নিমিত্রা, তবুও তিনি বিরোধী দলনেতার ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত৷

বেশ কয়েকজন বিধায়ককে এবার লোকসভায় প্রার্থী করেছে বিজেপি৷ এঁদের মধ্যে মনোজ, হিরণ, অগ্নিমিত্রার পাশাপাশি রয়েছেন, বনগাঁ দক্ষিণের বিধায়ক স্বপন মজুমদারও৷ স্বপনকে প্রার্থী করা হয়েছে বারাসতে৷

বস্তুত কলকাতা সহ গোটা দক্ষিণবঙ্গে নিজের পছন্দের প্রার্থীদের টিকিট পাইয়ে দিতে সফল হয়েছেন শুভেন্দু৷ লোকসভা ভোটের মুখে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন তাপস রায়৷ তাঁকে প্রার্থী করা হয়েছে কলকাতা উত্তরে৷ দমদমে শীলভদ্র দত্ত এবং ব্যারাকপুরে অর্জুন সিংকে টিকিট দেওয়া হয়েছে৷ দুজনই শুভেন্দুর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের লোক হিসেবে পরিচিত৷ সন্দেশখালির ‘প্রতিবাদী’ বধূ রেখা পাত্রকে প্রার্থী করা হয়েছে বসিরহাটে৷ রেখা যে প্রার্থী হতে পারেন, তার বিন্দুমাত্র আঁচ পাননি রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতারাও৷ তাঁর নাম পুরোপুরি গোপন রাখা হয়েছিল৷ এক্ষেত্রেও শেষ পর্যন্ত বাজিমাত করেছেন শুভেন্দুই৷
মালদহ দক্ষিণে প্রার্থী হয়েছেন ইংরেজবাজারের বিধায়ক শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরী৷ ২০১৯ সালেও তিনি ওই আসন থেকে প্রার্থী হলেও জিততে পারেননি৷

মুর্শিদাবাদে স্থানীয় বিধায়ক গৌরীশঙ্কর ঘোষ এবং বর্ধমান পূর্বে হরিণঘাটার বিধায়ক অসীম সরকারকে প্রার্থী করা হয়েছে শুভেন্দুর প্রস্তাব মেনেই৷ সেইসঙ্গে বহরমপুরে নির্মল সাহা, হাওড়ায় রথীন চক্রবর্তী, বোলপুরে পিয়া সাহাকে প্রার্থী করার পিছনে শুভেন্দুর বড় ভূমিকা ছিল বলে বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে৷
প্রথম দফায় ২০টি এবং দ্বিতীয় দফায় ১৯টি আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে বিজেপি৷ এই ৩৯ জন প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে সুকান্ত মজুমদারের সেই অর্থে বড় কোনও ভূমিকা ছিল না৷ বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, দিলীপকে একসময় প্রার্থী না করার সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল৷ কিন্ত্ত সুকান্তর চাপাচাপিতেই শেষ পর্যন্ত তাঁকে দুর্গাপুরে প্রার্থী করা হয়৷

১৯ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট৷ প্রচার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলেও, এখনও বাংলার ডায়মন্ডহারবার, বীরভূম, ঝাড়গ্রামের প্রার্থীদের নাম চূড়ায় করতে পারেনি বিজেপি৷ আসানসোলের প্রার্থী হতে রাজি হননি ভোজপুরী গায়ক, অভিনেতা পবন সিং৷ তাঁর বদলে কে প্রার্থী হবেন, তাও চূড়ান্ত হয়নি৷

তবে প্রশ্ন হল, প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মোদি-শাহরা যেভাবে শুভেন্দুকে গুরুত্ব দিয়েছেন, তা আগামী দিনে বাংলায় বিজেপিকে বড় বিড়ম্বনার মুখে ঠেলে দেবে না তো? দলের পুরনো নেতাদের কোণঠাসা করে নিজের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে শুভেন্দুর মরিয়া মনোভাব বু্যমেরাং হয়ে দেখা দেবে না তো? রাজ্য বিজেপির অন্দরে এই প্রশ্নগুলো ঘোরাফেরা করছে৷ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে গতবারের চেয়ে ভালো ফল করলে, শুভেন্দুর এই একাধিপত্য আরও বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য৷ কিন্ত্ত ব্যর্থ হলে, তাঁকে আদি বিজেপির নেতা-কর্মীদের আক্রমণের মুখে পড়তে হবে, এটা নির্দ্বিধায় বলাই যায়৷