যেখানে মোদি প্রচার করেছেন, সেখানেই বিজেপির ভরাডুবি, বলছে তথ্য
নিজস্ব প্রতিনিধি– সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে দুর্দান্ত ফল করেছে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’। ২৩২টি আসন জিতে এনডিএ জোটের শক্তিশালী বিরোধীর স্থান দখল করেছে ইন্ডিয়া জোট। বুথ ফেরত সমীক্ষাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বাংলায় ভোটের ফলাফলের দিকে নজির গড়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। ইন্ডিয়া জোটে সর্বাধিক আসন জয়ী দল হল সমাজবাদী পার্টি। তারপরেই রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তবে অবাক করা বিষয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং যে লোকসভা কেন্দ্রগুলিতে নির্বাচনী প্রচার করেছিলেন, সেখানেই ভরাডুবি হয়েছে বিজেপির।
এবারে বাংলায় মোট ২৪টি নির্বাচনী কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন মোদি। তার মধ্যে ২৩টি জনসভা এবং একটি রোড শো। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, রায়গঞ্জ, বালুরঘাট, মালদা উত্তর কেন্দ্রে মোদি সভা করেছিলেন। ওদিকে দক্ষিণবঙ্গের বর্ধমান-দুর্গাপুর, কৃষ্ণনগর, বোলপুর, হাওড়া, আরামবাগ, হুগলি, ব্যারাকপুর, বারাসত, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, বিষ্ণুপুর, যাদবপুর এবং মথুরাপুর কেন্দ্রে সভা করেন মোদি। আবার, শেষ দফার নির্বাচনের আগে শেষবারের মতো কলকাতায় এসে প্রথমবার রোড শো করেছিলেন সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী। তবে ইভিএম খুলতেই একের পর এক মোদির ব্যর্থতার চিত্র ধরা পড়ল। দেখা গেল, দক্ষিণের মধ্যে শুধু পুরুলিয়া এবং বিষ্ণুপুরে বিজেপি তাঁদের আসন ধরে রাখতে পেরেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যেখানে যেখানে প্রচার করে গিয়েছিলেন, তার একটা বা দুটো আসন বাদে বাকি কোনওটাতেই বিজেপি জিততে পারেনি। বরং সেইসব কেন্দ্রগুলিতেই বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে তৃণমূল। সব মিলিয়ে প্রচারের নিরিখে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মসূচি এই বাংলাতেই করেছিলেন মোদি। বিজেপি গতবার এই রাজ্যে যেখানে ১৮টি আসনে জিতেছিল, এবার সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ১২-তে।
অন্যদিকে, দেশের মধ্যে যে রাজ্যে মোদী সব থেকে বেশি নির্বাচনী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন, সেটি হল উত্তরপ্রদেশ। এই রাজ্য থেকে দেশের সংসদে ৮০ জন সাংসদ নির্বাচিত হন। এখান থেকে মোদি নিজেও ভোটে লড়েন। এই আবহে উত্তরপ্রদেশে মোদি ৩১টি নির্বাচনী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানেও বিজেপির চূড়ান্ত ভরাডুবি! গতবারের তুলনায় এখানে বিজেপির জেতা আসন সংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। গতবার উত্তরপ্রদেশে গেরুয়া শিবিরের জেতা আসন সংখ্যা ছিল ৬২টি। এবার সেখানে ৩৩-এ নেমে গিয়েছে।
এদিকে মোদির প্রচার কর্মসূচির নিরিখে চতুর্থ স্থানে ছিল মহারাষ্ট্র। এই রাজ্যে তিনি ১৯টি নির্বাচনী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানেও বিজেপির শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। এবারে সেখানে বিজেপি-র প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ২৩ থেকে নেমে ৯ হয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বিজেপির এই ভরাডুবি তাঁদের কাছে ‘আউট অফ সিলেবাস’। অথচ বাংলায় নির্বাচনী প্রচারে এসে মোদী-শাহ দাবি করেছিলেন, “৩০টি আসন দিলেই এই দিদির সরকার ফুস্ হয়ে যাবে!” ঘটলো উল্টোটাই। ৩০ এর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেল রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলই। খুব কষ্টে ‘ডবল ডিজিট’-এর আসন পেল বিজেপি।
মোদির নেতৃত্বে তৃতীয়বার সরকার গঠনের দোড়গোড়ায় থাকলেও এবারে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির সিংহাসন পুনরায় নরেন্দ্র মোদিকে দিয়েছে বটে! তবে সরকার চালাতে প্রতি মুহূর্তে তাঁকে একটি শক্তিশালী বিরোধী জোটের মোকাবিলা করতে হবে। ৪০০ পারের দাবি করেছিল বিজেপি। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় সর্বদাই বলে এসেছেন, “৪০০ পার নয়, হবে পগার পার!” বাস্তবেও যেন তাই হল। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়, “কখনও ক্ষমতার আস্ফালন দেখাতে নেই। কখনও মানুষের ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করতে নেই। জনতাই কিংমেকার। প্রধানমন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী, সাংসদ থেকে বিধায়ক নির্বাচন করেন আমজনতাই। সাধারণ মানুষ যতদিন চাইবে, ততদিনই রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকবে।”
অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন থেকে সিএএ কার্যকর হওয়ার মতো ঘটনা, তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা নানা দুর্নীতির অভিযোগ ও তদন্ত, সন্দেশখালির ঘটনা রাজ্যে পদ্মের জমি আরও মজবুত করবে বলেই অঙ্ক কষেছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বরা। তাতে ভর করেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কমপক্ষে ৩০ আসন জয়ের লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও একই অঙ্কে ভরসা রেখে বাংলায় দল সবচেয়ে ভাল ফল করবে বলে দাবি করেছিলেন। বিভিন্ন বুথ ফেরত সমীক্ষা দেখার পরে আরও আশাবাদী হয়ে ওঠা বিজেপির স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে ৪ জুন, মঙ্গলবার। আর গণনা চলতে চলতেই শুরু হয়ে যায় হারের ‘দায়’ চাপানোর পালা। ফলপ্রকাশের পরদিন তা আরও জোরালো হয়। বিজেপি প্রশ্ন তুলতে শুরু করে, নির্বাচন কমিশন থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে। বিজেপি-র অন্দরে এখন অনেক আলোচনা। সেই আলোচনায় সকলেই অপরপক্ষকে কাঠগড়ায় তুলছেন। আবার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ত্রুটিও দেখাচ্ছেন অনেকে। তাহলে কি বঙ্গে শক্তিশালী বিজেপি নেতার অভাব? এই প্রশ্নই উঠেছে। যদি তাই হয়, তাহলে প্রাক্তন রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি দিলীপ ঘোষের জেতা আসন থেকে কেন অন্য বিজেপি প্রার্থীকে দাঁড় করানো হল? সেই সমালোচনাও চলছে সমানতালে। দলের একটা অংশ হারের অনেকটা ‘দায়’ বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর উপরে চাপাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কেন শুভেন্দুর কথার উপরে বেশি ভরসা করেছেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে বিজেপি-র অন্দরে। বিজেপি-র হারের পর আক্ষেপের সুর বঙ্গীয় বিজেপি নেতৃত্বদের কণ্ঠে।