মোদি ম্যাজিকে ধস, সরকার গড়ার পথে এনডিএ

দিল্লি, ৪ জুন— ফের একবার কেন্দ্রে বিজেপি তথা এনডিএ জোট ক্ষমতায় এলেও তাকে জোর ধাক্কা দিয়েছে বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোট৷ সন্ধে ৬টা পর্যন্ত খবরে দেখা যাচ্ছে, সারা দেশে এনডিএ ২৯১টি আসন পেলেও ২৩৪টি আসন পেয়ে তাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট৷ মোদির নেতৃত্বে লোকসভা নির্বাচনের লড়াইয়ে এনডিএ-র প্রাচীরে যে ‘ইন্ডিয়া’ জোট চিড় ধরাতে পেরেছে, তা দেখালো মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীর, মণিপুর সহ একাধিক রাজ্যের বিরোধী শিবির৷ তবে লোকসভায় শেষ পর্যন্ত জয়ের হ্যাট্রিক করতে চলেছে এনডিএ জোটই৷

আজ ভোটগণনা পর্ব এগোতেই অন্ধ্রের চন্দ্রবাবু নাইডু এবং বিহারের নীতীশ কুমারের সঙ্গে কথা বলেছেন নরেন্দ্র মোদির সেনাপতি অমিত শাহ৷ কথা বলেছেন জিতনরাম মাঝির সঙ্গেও৷ এসবের মধ্যেই মঙ্গলবার দুপুরে বিজেপি-র সভাপতি জে পি নাড্ডার বাড়িতে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসল পদ্ম শিবিরের শীর্ষ নেতৃত্ব৷ এই এনডিএ জোটের বৈঠকেই কী কী বিষয় উঠে এলো, সেদিকেই নজর থাকছে রাজনৈতিক মহলের৷

তবে নরেন্দ্র মোদির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বিরোধী শিবিরের অন্যতম প্রধান মুখ, কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গান্ধি দেখিয়ে দিয়েছেন, মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেই কীভাবে সফলতা আসতে পারে৷ নানান ব্যঙ্গবিদ্রূপ, আইন-আদালত করেও রাহুলকে থামিয়ে রাখতে পারেনি মোদি শিবির৷ রায়বেরিলি ফের একবার ফিরিয়ে আনল নেহরু-ইন্দিরা-সোনিয়া গান্ধির জয়ের স্মৃতি৷ ওই কেন্দ্র থেকেই ফের জয় ছিনিয়ে আনলেন রাহুল৷ শুধু জিতলেনই না, রাহুল চার লক্ষেরও বেশি রেকর্ড ভোটের ব্যবধানে হারালেন বিজেপির দীনেশপ্রতাপ সিংকে৷ মা সোনিয়া গান্ধির দেড় লক্ষেরও বেশি ভোটে জেতা রেকর্ড ভেঙেছেন রাহুল৷ যে রাহুলকে ঠেকাতে বার বার ‘পাপ্পু’ বলে কটাক্ষ করেছেন বিজেপির শীর্ষ নেতারা, কংগ্রেসকে দেশছাড়া করার হুমকি দিয়েছে, সেই সঙ্গে ‘৪০০ পার’-এর স্লোগান দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি, সেই বিজেপিকেই উত্তরপ্রদেশে তুমুল ধাক্কা দিয়ে জয়ের মুকুট পরলেন রাহুল৷ প্রায় সমস্ত বুথফেরত সমীক্ষাকে সম্পূর্ণ উল্টে দিয়েছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট৷ ২০১৪ এবং ২০১৯-এর ব্যর্থতার পর এবার ১০০-রও বেশি আসনে জয় পেতে চলেছে কংগ্রেস৷ অন্যদিকে ২২৭টি আসনে এগিয়ে রয়েছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট৷


এবারের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে উত্তরপ্রদেশে মুখ থুবড়ে পড়েছে বিজেপি৷ সমাজবাদী পার্টি এবং কংগ্রেস জোট যোগী রাজ্যে এগিয়ে রয়েছে এনডিএ-র থেকে৷ এবছরের শুরুতেই মহাসমারোহে রামমন্দিরের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ রামমন্দির নির্মাণকেই হাতিয়ার করে উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনী ঝড় তুলতে চেয়েছিল পদ্ম শিবির৷ কিন্ত্ত অযোধ্যার রামমন্দির যে লোকসভা আসনের মধ্যে পড়ে, সেই ফৈজাবাদেই হেরে গেছেন বিজেপি প্রার্থী৷ এই কেন্দ্রে বিজেপির হার নিঃসন্দেহে বড় ধাক্কা৷ ধাক্কা খেয়েছে ‘মোদি ম্যাজিক’ও৷ শুধু ফৈজাবাদই নয়, গোটা উত্তরপ্রদেশেই বিপর্যয় নেমেছে বিজেপির৷ ২০১৯ সালে যেখানে বিজেপি জিতেছিল ৬২টি আসনে, সেখানে এবার মাত্র ৩৫ আসনে এগিয়ে আছে গেরুয়া শিবির৷ আর সমাজবাদী পার্টি এগিয়ে ৩৪ আসনে এবং কংগ্রেস এগিয়ে ৭টি আসনে৷ অর্থাৎ ‘ইন্ডিয়া’ জোট এগিয়ে ৪৩টি আসনে৷

অন্যদিকে, মহারাষ্ট্রে দল ভাঙানোর ফল হাতেনাতে পেল বিজেপি— এমনটাই বলছে শিবসেনা৷ মহারাষ্ট্রে ‘ইন্ডিয়া’ জোট মোট আসনের হিসেবে ঢের এগিয়ে৷ সেখানে ১০টি আসনে এগিয়ে বিজেপি আর উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা পেয়েছে ১৩টি আসন৷

প্রসঙ্গত, শিবসেনা ভেঙে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন একনাথ শিন্ডে৷ উদ্ধব ঠাকরের কাছ থেকে আসল শিবসেনার প্রতীকও কেড়ে নিয়েছেন তিনি৷ তার মাসখানেক পরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি)-র সঙ্গেও৷ অজিত পাওয়ার যোগ দেন বিজেপি-শিবসেনা সরকারে৷ ভেঙে যায় শরদ পাওয়ারের এনসিপি৷ প্রতীকও খোয়াতে হয় তাঁকে৷ কিন্ত্ত এখন আসল-নকলের এই খেলায় ওই দল ভাঙা নেতারাই পর্যুদস্ত এই ভোটের লড়াইয়ে৷ পিছিয়ে পড়েছে একনাথ শিন্ডের শিবসেনা ও অজিত পাওয়ারের এনসিপি৷
একের পৃষ্ঠার পর

মণিপুরেও শেষ হাসি হাসল কংগ্রেস৷ জাতিসংঘাতে দীর্ণ মণিপুর নাকচ করেছে বিজেপিকে৷ এখানে দু’টি আসনেই জয়ী কংগ্রেস৷ মেঘালয়ের দু’টি সিটের মধ্যেই তুরা আসনে জয়ী হয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী সালেং এ সাংমা৷ পরাজিত এনপিপি দলের প্রার্থী তথা রাজ্যের শাসক দলের বিদায়ী সাংসদ আগাথা সাংমা৷ নাগাল্যান্ডে একমাত্র আসনেও জয়ী কংগ্রেস প্রার্থী সুপংমেরং জামির৷ মিজোরামের একমাত্র আসন দখল করতে চলেছে সদ্যভূমিষ্ঠ আঞ্চলিক দল জোরাম পিপলস মুভমেন্ট৷ তবে অরুণাচল প্রদেশ এবং ত্রিপুরাতে দু’টি করে আসনেই জয়ী বিজেপি৷ অসমের ১৪টির মধ্যে আটটি আসনে এগিয়ে পদ্মশিবির৷ তিনটি কংগ্রেসের পক্ষে৷ জোড়হাট আসনে মজবুত অবস্থানে রয়েছেন কংগ্রেসের গৌরব গগৈ৷ কেরলে ২০টি আসনের মধ্যেই কংগ্রেস পেয়েছে ১৪টি, বিজেপির দখলে মাত্র একটি৷ তামিলনাড়ুতে ৩৯টি আসনের দৌড়ে বিজেপি শূন্য৷ অন্ধ্রপ্রদেশে টিডিপি প্রধান চন্দ্রবাবু নাইডু সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় এদিন বিকেলে অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জগনমোহন রেড্ডি পদত্যাগ করেন৷ আগামী ৯ জুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন চন্দ্রবাবু নাইডু৷

জম্মু-কাশ্মীরে পরাজিত দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা এবং মেহবুবা মুফতি৷ বারমুলাতে নির্দল প্রার্থী তথা প্রাক্তন বিধায়ক আবদুল রশিদ ওমর আবদুল্লার চেয়ে এগিয়ে প্রায় ১ লক্ষ ৯৮ হাজারেরও বেশি ভোটে৷ বর্তমানে ইউএপিএ মামলায় তিহাড় জেলে বন্দি আছেন আবদুল রশিদ৷ অন্যদিকে, অনন্তনাগ-রাজৌরিতে ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রার্থী মিয়াঁ আলতাফ আহমেদের চেয়ে ২ লক্ষ ৭৯ হাজার ভোটে পিছিয়ে মেহবুবা মুফতি৷ জম্মু-কাশ্মীরের পাঁচটি লোকসভা আসনের মধ্যে দু’টিতে এগিয়ে রয়েছে ন্যাশনাল কনফারেন্স দল, দু’টিতে এগিয়ে বিজেপি আর একটিতে নির্দল প্রার্থী৷

বিহারে বর্তমানে এনডিএ বন্ধু নীতীশ কুমার৷ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল যত স্পষ্ট হচ্ছে, ততই গুরুত্ব বাড়ছে নীতীশের৷ এখানে এনডিএ-তে কড়া টক্কর দিচ্ছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট৷ শোনা যাচ্ছে, নীতীশ কুমারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট৷ সূত্রের খবর, নীতীশ কুমারকে নাকি ফোন করেছেন শরদ পাওয়ার৷ অন্যদিকে তাঁকে ফোন করেছেন বিহারে বিজেপি সভাপতি সম্রাট চৌধুরিও৷ তিনি এনডিএ জোটে থাকবেন, নাকি ইন্ডিয়া জোটে আবার ফিরবেন সেটা এখন দেখার৷ তবে নীতীশ কুমারের লক্ষ্য যে প্রধানমন্ত্রীর পদ, তা চাপা থাকেনি জেডিইউ বিধান পরিষদের সদস্য ড. খালিদ আনোয়ারের কথায়৷ তিনি বলেছেন, ‘নীতীশ কুমারের চেয়ে ভালো প্রধানমন্ত্রী আর কে হতে পারেন?’