মমতার ১০৭, অভিষেকের ৭২, শুভেন্দুর ১৭৪
দেবাশিস দাস: মার্চের ৩১ তারিখ কৃষ্ণনগরের ধুবুলিয়ায় দলীয় প্রার্থী মহুয়া মৈত্রের সমর্থনে প্রথম জনসভায় অংশ নিয়েছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ৩০ মে শেষ দফার প্রচারে মমতার পাশে দেখা গেল সেই মহুয়া মৈত্রকে৷ তবে এবার অবশ্য মহুয়া মৈত্রর সমর্থনে নয়, সায়নী ঘোষ এবং মালা রায়ের হয়ে নির্বাচনী প্রচার সারলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ সাত দফায় নির্বাচন চলছে দেশজুড়ে৷ দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনী প্রচারে থাকতে হয়েছে নেতানেত্রীদের৷ মমতাও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী নন৷ তিনি একা হাতে তৃণমূল কংগ্রেসকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন৷ তাঁর জনপ্রিয়তাকে রুখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিরোধী দলগুলিকে৷ নির্বাচনী প্রচার কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্র থেকে শুরু করে মমতা চলে যান উত্তরবঙ্গে৷ কারণ প্রথম দফার নির্বাচন ছিল উত্তরবঙ্গে৷ সেখানে জনসভা করার পাশাপাশি রোড শো করতে তাঁকে যেতে হয় দক্ষিণবঙ্গে৷ এর মধ্যে ছিল ১লা বৈশাখ৷ সেকারণে তিনি কলকাতায় ফিরেছিলেন৷ এই ক্ষণিকের বিরতিটুকু ছাড়া তিনি নিজেকে নির্বাচনী প্রচারে সর্বদা ব্যস্ত রেখেছেন৷ সেই সঙ্গে খুঁটিনাটি খবর নিয়েছেন দলের হালহকিকতের৷ অসমেও জনসভা করেছেন তিনি দলীয় প্রার্থীদের সমর্থনে৷
‘এত লাঞ্ছনা, এত গঞ্জনা, এত কুৎসার ঢেউ৷ তবুও তুমি একাই দুশো৷ রুখতে পারেনি কেউ৷’ ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে মোদি-অমিত শাহকে রুখে দিয়ে তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তাঁর এই জয়কে উদযাপন করতে গিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় উপরোক্ত শব্দবন্ধকে সামনে রেখে কুর্নিশ জানানো হয়েছিল তৃণমূল সুপ্রিমোকে৷ তাঁর জনপ্রিয়তা এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেনাপতিত্বে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও বিপুল সাফল্য লাভ করেছিল রাজ্যের শাসক দল৷ এবারের লোকসভা নির্বাচনে সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে নির্বাচনী প্রচারে নামে রাজ্যের শাসক দল৷ এর পাশাপাশি, লোকসভা কেন্দ্র ধরে ধরে দলের কোথায় কী ধরনের খামতি রয়েছে, তা পূরণ করার জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ প্রচণ্ড দাবদাহকে উপেক্ষা করে নির্বাচনী প্রচারে নামেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷
মাঝে শারীরিক অসুস্থতা থাকলেও, তা কাউকে বুঝতে না দিয়ে জনসভা এবং রোড শো সব মিলিয়ে ১০৭টি সভা তিনি করেছেন এবারের নির্বাচনকে সামনে রেখে৷ প্রচারে নেমে সেঞ্চুরি তো তিনি করবেন তার আভাস পাওয়াই যাচ্ছিল৷ অবশেষে তিনি থামলেন ১০৭টি সভা এবং রোড শোয়ের পর৷ তৃণমূল কংগ্রেসের তিনিই হলেন মূল চালিকা শক্তি এবং সেই সঙ্গে ক্রাউড পুলার৷ নির্বাচনী প্রচারে মমতার স্ট্রাইক রেট নিঃসন্দেহে নজরকাড়া৷ শুধু নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়াই নয়, দলীয় নেতাদের পরামর্শ দেওয়া, রণকৌশল ঠিক করে দেওয়াতে মমতার জুড়ি মেলা ভার৷ নির্বাচনী জনসভাগুলিতে মঞ্চে ঘুরে ঘুরে তাঁর বক্তব্য রাখার ধরন আমজনতার প্রশংসা কুড়িয়েছে দশকের পর দশক৷ এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷ তবে, গাড়িতে রোড শো করার চেয়ে মমতার সবচেয়ে বেশি পছন্দ পদযাত্রা করে জনসংযোগ৷ শেষ লগ্নের প্রচারে ১২ কিলোমিটার পদযাত্রা করে মমতা বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর পথচলাতেই বেশি আনন্দ৷ বিজেপি যখন সর্বশক্তি উজাড় করে দিচ্ছে এই রাজ্যে ভালো ফল করার জন্য, ঠিক সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই যে রাজ্যের শাসক দলের সবচেয়ে বড় সম্পদ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে ঠিক একই ভাবে ঝোড়ো প্রচার শুরু করেছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো৷ কিন্ত্ত নন্দীগ্রামে চোট পাওয়ার পর তিনি হুইল চেয়ারে করে প্রচারে নামেন৷ দলের অনেকেই ভেবেছিলেন, ১০০-র মধ্যেই হয়তো সীমাবদ্ধ থাকতে পারে নেত্রীর প্রচারে৷ কিন্ত্ত শেষ লগ্নের প্রচারে দেখা যায় দলীয় নেতানেত্রীদের ভুল প্রমাণিত করে তিনি সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন৷
অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় রোড শো এবং জনসভা সব মিলিয়ে ৭২টি নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়েছেন৷ তবে এক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলীয় নেতাদের সঙ্গে অনেক বৈঠক করেছেন সেগুলিকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি৷ দু’জনেই তবে এক্ষেত্রে অভিষেক দলীয় নেতাদের সঙ্গে লোকসভা কেন্দ্র ধরে ধরে জেলায় জেলায় গিয়ে নির্বাচনী বৈঠক করে তাঁদেরকে উজ্জীবিত করেছেন৷ স্বাভাবিকভাবে মমতা এবং অভিষেকের যুগলবন্দি গত বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারের মতোই এবারে আমজনতার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল৷
জনপ্রিয়তায় মমতাকে টেক্কা দেওয়ার জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি বিজেপি৷ লোকসভা নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার আগেই এই রাজ্যকে ঘিরে ব্লুপ্রিন্টের অঙ্গ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি শুরু করেন৷ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা থেকে শুরু করে ত্রিপুরা, রাজস্থান সহ বিজেপি শাসিত বেশ কয়েকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করানোর জন্য নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেন৷ কেন্দ্রের শাসক দল হওয়ার সুবাদে বিজেপির অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা এ রাজ্যের শাসক দলের তুলনায় অনেক বেশি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ বাংলার মানুষের মন পাওয়ার জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি গেরুয়া শিবির৷ দেশজুড়ে মোদি ৭৬ দিন নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন৷ কন্যাকুমারীতে ধ্যানে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ২০৬টি নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন৷ এর মধ্যে রোড শোও রয়েছে৷ এমনকি একেক দিনে পাঁচটিও সভা করেছেন মোদি৷ নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার আগে পশ্চিমবঙ্গে চারটি সভা করেছেন মোদি৷ নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পর আরও ২০টি প্রচার সভায় অংশ নিতে দেখা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে৷ ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদি কাউকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বলে জানা যায়নি৷২০১৯-এ ভোটের আগে শুধুমাত্র বলিউড অভিনেতা অক্ষয় কুমারকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন৷ ২০২৪ সালে মোদির পরিকল্পনা ছিল ১০০টি সাক্ষাৎকার দেওয়ার৷ সেই লক্ষ্যমাত্রায় তিনি পৌঁছেছেন বলে জানা যাচ্ছে৷
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সভা ও রোড শো মিলে ১৭৪টি প্রচার সভায় অংশ নিয়েছেন৷ তবে, এক্ষেত্রে তিনি নিজে ট্রেন এবং গাড়িতে করে প্রচারে গিয়েছিলেন৷ বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র ছাড়াও রাজ্যজুড়ে দলীয় প্রার্থীদের সমর্থনে নির্বাচনী প্রচারে ছিলেন৷
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম তিনি নিজেই প্রার্থী হয়েছিলেন মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে৷ নিজের নির্বাচনী প্রচার ছাড়াও দলীয় প্রার্থীদের হয়ে প্রচার করেছেন পুরোদমে৷ ফুরসত নেওয়ার সময়ই ছিল না তাঁর৷ বিমান বসু, সীতারাম ইয়েচুরি এবং বৃন্দা কারাত, তাঁদেরকেও দেখা গিয়েছে নির্বাচনী প্রচারে৷ ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারও নিয়মিতভাবে এ রাজ্যে প্রচারে এসেছেন৷ তবে সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রতিটি লোকসভা কেন্দ্র ছুঁয়ে গিয়েছেন তিনি৷
অন্যদিকে কাঁথি থেকে কাকদ্বীপ, পাহাড় থেকে জঙ্গলমহল প্রার্থী নির্বাচন এবং প্রচারে রণকৌশল ঠিক করতে অভিষেকের মস্তিষ্কপ্রসূত উদ্ভাবনী ক্ষমতা নিঃসন্দেহে রাজ্যের শাসক দলের কাছে বাড়তি পাওনা৷ সেই সঙ্গে প্রার্থী তালিকায় তরুণ মুখের পাশাপাশি ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠানের অন্তর্ভুক্তি নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ ছিল৷ ব্রিগেডের র্যাম্প থেকে একসঙ্গে ৪২টি কেন্দ্রের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে নির্বাচনের শুরুতেই নজর কাড়ে তৃণমূল৷ পশ্চিমবঙ্গে সভা মিছিল মিলিয়ে এক লক্ষ কর্মসূচি হয়েছে৷ আর কোনও রাজ্যে এত বেশি কর্মসূচি হয়নি বলে কমিশনের তরফে জানানো হয়েছে৷ রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মসূচি হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়৷ এই জেলায় ১০ হাজার ৬৮৮টি কর্মসূচি হয়েছে৷ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে উত্তর ২৪ পরগনা৷ প্রচারে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা করেছে৷ কিন্ত্ত শেষ পর্যন্ত মানুষের রায় কোন দিকে গেল তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৪ জুন পর্যন্ত৷