নিজস্ব প্রতিনিধি– পঞ্চম দফার নির্বাচনকে পাখির চোখ করে মঙ্গলের দাবদাহকে উপেক্ষা করে জোড়া জনসভা করলেন তৃণমূল সুপ্রিমো তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বনগাঁ কেন্দ্রের প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাসের সমর্থনে কল্যাণীতে এবং শ্রীরামপুর কেন্দ্রের প্রার্থী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনে শ্রীরামপুরে আয়োজিত জোড়া জনসভা থেকেই দফায় দফায় বিজেপিকে আক্রমণ শানান মমতা৷ শ্রীরামপুরে দাঁড়িয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করার হুঁশিয়ারি দেন মমতা৷ কিন্ত্ত কেন? মমতার ভাষায়, “বিজেপি বলছে তৃণমূল চোর৷ কি চুরি করেছে? হাওয়া তুলে দিয়েছে! চুরি করেছে প্রমাণটা কোথায়? আমি তো আদালতে যাচ্ছি মানহানির জন্য৷ আমি নিজে মামলা করছি৷ জীবনে আমি এক কাপ চা কারো কাছ থেকে খাইনি৷ তাকে বলছে চোর!” একেবারে অর্থের হিসেব সহ তাঁর আরও সংযোজন, “জিজ্ঞেস করুন মোদিকে আমিও সাতবার সাংসদ ছিলাম, চারবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলাম, তিনবার মুখ্যমন্ত্রী আছি, সাংসদ হিসেবে আমি দেড় লক্ষ টাকার পেনশন পেতে পারি আর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কমপক্ষে দেড় লক্ষ টাকা পেতে পারি তাহলে মোট ৩ লক্ষ টাকা৷ এবার ১৩ বছরের হিসেবে করো৷ তাহলে দেখবে কয়েক কোটি টাকা আমি নিইনি, আমার নিজের সাদা টাকাও আমি নিইনি৷ ছবি এঁকে বিক্রি করেও সেই অর্থ আমি নিজে নিইনি৷ তাও আমার নামে সিবিআই কেস করেছিল৷ যেদিন ওঁদের গাছের মধ্যে বেঁধে ভালো করে আদর করতে পারবো সেদিন বুঝবে মিথ্যে কথা বলার কি দাম৷”
কল্যাণীতে দাঁড়িয়ে ইভিএম নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর৷ “ইভিএম যেখানে থাকবে যাতে কোনওরকম আলো বন্ধ করতে না পারে, কোনওরকম মেশিন বদলাতে না পারে, যাঁরা অর্গানাইজার আছেন তাঁদেরও দায়িত্ব, পুলিশেরও দায়িত্ব৷ মানুষ ভোট দেবেন৷ তাঁর ভোটটা যেন সযত্নে রক্ষা হয়”, তা দেখার জন্য দলের কর্তব্যরতদের নির্দেশ দিলেন তৃণমূল নেত্রী৷ সিপিএমই যে সন্দেশখালির মূল অভিযুক্ত, পরোক্ষভাবে বোঝালেন মমতা৷ সন্দেশখালি নিয়ে সিপিএম এবং বিজেপিকে একযোগে নিশানা করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেন, “সিপিএমের হার্মাদরাই এখন বিজেপিতে৷ সন্দেশখালিতে গিয়ে খোঁজ নিন, যারা কারসাজি করেছিল ওরা আগে সিপিএম করত৷ এখন বিজেপিতে৷ ওরা জানে না, মা-বোনেদের টাকাটা বড় কথা নয়, ওদের সম্মান করা বড় কথা৷ যা তা লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে না জানিয়ে৷ শুধু বিজেপির মণ্ডল সভাপতিকে দোষ দিলে হবে? যাঁরা মদত দিয়েছেন, যাঁরা বলেছেন বোমা-রিভলভার চাই, তাঁদেরও শাস্তি দরকার৷ সত্যের জয় আছে৷”
“গঙ্গায় স্নান করেই পবিত্র হয়ে গেল?”, প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ মমতার৷ তিনি আরও বলেন, “কোভিডের সময় উত্তরপ্রদেশে অনেক দেহ গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ দূষিত করা হয়েছিল, মুর্শিদাবাদে অনেক দেহ এসেছিল৷ আমরা দাহ করেছিলাম৷ সম্মান দিয়েছি৷ কিন্ত্ত বিজেপি সম্মান দেয়নি৷” কল্যাণী থেকে নির্বাচন কমিশনকে নিশানা করে তিনি বলেন, “এ রকম নির্বাচন দেখিনি৷ আমি নির্বাচন কমিশনকে সম্মান করি৷ কিন্ত্ত কয়েক জন বিজেপির হাতের পুতুল হয়ে গিয়েছে৷ দু’তিন মাস ধরে নির্বাচন হচ্ছে৷ সব সরকারি কাজ বন্ধ৷” শ্রীরামপুর এবং কল্যাণী দুই সভা থেকেই ‘মোদি গ্যারান্টি’কে ‘ফোর টোয়েন্টি’ বলে কটাক্ষ মমতার৷ শ্রীরামপুর থেকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “বিজেপি বলছে, কুড়ি হাজার কোটি টাকা ওরা (তৃণমূল) চুরি করেছে৷ আমাদের বয়ে গেছে৷ কুড়ি হাজার কোটি টাকা চুরি করতে হলে এদের থেকে করবো কেন? পিএম কেয়ার ফান্ডের কত কোটি টাকা ঝেড়েছেন?” প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন মমতার৷ চাকরি প্রসঙ্গে বিজেপির পাশাপাশি মমতা বিঁধেছেন কংগ্রেস ও সিপিএমকেও৷ তিনি বলেন, “যাকেই চাকরি দিচ্ছি, সিপিএম, বিজেপি এবং কংগ্রেস মিলে কোর্টে গিয়ে কেস করে সেই চাকরি আটকাচ্ছে৷ তবে দিল্লির কংগ্রেস নয়৷ এরা তিনটে দল মিলে চাকরিখেকো বাঘ হয়ে চাকরি খাচ্ছে৷ আর সিপিএমের প্রকাশবাবু বিখ্যাত আইনজীবী৷ তিনি কলকাতার মেয়র থাকার সময় হাজার হাজার ভুয়ো বার্থ সার্টিফিকেট বার করেছিলেন৷ কিন্ত্ত আমি ওই সব কথা মনে রাখিনি৷ সুপ্রিম কোর্ট চাকরি যাওয়ার মামলায় স্থগিতাদেশ দিতে গায়ে জ্বালা ধরেছে৷” এ প্রসঙ্গেই শ্রীরামপুর থেকে তাঁর আরও সংযোজন, “সিপিএমের আমলে শিক্ষকেরা মাসের ৩০ তারিখেও মাইনে পেতো না, আর আমরা ১ তারিখে মাইনে দিয়ে দি৷”
“ভোট এলে সিএএ-র কথা মনে পডে়৷ মতুয়া ভোটের কথা মনে পডে়৷ ভাগাভাগির রাজনীতি মনে পডে়৷ এরা এসসি, এসটি, সব তুলে দেবে৷ আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের তুলে দেবে৷ হিন্দুদেরও তুলে দেবে”, মন্তব্য মমতার৷ এদিনের জোড়া সভা থেকেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তৃণমূল নেত্রী গর্জে উঠে বলেন, “বাংলায় সিএএ, এনআরসি, ইউনিফর্ম সিভিল কোর্ট কোনোটাই করতে দেবো না৷” পাশাপাশি এদিন কল্যাণী থেকে নাম না করে শান্তনু ঠাকুরকে কটাক্ষ করে মমতা বলেন, “একটা কথা আপনাদের বলছি৷ একটা মতুয়ার গায়ে হাত দিতে দেব না৷ আপনার যিনি লোকসভার বিজেপি প্রার্থী এবং মন্ত্রী, তাঁর টিকি দেখতে পাওয়া যায়নি পাঁচ বছরে৷ আবার উনি নাগরিকত্ব দেব বলে নাম লিখিয়েছেন৷ শুনেছি, টাকাও তুলেছেন কোথাও কোথাও৷ নিজে আগে নাম লেখাননি কেন? লেখালেই বিদেশি৷ আমরা বিদেশি হতে চাই না৷ স্বদেশি থাকব৷” শ্রীরামপুর থেকে বিজেপিকে কটাক্ষের সুরে আক্রমণ শানিয়ে তিনি বলেন, “পৃথিবীর যত দেশ ভারতবর্ষে বিনিয়োগ করেছিল, সেসব টাকা তুলে নিচ্ছে৷ মোদি হারবে বলে৷ ইন্ডিয়া জোট পাবে ২৯৫ থেকে ৩১৫, আর মোদি ২০০-ও পার হবে না৷ ভোট পেতে হলে কাজ করতে হয়! কোনো কাজ করেননি, ঘুরে বেড়ানো ছাড়া৷ একটা মন্দির বানিয়েছেন তাও মন্দিরের টাকায়৷” ‘মা মাটি মানুষের কর্তব্যপরায়ণতা’ উল্লেখ করে মমতা বলেন, “আমি কথা দিয়ে কথা রাখি এটিই আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো স্বপ্ন৷ কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারার চেয়ে মৃতু্য শ্রেয়৷” আবাসের টাকা নিয়েও আক্রমণ মমতার, “মিটিং -এর পর মিটিং করেছি, একজন প্রধানমন্ত্রী কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ হলে একশো দিনের কাজ যাঁরা করেন সেই গরিব মা বোনেদের টাকা আটকে রাখেন৷ কোনো মানুষের যদি মানবিকতা বলে কিছু থাকে তাহলে গরিবের টাকা মারবে না, এটা আমরা বিশ্বাস করি৷ ওঁরা মানবিক নয়, চিন্তাধারায় দানবিক৷” ডানলপ কোম্পানি খুলতেও বিজেপি সাহায্যের হাত বাড়ায়নি এমনকি পাটকলগুলিও বন্ধের পেছনে দায়ী বিজেপি সরকার, শ্রীরামপুর থেকে দাবি মমতার৷ “মোদি আসলে দেশ শেষ”, মন্তব্য মুখ্যমন্ত্রীর৷