সংসদে শ্রমিক স্বার্থে ধ্বনি তুলতে বামপ্রার্থীদের জেতানোর আহ্বান মীনাক্ষির

নিজস্ব প্রতিনিধি— রিমেল বিধ্বস্ত শহরে সোমবার দমদম লোকসভা প্রার্থীর নির্বাচনী জনসভা হওয়া নিয়ে সংশয় তো ছিলই৷ এদিন দুপুর পর্যন্ত বেলঘরিয়ার দেওয়ানপাড়ার জল ছপছপে মাঠের একপাশে জড়ো করা ছিল প্লাস্টিকের চেয়ার৷ আসনহীন শূন্য মঞ্চে দমদমের লোকসভা প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী এবং বরানগর বিধানসভা উপনির্বাচনের প্রার্থী তন্ময় ভট্টাচার্যের ফ্লেক্সের ছবিটা তখনও টাঙানো হয়নি৷ কাস্তে-হাতুড়ি-তারার দলীয় পতাকা তখনও মুড়ে রাখা ছিল মঞ্চের একপাশে৷ উদ্বোধনী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের গান-কবিতার সাজসজ্জার চিহ্নমাত্রও ছিল না মঞ্চে৷ এসব দেখে মনে হয়েছিল এদিনের নির্বাচনী সভা বোধহয় স্থগিতও থাকবে৷ ভরসা ছিল মাঝেমাঝে মাইকে ভেসে আসা বার্তা– নির্বাচনী সভাতে বক্তব্য রাখতে আসবেন মীনাক্ষি মুখার্জি৷ শুধু সেই ঘোষণার ওপর ভরসা করেই সোমবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে তুচ্ছ করে বহু মানুষ জড়ো হচ্ছিল বেলঘরিয়া দেওয়ানপাড়ার ভেজা মাঠটায়৷

দেখতে দেখতে লাঠির ভরে কোনওরকমে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারা বেশ কিছু বয়স্ক মানুষ, লড়াকু মুখছবির কিছু মহিলা আর ঝকঝকে এই প্রজন্মের বেশ কিছু ছেলেমেয়ে যখন মাঠটাকে প্রায় ভরে ফেলল, তখন সন্ধে নেমে গিয়েছে৷ কিন্ত্ত তখনও এক শিল্পীর মঞ্চে গাওয়া ‘খরবায়ু বয় বেগে, চারিদিক ছায় মেঘে’ গানটার মতোই থমথমে আবহাওয়া চারপাশে৷ তবুও এদিনের সভার উদ্যোক্তারা বলে উঠতে পারলেন — ‘ওগো নেয়ে নাওখানি বাইয়ো’৷

হঁ্যা, চব্বিশের নির্বাচনে বামপ্রার্থীদের ভোট বৈতরণী পার করার নাওখানি বাইবার জন্য সেই ‘নেয়ে’তো সেই মেয়ে — মীণাক্ষি মুখার্জি৷ এই প্রজন্মের যে মেয়েটিকে বামফ্রন্টের তাবড় নেতারা তো বটেই, বিমান বসুর মতো বামফ্রন্টের চোয়ারম্যানও যাঁকে ক্যাপ্টেন’ বলে মানেন৷ রিমেল পরবর্তী দিনের মানুষ সোমবার তাঁরই অপেক্ষায় জনতা ধৈর্য ধরে দীর্ঘক্ষণ বসে রইলেন বৃষ্টিভেজা মাঠে৷ সোমবার টবিন রোডের জনসভায় বক্তব্য রাখার পরে বেলঘরিয়ার দেওয়ানপাড়া মাঠে মীণাক্ষি যখন এসে পেঁৗছলেন, ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় সাড়ে আটটা বাজতে চলেছে৷ আকাশে জলভরা মেঘ কেটে গিয়েছে৷ উদ্যোক্তা স্থানীয় বামফ্রন্ট নেতারা ঘোষণা করলেন, আমরা যেভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সরিয়ে রেখে জনসভায় জড়ো হতে পেরেছি, একইভাবে রাজনৈতিক দুর্যোগ কাটিয়েও পরিষ্কার আকাশের নীচে এসে দাঁড়াতে পারব৷


বেলঘরিয়ার সভার পরেও সোমবার খড়দহে নির্বাচনী সভা ছিল মীণাক্ষি মুখার্জির৷ তাই এদিন বক্তব্যকে সীমিত সময়ের মধ্যেই বেঁধে রাখলেন তিনি৷ কিন্ত্ত অল্প সময়ের মধ্যেও তাঁর বক্তব্যে আগুন ঝরল বৃষ্টিভেজা দিনে৷ দুই বিরোধী বিজেপি এবং তৃণমূলকে মীণাক্ষি আক্রমণ করলেন নিছক বাক্যবাণে নয়, চোখা যুক্তির শানে৷ সমবেত জনতার হাততালি আদায় করে নিলেন তাঁর বক্তব্যের স্পষ্টতায়, তেজস্বিতায়৷
মীনাক্ষি জানালেন, বামফ্রন্টের ল.ড়াই ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, নীতির বিরুদ্ধে৷ যে দল দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধ্বংস করে দেয়, তাদের বিরদ্ধে৷ এই সূত্রে সোমবার দেওয়ান পাড়ার মাঠের সভায় তৃণমূল এবং বিজেপি — দুই দলকেই কাঠগড়ায় তুললেন মীণাক্ষি মুখার্জি৷ পঞ্চায়েতে একতরফা নির্বাচন, কামারহাটি পুরসভার নিয়োগ দুর্নীতি, ভুয়ো জব কার্ড তৈরি — এসবের জন্য আক্রমণ করলেন তৃণমূলকে৷ আবার সংসদে ২৭৮ জন বিরোধী সাংসকে বহিষ্কার করে ৪৪ টা শ্রম আইনকে বাতিল করে ‘যমুনার জলে ভাসিয়ে’ দেওয়ার জন্য বিজেপি সরকারকে তুলোধোনা করলেন মীণাক্ষি৷ তাঁর কথায়, প্রচলিত শ্রম আইন বাতিল করে তা সংস্কারের নামে বিজেপির ‘শ্রম কোড’ চালু করার অর্থ শ্রমিকের সামাজিক অধিকারকে স্বীকৃতি না দেওয়া৷ শ্রমিক শোষণে মালিকদের সুযোগ করে দেওয়া৷ মীণাক্ষি মুখার্জি অভিযোগ করেন, সংসদে যখন জনবিরোধী আইন পাশ করানো হয়, তখন সৌগত রায়ের মতো বাংলার তৃণমূল সাংসদরা বাইরে ব্যস্ত থাকেন৷ মীণাক্ষি আহ্বান জানান, সংসদে লাল ঝাণ্ডার দল না থাকলে শ্রমিকদের হয়ে কথা বলার মতো কেউ থাকবে না৷ তাই এই মুহূর্তে যত বেশ বামপন্থীরা সংসদে যাবেন, গণতন্ত্র রক্ষা পাবে, শ্রমিকদের হয়ে বক্তব্য রাখার সুযোগ ঘটবে৷

এদিন রাজ্যে শিল্প না থাকায় বেকারি বৃদ্ধি প্রসঙ্গ তোলেন মীণাক্ষি মুখার্জি৷ বলেন, সিঙ্গুরে, নন্দীগ্রামে, শালবনী, রঘুনাথপুর, জঙ্গিপুর, কোচবিহার থেকে শিল্প চলে গিয়েছে তৃণমূলের বিরোধিতায়৷ একসময় (বাম আমলে)ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পে ৫৮ লক্ষ শ্রমজীবীর মধ্যে প্রায় ২৮ লক্ষ কর্মরত ছিল পশ্চিমবঙ্গে৷ বর্তমানে সেখানে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা প্রচুর৷ এই রাজ্যে শিল্পস্থাপনের উপযোগী পরিবেশই তো নেই৷ সর্বত্র দুর্নীতিতে ছেয়ে গিয়েছে৷ অন্যদিকে মীণাক্ষির অভিযোগ, বিজেপি সরকার দিনে দিনে ওষুধের দাম, গ্যাসের দাম বা‌ি.ড়য়ে চলেছে৷ ইলেকটোরাল বন্ড কিনে তার ভার জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে৷

মীণাক্ষি এদিন তৃণমূল এবং বিজেপি উভয় দলকেই কটাক্ষ করে বলেন, ‘হাওয়াই চটি’ আর ‘বুলডোজার’ — এদের বাদ দিয়ে একটা বিকল্প সরকারকে নিয়ে আসার সময় এসেছে৷ দুর্নীতিমুক্ত সমাজে বাঁচতে, কথা বলার স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে একটা নতুন সরকারকে নিয়ে আসার সময় এসেছে৷ সেই লক্ষ্যে কংগ্রেস সমর্থিত বামফ্রন্টের প্রার্থীকে দমদম কেন্দ্রে জিতিয়ে আনুন৷ মীণাক্ষির পরে বক্তব্য রাখেন দমদম কেন্দ্রের প্রার্থী সুজন চক্রবর্তীও৷

মীণাক্ষির কাছে, একান্ত প্রশ্ন ছিল, এবারের লোকসভায় কতজন বামপ্রার্থী যেতে পারবেন? বামপন্থীরা সংসদে গেলে কী পরিবর্তন আসবে?

ভোটের ফলপ্রকাশের আগে কোনও ভবিষ্যৎবাণী করতে চাননি মীণাক্ষি৷ তবে জানিয়ে দেন, এই মুহূর্তে একজনও বামফ্রন্ট সদস্য সংসদে না থাকলেও বাইরে থেকে বামপন্থীদের আবেদন মেনেই তো ইলেকটোরাল বন্ড কে কত পেয়েছে, সেকথা জানাতে বাধ্য হয়েছে উচ্চ আদালতের রায়ে৷ সংখ্যায় কম থাকলেও সততার জোরের কাছে যে কোনও শক্তি মাথা নোয়াতে বাধ্য৷

এদিন দেওয়ানপাড়ার মাঠের সভা শেষে মীণাক্ষি মুখার্জির বক্তব্যের পরে তাঁর হাতে নিজের অাঁকা তুলে দেয় এক খুদে, নিজের লেখা দুটি বই উপহার দেন একজন মহিলা৷

বোঝা যায়, কোনও প্রাপ্তির জন্য নয়, নেত্রী এইভাবেই তৈরি হয় আবেগের মানবজমিন থেকে৷ এদিন প্রায় রাত ন’টা নাগাদ পরবর্তী সভায় যাওয়ার জন্য যখন পা বাড়াচ্ছেন মীণাক্ষি মুখার্জি, তারার আলোয় চোখে পড়ল জনতার মুখে তখনও লেপ্টে রয়েছে মুগ্ধতা, মীণাক্ষি ম্যাজিকের সম্মোহন৷ কারও মোবাইলে বাজছে মীণাক্ষির রেকর্ড করা কন্ঠস্বর৷ মীণাক্ষির ছেড়ে যাওয়া পথে জনতার পায়ে পায়ে পথ চলা দেখে মনে পড়ে গেল, মীনাক্ষিকে নিয়ে মন্দাক্রান্তা সেনের লেখা কবিতার ক’টা লাইন — ‘তোর ওপরে মুক্তি আনার রাখছি বাজি/ জিৎ এনে দে, সঙ্গে আছি আমরা আজই/ সেটাই যে তোর কঠিন শপথ আমরা জানি/ চল মিছিলের অগ্রভাগে মুক্তি আনি৷’