• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

অনেকেই বলছেন বিজেপি জয়ী হলে এবারই শেষ নির্বাচন

বরুণ দাস হঁ্যা, অনেক বাম রাজনীতিক এবং বাম রাজনীতি সচেতন মানুষই বলছেন, ফ্যাসিস্ট বিজেপি এবার জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলে আর নির্বাচনের মুখ দেখবেন না এদেশের মানুষ৷ এটা ঠিক যে, গোটা দেশ জুড়ে একটা চাপা আতঙ্ক নির্মাণে সফল হয়েছে সংঘ পরিবারের বিতর্কিত রাজনৈতিক শাখা বা প্রতিষ্ঠান বিজেপি৷ যে চাপা আতঙ্কের বলি বাম রাজনীতিক এবং বাম রাজনীতি

বরুণ দাস

হঁ্যা, অনেক বাম রাজনীতিক এবং বাম রাজনীতি সচেতন মানুষই বলছেন, ফ্যাসিস্ট বিজেপি এবার জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলে আর নির্বাচনের মুখ দেখবেন না এদেশের মানুষ৷ এটা ঠিক যে, গোটা দেশ জুড়ে একটা চাপা আতঙ্ক নির্মাণে সফল হয়েছে সংঘ পরিবারের বিতর্কিত রাজনৈতিক শাখা বা প্রতিষ্ঠান বিজেপি৷ যে চাপা আতঙ্কের বলি বাম রাজনীতিক এবং বাম রাজনীতি সচেতন অনেক মানুষও৷ কিন্ত্ত সত্যিই কি তাই? ফ্যাসিস্ট বিজেপি জয়ী হয়ে এলে আর নির্বাচনের মুখ দেখবেন না এদেশের মানুষ?

আসলে বিজেপির দীর্ঘমেয়াদী ‘রাজনৈতিক’ কর্মকাণ্ড দেখলে এমন একটা গড়পরতা ধারণার জন্ম নেওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়৷ বিশেষ করে যাঁরা নিজেদের স্বঘোষিত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বলে মনে করেন৷ অন্যদের থেকে নিজেদেরকে একটু আলাদা গোত্রের মনে করেন এবং মাঝেমধ্যে অবাক করা ভবিষ্যদ্বাণীও করেন৷ যদিও তা অনেক সময়েই মেলে না৷ ‘আমার কাছে খবর আছে তবে কতটা সত্য তা জানি না৷’ ওই ‘খবর’-এর বিশ্বাসযোগ্যতা কতখানি তা নিজেও বিচার করে দেখেন না৷

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর অর্থাৎ ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই বিশাল আয়তনের দেশ তার বিপুল সংখ্যক মানুষকে গণতন্ত্রের মহিমা উপলব্ধি করিয়ে গণতান্ত্রিক উৎসবটি নিয়মিতভাবে সম্পন্ন করিয়ে আসছে৷ এই ‘সম্পন্ন করানো’র মধ্যে ভুলত্রুটি যে একেবারেই নেই তা অবশ্য হলফ করে বলা যায় না৷ কিন্ত্ত যেটুকু জোর দিয়ে বলা যায়, তা হল গণতান্ত্রিক উৎসবের ধারাবাহিকতাকে সে এখনও বজায় রাখতে পেরেছে এবং ক্ষমতায় যে দলই আসুক না কেন, তা কোনওভাবেই ক্ষুণ্ণ হবে না৷

অনেকে হয়ত প্রশ্ন করবেন, সংঘ পরিবারের বিতর্কিত রাজনৈতিক শাখা বা প্রতিষ্ঠান বিজেপির গণতন্ত্র-বিরোধী কর্মকাণ্ড দেখেও কেন জোর দিয়ে একথা উচ্চারণ করা? আসলে ভারতের ডিএনএ-তে মিশে আছে গণতন্ত্র৷ চাইলেই একে সমূলে উৎপাটন করা কারও পক্ষেই মোটেই সহজ ব্যাপার নয়৷ যতই নির্বাচন কমিশনসহ দেশের স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাগে আনার মরিয়া চেষ্টা করা হোক না কেন, যতই বিচারবিভাগকে নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করা হোক না কেন, কেউ না কেউ বেঁকে বসবেনই৷

কেন বলা হচ্ছে একথা? রামমন্দিরে স্থান এবং নির্মাণ নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনেক ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল মানুষ হয়ত মন থেকে মেনে নিতে পারেননি৷ মহামান্য আদালত অবমাননার দায়ে কিংবা ভয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে পারেননি কিন্ত্ত নির্বাচনী বন্ড (ইলেক্টোরাল বন্ড) নিয়ে ওই সর্বোচ্চ আদালতের রায়ই তো কেন্দ্রের বিতর্কিত শাসকদল বিজেপিকে চূড়ান্ত অস্বস্তিতে ফেলে বিরোধীদের অনেকটাই স্বস্তি দিয়েছে৷ আদালতকে সব সময়েই ‘হার্ড এভিডেন্স’-এর ওপর নির্ভর করে চলতে হয়৷
ফলে ‘হার্ড এভিডেন্স’-এর অভাবে অনেক সময়ে তাঁদেরকেও বড্ড অসহায় মনে হয় বৈকি৷ তাই ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময় অনেক কিছু করা সম্ভব হয় না৷ ফলে আমাদের মতো পাঁচ-পাবলিক হয়ত কোনও কোনও ব্যাপারে ভুল বুঝি৷ যেকোনও বিষয়ের গভীরে ঢুকে দেখলে সঠিক অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়৷ কিন্ত্ত আমাদের মতো সাধারণ মানুষের তেমন সময় বা ধৈর্য কোথায়? নিজের পছন্দের বাইরে গেলেই চট করে বিরূপ মন্তব্য করে বসি৷ আগেপিছে ভেবে দেখার নূ্যনতম প্রয়োজন বোধই করি না৷

একথা ঠিক, দেশের ভিতরেই শুধু নয়, দেশের বাইরেও কেন্দ্রের বর্তমান বিতর্কিত শাসকদলের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনার ঢেউ উঠছে৷ গণতন্ত্র হরণের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে৷ নাগরিক অধিকার কুক্ষিগত করার বদনামে ভূষিত হয়েছেন তাঁরা৷ সরকারের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে এবং ইউএপিএ আইনে আটক করে প্রতিবাদীদের বিনা বিচারে বছরের পর বছর ফাটকে বন্দি করে রাখা হচ্ছে৷ এদের অধিকাংশই সমাজকর্মী, মানবাধিকার কর্মী, অধ্যাপক, চিকিৎসক, আইনজীবী৷

এমনকী আছেন গবেষক-কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কর্মী৷ অনেক ক্ষেত্রেই ভুয়ো বা মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে পরিবার ও সমাজজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে৷ চিকিৎসার নূ্যনতম সুযোগটুকু থেকেও বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে৷ ছ’সাত বছর পর জামিন পেলেও তাঁরা আদালতের শর্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে অপারগ৷ নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যেতে পারছেন না৷ প্রতিনিয়ত স্থানীয় থানায় হাজিরা দিতে হচ্ছে৷ এমনকী সিবিআই কিংবা এনআইএ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিজের সেলফোন জুড়ে রাখতে হচ্ছে৷

কেন্দ্রে বিজেপির দু’দফার রাজত্বে বা আমলে দেশের গণতন্ত্র যে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়েছে তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার৷ তাদের আগ্রাসী এবং বিধ্বংসী রাজনীতির কবলে পড়ে দেশের সিংহভাগ মানুষ নাজেহাল৷ মানুষে মানুষে বিভেদ-বিদ্বেষ দ্রুত বেড়েছে৷ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে এলাকার পাতি দলীয় নেতা— সবার মুখেই বিভেদ-বিদ্বেষের লাভা ছড়াচ্ছে৷ এ কোন নির্বিকল্প দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা? রাজধর্ম পালনে ব্যর্থ কেন্দ্রের এই শাসকদল৷ সংকীর্ণ দলীয় ধর্ম পালনেই ব্যর্থ তাদের সবাই৷

‘বিজেপি বনাম গণতন্ত্র’, ব্রিটেনের শীর্ষ সংবাদপত্রের সংবাদ শিরোনাম৷ এই শিরোনামের তাৎপর্য বুঝতে আমাদের অসুবিধে হওয়ার কথা নয়৷ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমীক্ষায়ও উঠে এসেছে গণতান্ত্রিক মানদণ্ডে ভারতের দ্রুত অবনমনের চিত্র৷ সরকার বাহাদুর এসবে কান দিতে নারাজ৷ কিন্ত্ত তথ্য-পরিসংখ্যানকে তো আর অস্বীকার করা যায় না৷ ‘বিশ্বগুরু’র আলখাল্লা পরে সবকিছু আড়াল করা বা ঢেকে দেওয়া যায় না৷ উন্নত প্রযুক্তির যুগে সংগৃহীত ডেটাকে এড়িয়ে গেলেও মিথ্যে বলবেন কীভাবে?

ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ কিন্ত্ত নানাবিধ৷ যেমন নাগরিকের স্বাধীনতাহরণসহ সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ, সরকারের সমালোচনাকে দেশদ্রোহিতা হিসেবে দেখা, বিচারবিভাগের ওপর শাসন বিভাগের চাপ তৈরির অনৈতিক চেষ্টা, সংখ্যাগুরুবাদ প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বিদ্বেষ ও বৈষম্য বাড়াতে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন, সমাজ সংস্কৃতির বহুত্ব অস্বীকার করে একত্ব নির্মাণের মরিয়া প্রচেষ্টা, নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে দলীয় তহবিল বাডানোই নয়, ব্যবসায়িক দুর্নীতিকে প্রত্যক্ষ ইন্ধন দেওয়া ইত্যাদি৷
এই অনৈতিক ও গণতন্ত্রবিরোধী পদক্ষেপগুলি থেকেই অনেকে হয়ত ভাবছেন এবং বলতে বাধ্য হচ্ছেন, ‘সংঘ সন্তান’ বিজেপি তৃতীয়বারের জন্য জয়ী হয়ে এলে দেশের গোটা নির্বাচন ব্যবস্থা বা পদ্ধতিটাকেই হয়ত লোপাট করে দেবেন তাঁরা৷ তাই ২০২৪-এর অষ্টাদশতম নির্বাচনের পর আর নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না এদের কেউ৷ এমনটা মনে হওয়া অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নয়৷ কারণ শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের অন্যত্রও ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্কট নিয়ে নানাবিধ বিরূপ মন্তব্য চলছেই৷

তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, এদেশ কি ইলেক্টারাল ডেমোক্রেসি বা নির্বাচনী গণতন্ত্র থাকবে, নাকি ক্রমে ইলেক্টোরাল অটোক্র্যাসি বা নির্বাচনী একনায়কতন্ত্র হয়ে উঠবে? শুধু ব্রিটেন নয়, সুইডেনও ভারতের বিরুদ্ধে সুর ও স্বর অনেকটাই চড়িয়েছে৷ সেদেশের গোটেনবার্গের এক নামি গণতন্ত্র নজরদারি সংস্থা ২০২৪-র তাদের রিপোর্টে স্পষ্টভাবেই জানিয়েছে, ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে সঙ্কটময় একনায়কতন্ত্রের অন্যতম দেশ৷ এই সঙ্কটময় একনায়কতন্ত্র থেকে পরিত্রাণের পথ কি বিশ্বগুরু সাজার চেষ্টা?

তবে আজকের পরিস্থিতিতে তেমন সম্ভাবনা নেই একথা বলাই বাহুল্য৷ কেন নেই? ভারত এখনও চিনের পর্যায়ে উঠতে পারেনি৷ স্বনির্ভরশীল দেশ নয় আমাদের ভারত৷ তাকে অন্যান্য দেশের ওপর কোনও-না-কোনওভাবেই নির্ভর করে চলতে হয়৷ জ্বালানি তেল থেকে রান্নার তেল (পাম তেল), ওষুধ ও যন্ত্রশিল্পের কাঁচামাল থেকে অন্যান্য জিনিস পর্যন্ত৷ তাই বিধিনিষেধের হার্ডেল টপকে সে কিছুতেই এক পাও নড়তে পারবে না৷ যতই কম খরচে ভিন গ্রহে রকেটযান পাঠাক৷ বাস্তবের বেড়ি নিয়ে চলা সম্ভব নয়৷

গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েও গণতন্ত্রকে অাঁকড়ে থাকতে হবে তাদেরকে৷ পদে পদে গণতন্ত্রকে পদাঘাত করেও গণতন্ত্রের মেকি নামগান করতে হবে তাদেরকে৷ গণতন্ত্রকে গুপ্তহত্যা করেও গণতন্ত্রের শবদেহ বয়ে নিয়ে চলতে হবে তাদেরকে৷ যেমন গণতন্ত্রের পবিত্র বেদি সংসদের সিঁড়িতে মাথা ঠেকিয়ে গণতন্ত্রের গলায় দড়ি পরিয়ে দুদিক থেকে টানাটানি করছেন তাঁরা৷ গণতন্ত্রের গলায় ফাঁস লাগছে কিন্ত্ত একেবারে ফাঁসি দিচ্ছেন না তাঁরা৷

গণতন্ত্রকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলছে৷ ভারত বিশ্বের ‘বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ’ বলে বুকের ছাপান্ন ইঞ্চিকে টেনেটুনে আরও কিছুটা বাড়ানোর চেষ্টা হয়ত চলছে৷ ভারত তো আর চিন কিংবা রাশিয়া নয় যে, দেশের সংবিধান পাল্টে আজীবন রাষ্ট্রপ্রধান থাকার কথা ঘোষণা করবেন এঁরা৷ বরং এই তো বেশ আছেন৷ গণতন্ত্রকে ললিপপ বানিয়ে নিজেদের দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে যখন কোনও অসুবিধে নেই তখন খামোকা নির্বাচন ব্যবস্থাকে তুলে দেওয়া হবে কেন? একটা কৃত্রিম আবরণ থাক না দেশ-বিদেশের সামনে৷
যে বাহ্যিক ‘আবরণ’-এ লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই শাসকদলের৷ একমাত্র মোটা মাথার রাজনীতিকেরাই গণতন্ত্রকে বিদেয় দিয়ে অন্যপথে হাঁটতে ইচ্ছুক৷ বলাবাহুল্য, সংঘ-লালিত দূরদর্শী বিজেপি তেমন নির্বোধ রাজনৈতিক দলের মধ্যে পড়ে না৷ তার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে৷ সেই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল বলেই দুই থেকে আজ ৩০৩-এ পেঁৗছেছে৷ তাদের রাজনৈতিক অগ্রগতি তো কংগ্রেস কিংবা কমিউনিস্টদের ঈর্ষার বিষয়৷ শতাধিক বছরের কংগ্রেস কিংবা শতবর্ষে পা রাখা কমিউনিস্টরা তো বিলীয়মান৷ অন্যদিকে বিজেপি ক্রমবর্ধমান৷

একবার খোদ অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে মিলিজুলি সরকার, তো দু’দুবার নরেন্দ্র মোদির একক নেতৃত্বে কেন্দ্রে সরকার গড়ার কৃতিত্ব বিজেপির৷ তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের চূড়ান্ত বিরোধিতা করলেও এই সত্যকে তো কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না৷ ব্যক্তি কিংবা সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে পরস্পর বিবদমান বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে ভেঙে ছত্রখান করে দিয়েছে বিজেপি নেতৃত্ব৷ নিশ্চয়ই নৈতিক পথে নয়, সম্পূর্ণ অনৈতিক পথেই৷ যদিও আজকের রাজনীতিতে নীতি-নৈতিকতার কোনও স্থান নেই৷