মনমোহনের খোলা চিঠি

কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি বরাবরই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে কটাক্ষ করেছে ‘মৌনমোহন’ বলে৷ মনমোহন জমানার মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বাড়ুই একটি বই লিখেছিলেন৷ নাম ছিল ‘দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’৷ চলতি লোকসভা নির্বাচনে আগাগোড়া নিশ্চুপ থাকলেও আক্রমণ করতে ছাড়েননি নরেন্দ্র মোদি৷ পূর্বসূরীর প্রসঙ্গ টেনে বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে একাধিকবার তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন নরেন্দ্র মোদি৷ কংগ্রেস তথা বিরোধী শিবির পাল্টা নমোকে বিঁধেছে, ‘হেট স্পিচে’র অভিযোগ তুলে নালিশ জানিয়েছে নির্বাচন কমিশনে৷ তবু কিন্ত্ত মুখ খোলেননি মোদির পূর্বসুরী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনোমোহন সিং৷ সপ্তম দফা অর্থাৎ শেষ দফা ভোটের আগে ধৈর্যচু্যতি ঘটলো আদ্যন্ত ভদ্রলোক তথা বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিংয়ের৷ দেশের নাগরিকদের উদ্দেশে খোলা চিঠিতে গর্জে উঠলেন সেই মনমোহন৷

মোদিকে সরাসরি বিঁধে খোলা চিঠিতে লিখলেন, ‘একের পর এক জঘন্য ঘৃণা ভাষণ দিয়েছেন মোদিজি, যা সরাসরি বিভাজনমূলক৷ মোদিজিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি প্রধানমন্ত্রী পদটির মর্যাদা এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতরের গুরুত্ব এত নীচে নামিয়ে এনেছেন৷’ বস্ত্তত এত কড়া সুরে তাঁর উত্তরসূরির সমালোচনা করতে অতীতে কখনও দেখা যায়নি বর্ষীয়ান রাজনীতিক তথা অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিংকে৷ দেশের নাগরিকদের উদ্দেশে তাঁর বার্তা, ‘স্বৈরাচারী শাসকের অবিরাম সংঘাত থেকে গণতন্ত্র এবং সংবিধানকে বাঁচানার এটাই শেষ সুযোগ৷’

নির্বাচনী প্রচার শেষ করে কন্যাকুমারীর স্বামী বিবেকানন্দ রকে ধ্যানে বসেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি৷ তিনি নিজে মনমোহনের বক্তব্য নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি৷ তাঁর দলের তরফেও এই ইসু্যতে কোনও বিবৃতি সামনে আসেনি৷ ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিকরাও এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি৷ তবে মনমোহন যেসব ইসু্যতে আক্রমণ শানিয়েছেন তাঁর উত্তরসূরীকে, সেই সব অভিযোগ তুলে একাধিকবার সরব হয়েছে বিরোধী শিবির৷


রাজস্থানে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে মনমোহনের কথা উল্লেখ করেন নরেন্দ্র মোদি৷ তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘কংগ্রেস তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে বলেছে, ওরা মা-বোনেদের সোনা ছিনিয়ে নিয়ে বিলিয়ে দেবে৷ এর আগে মনমোহন সিংয়ের সরকার বলেছিল, দেশের সম্পদের উপর প্রথম অধিকার সংখ্যালঘু মুসলিমদেরই৷ শহুরে নকশালদের এই মানসিকতা মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্রকেও ছিনিয়ে নেবে৷’

মনমোহন সরকারের মন্তব্যকে বিকৃত করে সকলের সামনে তুলে ধরেছেন নরেন্দ্র মোদি৷ এই অভিযোগ এনে কংগ্রেস তথা বিরোধী শিবির মোদির মিথ্যাচারকে সামনে নিয়ে এসেছে৷ তুলে ধরা হয়েছে ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলের বৈঠকে মনমোহন সিংয়ের ভাষণের অংশ, যা মোদি তথা বিজেপি শিবির বিকৃত করেছে বলে অভিযোগ৷ পরে মনমোহনের পক্ষ থেকেও বিবৃতি দিয়ে বলা হয় যে, তফসিলি জাতি-উপজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি, মহিলা, শিশু এবং সংখ্যালঘুদের দেশের সম্পদের উপর অগ্রাধিকারের কথাই বলেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং৷ সেই বক্তব্যকে বিকৃত করে মোদি বলেছেন, তাঁর পূর্বসুরি দেশের সম্পদের উপর মুসলিমদের প্রথম অধিকার বলে উল্লেখ করেছেন৷

দেশের নাগরিকদের উদ্দেশে খোলা চিঠিতে মনমোহন যেমন মোদির সেই কথার জবাব দিয়েছেন, তেমনই কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের জমানায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্যায় করা হয়েছে বলে জোরালো অভিযোগ তুলেছেন৷ চিঠিতে মনমোহন আরও লিখেছেন, ‘দেশের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষ এবং বিরোধীদের নিশানা করতে গিয়ে আগের কোনও প্রধানমন্ত্রী এমন জঘন্য, অসংসদীয় এবং নিম্নমানের ভাষার প্রয়োগ করেননি৷ আমার মন্তব্য বলে কিছু মিথ্যে দাবি করা হয়েছে৷ জীবনে কখনও এক সম্প্রদায়কে অন্য সম্প্রদায়ের থেকে আলাদা করে দেখিনি আমি৷ বিজেপি’র এটাই স্বভাব এবং অভ্যাস৷’

মোদি জমানায় কৃষক আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে মনমোহন লিখেছেন, ‘পাঞ্জাবে ৭৫০ জন কৃষকের মৃতু্য হয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রীর মুখে সে প্রসঙ্গে কোনও কথা শোনা যায়নি৷ অথচ আন্দোলনকারীদের তিনি ‘পরজীবী’ বলে কটাক্ষ করেছেন৷

সামগ্রিকভাবে মোদি জমানায় গৃহস্থের সঞ্চয় এবং আমজনতার ক্রয়ক্ষমতাও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে বলে দাবি করেছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন৷ তিনি বলেছেন, কেন্দ্রে ১০ বছরের বিজেপি শাসনে সবদিক থেকেই ভারতের অবস্থান ক্রমশ নিম্নগামী হয়েছে৷ ভারতের সংবিধান, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ পরিকাঠামোকে রক্ষা করার স্বার্থে উন্নয়ন নির্ভর, ভবিষ্যৎমুখী প্রগতির প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কংগ্রেস প্রতিজ্ঞাবদ্ধ৷

মোদির মিথ্যাভাষণ ও দিনরাত কটূক্তির ফলে বাধ্য হয়ে মুখ খুলেছেন অতি ভদ্র, বিবেচক, ‘মৌনমনমোহন’৷ এবার লেজ গুটিয়ে পালিয়ে মোদি আশ্রয় নিয়েছেন ধ্যানের৷ কানে তুলো দিয়ে পিঠে কুলো বেঁধে কন্যাকুমারীর সমুদ্রপৃষ্ঠে পাপমুক্তির তপস্যায় রত নরেন্দ্র মোদি৷ ফলাফল স্পষ্ট হবে অপেক্ষা আর মাত্র কয়েকটা দিন৷