গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে মনমোহনই পছন্দ, বলছেন বছর একাশির প্রৌঢ়

নিজস্ব প্রতিনিধি— অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের শেষ দফা৷ ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে সকাল সাড়ে ন’টা বাজতে আর বেশি দেরি নেই৷ তখনও শহরের আকাশ আংশিক মেঘাচ্ছন্ন৷ তবে মাঝে মধ্যে মেঘের আড়াল থেকে উকি মেরে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন সূর্যদেব৷ মৃদুমন্দ হাওয়া চললেও আবহাওয়া মোটের উপর গরমই বলা চলে৷ রোদ-গরম উপেক্ষা করেই তখন ধীরে ধীরে ভিড় জমতে শুরু করেছে দমদম লোকসভার বিভিন্ন বুথে৷ তার মধ্যে থেকেই হঠাৎ করে নজর পড়ল এক অসমর্থ বৃদ্ধের উপর৷ ওয়াকারে ভর দিয়ে পুত্রবধূ সোমা দত্তের সঙ্গে বেলঘরিয়ার ভোট গ্রহণকেন্দ্র উত্তরা ভবন থেকে বেরিয়ে আসছেন বেলঘরিয়া ১৭ পল্লির বাসিন্দা বছর একাশির বকুল দত্ত৷ তাঁর জন্য টোটোর বন্দোবস্ত করে রেখেছে পাড়ার ছেলেরাই৷ জরাজীর্ণ শরীর, ওয়াকার ছাড়া নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটুকুও নেই৷

তবে চামড়ায় কুঞ্চন ধরলেও তাঁর মন এখনও ‘তরুণ’৷ ভোট দিয়ে বেরিয়ে চোখে মুখে উৎফুল্লতার ছাপ স্পষ্ট৷ দেখে বোঝার উপায় নেই, তিনি প্রবীণ ভোটার নাকি নবীন৷ ভাঙা গলায় বলছেন, ‘‘বিধান রায়ের (রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী) আমল থেকে ভোট দিচ্ছি৷ নিজের অধিকার কেন ছেড়ে দেব? যতদিন বাঁচব নিজের ভোট নিজেই দিতে আসব’’৷ উল্লেখ্য, বয়স্ক মানুষদের জন্য বাড়ি গিয়ে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করেছে নির্বাচন কমিশন৷ তবে সেই ভোটদানে মজা নেই, বলেই মনে করছেন বছর একাশির ‘তরুণ’ এই ভোটার৷ ভারতীয় রাজনীতির প্রবীণ এই ‘রাজসাক্ষী’ একদিকে যেমন দেখেছেন ইন্দিরা গান্ধি, রাজীব গান্ধির মতো তাবড় প্রধানমন্ত্রীদের, ঠিক তেমনই দেখেছেন অটল বিহারী বাজপেয়ীর মতো কবিতা আর ছন্দে দেশরক্ষাকারী প্রধানমন্ত্রীকেও৷ তবে প্রধানমন্ত্রীদের তালিকায় এগিয়ে রাখছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকেই৷ দিল্লি বাড়ির লড়াইয়ের মতো দেখেছেন রাজ্যের পালাবদলও৷ নকশাল আন্দোলনের স্মৃতি এখনও তাজা৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের কথা তুলতেই অশ্রু মিশ্রিত কন্ঠে বললেন, ‘‘গরীব মানুষ৷ এক গেঞ্জি কারখানায় কাজ করতাম৷ এই মূল্যবৃদ্ধির বাজারে দিদি আমাদের যা দিচ্ছেন, তাতে কিছুটা হলেও সুরাহা হয়৷’’

অন্যদিকে বারো বছরের নাতির হাত ধরে ধীর গতিতে বুথ থেকে বেরিয়ে আসছিলেন বিরাশি বছরের শোভারাণি চক্রবর্তী৷ দৃষ্টি শক্তি আগের থেকে অনেকটাই কমে এসেছে৷ ক্ষীণ হয়ে এসেছে শ্রবণ ক্ষমতাও৷ তবুও তাজা দেশভাগের স্মৃতি৷ স্মৃতিমেদুর হয়ে বলছেন,‘‘ খুব ছোট বয়সেই বাব-মায়ের হাত ধরে ওপার বাংলা ছেড়ে চলে এসেছিলাম এপারে৷ এসে উঠেছিলাম, সম্পূর্ণ এক অচেনা-অজানা জায়গায়৷’’ যদিও তখন ঠিক বয়স কতো, সেটা আজ আর মনে পড়ে না বৃদ্ধার৷ স্মৃতির পাতায় আজ ঝাপসা প্রথম ভোটের কথাও৷ তবে ঝাপসা স্মৃতি উস্কে তিনি আরও বলছেন,‘‘যখন থেকে দেশের নাগরিক হয়েছি, তখন থেকেই ভোট দিচ্ছি৷ গণতন্ত্রের লড়াইয়ে অংশ নিয়ে তাঁর মুখেও ফুটে উঠল বকুল বাবুর সুর৷ বললেন, ‘‘এটা (ভোট) তো আমাকেই দিতে হবে৷ আমি ছাড়া আমার ভোট তো কেউ দিতে পারবে না৷ তাই নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে এলাম৷’’


তবে শুধু বয়স্ক নয়৷ শেষ দফার ভোটে তরুণদের মধ্যেও উন্মাদনা নজর কাড়ল৷ সকাল থেকেই বুথে বুথে দেখা গেল প্রাপ্ত বয়স্কদের সঙ্গে পা মিলিয়ে তরুণদের ভিড়৷ জীবনের প্রথম ভোট দেওয়ার লাইনে দাঁড়িয়ে কেউ তুলে নিলেন নিজস্বী, কারোর মুখে তখন আবার প্রথম ভোট দেওয়ার হালকা ভয়৷ কেউ আবার বলে উঠল, ‘‘ইয়ে দেশ রহেনা চাহিয়ে৷’’