আজও জ্বলছে মণিপুর

মণিপুরের দুই মহিলাকে নগ্ন করে রাস্তায় ঘুরিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণের সেই নির্মম ঘটনার পর এক বছর কেটে গেল৷ ২০২৩ সালের ৩ মে এই ঘটনা ঘটে৷ উত্তর-পূর্বের বিজেপিশাসিত এই রাজ্যে জাতি সংঘর্ষ শুরুর পরের দিনই নৃশংসতার শিকার হন ওই দুই মহিলা৷ তাঁরা পুলিশের সাহায্য চেয়েছিলেন, কিন্ত্ত পাননি৷ বিজেপি সরকার বহুভাবে চেষ্টা করেছিল এই ঘটনা চেপে রাখার৷ কিন্ত্ত দু’মাসের মাথায় খবরটি প্রকাশ্যে চলে আসে৷ গোটা দেশ শিউরে ওঠে৷ আর প্রধানমন্ত্রী মোদি? কয়েক মাস পরে মিনিট দুই খরচ করে হালকা সমবেদনা ছাড়া আর কিছুই করেননি৷ এই এক বছরে তিনি একবারও মণিপুরে যাননি৷ এর মধ্যে আরও বহু মহিলা ধর্ষিত হয়েছেন, ঘরছাড়া হয়েছেন, প্রাণ হারিয়েছেন৷ আর নরেন্দ্র মোদি দেশজুড়ে মহিলাদের সঙ্গে অপরাধের অভিযুক্তদেরই বড় পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছেন৷ ব্রিজভূষণ শরণ শর্মা থেকে প্রজ্জ্বল রেভানা, মোদির নির্লজ্জতার প্রকট উদাহরণ৷

মণিপুরে সংগঠিত জাতিদাঙ্গা এক বছর পেরিয়ে গেলেও শান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়নি৷ প্রধান দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন ও বৈরিতা কমার বদলে তীব্র হয়েছে৷ একদিকে ইম্ফলের সমতল অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই জনগোষ্ঠী, অন্যদিকে পাহাড়ি অঞ্চলে সংখ্যালঘু কুকি-জো আদিবাসী জনগোষ্ঠী৷ মেইতেইরা হিন্দু আর কুকিরা খ্রিস্টান৷ উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে নানা বিষয়ে বিরোধী-সংঘাত দীর্ঘকালীন হলেও একসঙ্গেই চলছিল উভয়ের জীবনধারা৷ বিরোধী ভিন্নতার মাঝেও চলমান সেই ধারাকে তছনছ করে দেয় আরএসএস-বিজেপির কুৎসিত ও কদর্য বিভাজনের নীতি৷ এমন বিভাজনের কৌশলে মণিপুরের জনগোষ্ঠীকে একের বিরুদ্ধে অপরকে লেলিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করে বিজেপি৷ তারপর ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিভাজনকে আরও তীব্র করে তোলে ডাবল ইঞ্জিনের ষড়যন্ত্রে৷ মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে ভোটে জেতার ঘৃণ্য চেষ্টাই আজকের মণিপুরের জন্মের ইতিকথা৷ ঘৃণা ও বিদ্বেষকে এমনভাবে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়ানো হয়েছে যাতে তাদের মধ্যে শুধু সন্দেহ আর অবিশ্বাস বাড়েনি, পরস্পর পরস্পরকে শত্রু হিসবে চিহ্নিত করে ফেলে৷ বেশ সচেতন ও পরিকল্পিতভবে বিদ্বেষ-ঘৃণার যে জমি তৈরি করা হয় সেই জমিতেই গত বছর ৩ মে দাবানলের মতো ছড়িয়ে প‌ে.ড় জাতিদাঙ্গার আগুন৷ সেই আগুন এখনও জ্বলছে৷

সরকারি হিসাবে ইতিমধ্যেই মৃতু্য হয়েছে আড়াইশো মানুষের৷ গুরুতর জখম দেড় হাজারের ওপর৷ সব মিলিয়ে প্রায় এক লক্ষ মানুষ তাদের জমি-বাড়ি থেকে উৎখাত হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন৷ একাংশ চলে গেছেন পাশের রাজ্য মিজোরামে৷ কিছু চলে গিয়েছেন পাশের দেশ মায়ানমারে৷ এখনও আশ্রয় শিবিরে আছেন প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ৷ এদের প্রায় সবটাই কুকি-জো আদি জনগোষ্ঠীরা৷


আগে পাহাড় ও সমতলের সর্বত্র মেইতেই ও কুকিরা মিলেমিশে বসবাস করত৷ এখন সমতলে কুকিরা নিষিদ্ধ আর পাহাড়ে মেইতেইরা৷ এমনকী মেইতেই পুলিশ ও সরকারি কর্মীরা কুকি এলাকায় কাজ করতে পারে না৷ আরএসএস-বিজেপি মদত দেয় মেইতেইদের৷ কারণ তারা হিন্দু এবং সংখ্যায় বেশি৷ তাদের ভোটে মেরুকরণ হলেই বিজেপির ভোটে জেতা নিশ্চিত৷ আর এই বিভাজন স্থায়ী করতে পারলে ক্ষমতাও থাকবে হাতের মুঠোয়৷

এমন ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থেই মণিপুর নিয়ে মোদি নীরব৷ সমস্যার সমাধানে তাঁর সরকার কোনও ব্যবস্থা নেয়নি৷ গত এক বছরে একদিনের জন্যও মণিপুরে গিয়ে সেখানকার বিপন্ন মানুষকে আশা ও ভরসা জোগাননি৷ একই দেশের নাগরিক, একই রাজ্যের বাসিন্দা দুই জনগোষ্ঠীকে এইভাবে আড়াআড়িভাবে ভাগ করে ক্ষমতার রাজনীতিকে পুষ্ট করছেন মোদি৷ একবারও ভাবছেন না সেখানকার অসহায় গরিব মানুষগুলির কথা৷ জাতিদাঙ্গায় তারা মারা যাক, আর মস্তিতে থাকবে মোদির দল৷

মণিপুর সংহতি দিবস পালনেও দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছিল দূরত্ব৷ দিল্লির যন্তরমন্তরে সকালে কুকি ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে সংহতি দিবস পালন করা হয় ৩ মে৷ ওইদিনই বিকেলে একই স্থানে মেইতেই ছাত্র সংস্থার পক্ষ থেকে অনুষ্ঠান করা হয়৷ মণিপুরের বিভিন্ন শহরে শান্তির আহ্বান জানিয়ে সাইকেল মিছিল ও পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়৷

বিভাজনের লক্ষ্যে মোদির ডবল ইঞ্জিন সরকার জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদী-দুষ্কৃতীদের ধরছে না৷ তাদের হাতে থাকা বিপুল অস্ত্রশস্ত্রও উদ্ধার করছে না৷ আসলে দাঙ্গা লাগিয়ে রেখে ক্ষমতায় থাকাটাই আসল উদ্দেশ্য৷ মণিপুরের মানুষ মরুক-বাঁচুক তা নিয়ে মোদি-শাহদের কোনও মাথাব্যথা নেই৷