নিজস্ব প্রতিনিধি– প্রথম দফা নির্বাচনের ঠিক একদিন আগে ইস্তাহার প্রকাশ করলো তৃণমূল কংগ্রেস৷ প্রায় একশো পাতার ইস্তেহারের শুরুতেই বর্ণিত হয়েছে ‘দিদির শপথ’ নামে ১০টি প্রাক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি৷ বুধবার তৃণমূল ভবনে সাংবাদিক বৈঠক করে সেই ইস্তাহার প্রকাশ করলেন রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তথা দলের বর্ষীয়ান নেতা এবং মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা অমিত মিত্র, সঙ্গে ছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ তথা দলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ’ও ব্রায়েন এবং রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য৷ তৃণমূলের তরফে ইস্তাহারে যে ১০টি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলি নিম্নরূপ –
১. বর্ধিত আয়, শ্রমিকের সহায়
সমস্ত জবকার্ড হোল্ডারদের ১০০ দিনের গ্যারান্টি যুক্ত কাজ প্রদান করা হবে৷ দেশের সর্বত্র শ্রমিকদের বর্ধিত নূ্যনতম মজুরি হবে দৈনিক ৪০০ টাকা৷
২. দেশ জুডে় বাডি় হবে সবারই
দেশের সকল দরিদ্র পরিবারের জন্য আবাসন নিশ্চিত করা হবে৷ প্রত্যেককে নিরাপদ ও পাকা বাডি় প্রদান করা হবে৷
৩. জ্বালানির জ্বালা কমবে, দেশের জ্বালা ঘুচবে
দারিদ্রসীমার নীচে থাকা পরিবারগুলিকে বছরে ১০টি করে রান্নার গ্যাস বিনামূল্যে দেওয়া হবে, যাতে পরিশ্রুত রান্নার জ্বালানি পেতে পারেন সকলেই৷ এর মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব রন্ধনের অভ্যাস বাড়ানো হবে৷
৪. অনেক হয়েছে শাসন, এবার দুয়ারে রেশন
প্রতি মাসে রেশন কার্ড হোল্ডারদের বিনামূল্যে ৫ কেজি রেশন দেওয়া হবে, তাতে থাকবে চাল, গম, শস্য৷ প্রত্যেক সুবিধাভোগীর বাডি়র দোরগোড়ায় বিনামূল্যে পৌঁছে দেওয়া হবে এই রেশন৷
৫. আমাদের অঙ্গীকার, নিরাপত্তা বাড়বে সবার
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যুবকদের উন্নতির স্বার্থে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি, তফসিলি জাতি এবং উপজাতিদের জন্য উচ্চশিক্ষা বৃত্তি বাড়ানো হবে৷ ৬০ বছরের বেশি বয়সিদের বার্ধক্যভাতা বৃদ্ধি করে প্রতি মাসে ১০০০ টাকা করে দেওয়া হবে৷ বছরে ১২০০০ টাকা পাবেন তাঁরা৷
৬. বর্ধিত আয় নিশ্চিত, ফুটবে হাসি অন্নদাতার
স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, ভারতীয় কৃষকদের জন্য নূ্যনতম সহায়ক মূল্য প্রদানের আইনগত গ্যারান্টি, যা সমস্ত ফসল উৎপাদনের গড় খরচের চেয়ে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বেশি ধার্য করা হবে৷
৭. স্বল্প মূল্যে পেট্রোপণ্য, ভারতবর্ষে সকলে ধন্য
পেট্রোল, ডিজেল এবং এলপিজি সিলিন্ডারের দাম সাশ্রয়ী মূল্যে সীমাবদ্ধ করা হবে৷ দামের ওঠানামা পরিচালনা করার জন্য প্রাইস স্টেবিলাইজেশন ফান্ড তৈরি করা হবে দেশে৷
৮. নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ অর্জন, যুবশক্তির গর্জন
২৫ বছর পর্যন্ত সব স্নাতক এবং ডিপ্লোমা হোল্ডারকে দক্ষতা এবং কর্মসংস্থান বাড়াতে এক বছরের শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে৷ অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের সহায়তা করার জন্য মাসিক বৃত্তি প্রদান করা হবে৷ উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড প্রদান করা হবে৷
৯. স্বচ্ছ আইন, স্বাধীন ভারত
ধোঁয়াশাযুক্ত সিএএ আইন বিলুপ্ত করা হবে৷ বন্ধ করে দেওয়া হবে এনআরসি৷ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ভারত জুডে় প্রয়োগ করা হবে না৷
১০. এগিয়ে বাংলা, এগোবে ভারত
বাংলার কন্যাশ্রী প্রকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সি মেয়েদের শিক্ষার জন্য বার্ষিক ১০০০ টাকা এবং এককালীন ২৫০০০ টাকা অনুদান দেওয়া হবে৷ লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সব মহিলাকে মাসিক আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে৷ আয়ুষ্মান ভারত স্বাস্থ্য বিমার পরিবর্তে উন্নততর স্বাস্থ্যসাথী বিমা চালু করা হবে দেশে, যা ১০ লক্ষ টাকার বিমার সুবিধা প্রদান করবে৷
ইস্তাহারের প্রথম পর্যায় অর্থাৎ ‘দিদির শপথ’ পড়ে শোনান অমিত মিত্র৷ ইস্তেহারের দ্বিতীয় পর্যায় নিয়ে ব্যাখ্যা দেন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য৷ তিনি বলেন, এই দশটি শপথকে কেন্দ্র করে রয়েছে পনেরোটি অধ্যায়৷ সেগুলি হলো —
১. নিশ্চিত সুশাসন, বাংলার উন্নয়ন ২. আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি, সামাজিক সমৃদ্ধি ৩. শিল্পায়নের জোয়ার, উন্নয়ন সবার ৪. অধিক উৎপাদন, কৃষকের উন্নয়ন সাধন ৫. শিক্ষার অগ্রগতি, সমাজের প্রগতি ৬. সুস্বাস্থ্যের অঙ্গীকার, সুস্থ বাংলা সবার ৭. পরিকাঠামোয় উন্নতি, দৈনন্দিন জীবনে অগ্রগতি ৮. জাতীয় সুরক্ষায়, আমরাই করবো জয় ৯. স্বাবলম্বী নারী, জয় জয়কার তাঁরই ১০. যুবশক্তির বিকাশ, আগামীর আশ্বাস ১১. সংখ্যালঘু ও তপশিলি, সকলে মিলে এগিয়ে চলি ১২. বাংলাই গড়েছে আজ, সুরক্ষিত নতুন সমাজ ১৩. সংস্কৃতির প্রতিপালন, ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ১৪. সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পর্যটন সবার সেরা বাংলা এখন ১৫. জীব বৈচিত্র সংরক্ষিত, পরিবেশ সুরক্ষিত৷
অমিত মিত্র এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবেদন প্রসঙ্গ আলাদা করে উল্লেখ করেন৷ একই সঙ্গে বিজেপির উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘‘ইস্তাহারে বিজেপি সরকারের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি খুঁজে পাবেন৷ খুঁজে পাবেন ইচ্ছাকৃত বঞ্চনা৷ এর সঙ্গে এমন একটা মনোভাব রয়েছে যে মানুষকে অসম্মান করা৷ মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান ছিনিয়ে নিচ্ছে৷’’ বর্তমান ভারতের বেকারত্ব সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়ে অমিত মিত্র বলেন, ‘‘প্রায় ৪৫ কোটি মানুষ বর্তমানে বেকার৷ হয় তারা চাকরির বা কাজের আশা ছেড়ে দিয়েছেন, কাজ খুঁজচ্ছেন না৷ আর কিছু মানুষ বেকার৷ আইএলও এবং সিএমআই এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের মোট বেকারত্বের মধ্যে প্রায় ৪৪% শতাংশ বেকার হলেন ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী যুবক যুবতীরা৷ কিন্ত্ত বিজেপির ইস্তাহারে বেকারত্বের মতো বড়ো সমস্যার কথা উল্লেখ নেই৷’’ এরপর তিনি মূল্যবৃদ্ধি সম্পর্কে বলেন, ‘‘খাদ্যদ্রব্য ছাড়াও ১লা এপ্রিল থেকে প্রয়োজনীয় প্রায় ৮০০ থেকে ১০০০টি ওষুধপত্রের দাম বেড়েছে ব্যাপক হারে৷’’ এলপিজি সিলিন্ডার প্রসঙ্গে অমিত মিত্র বলেন, ‘‘আমরা ১০টি সিলিন্ডার বিনামূল্যে দেবো বলেছি৷ সিলিন্ডার ফ্রি তে পেলে প্রান্তিক মানুষেরা তা নেবেন৷ কাঠ জ্বালানো কমিয়ে দেবেন৷ এতে পরিবেশে যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে তা অর্থনীতিবিদরা মেপে দেখবেন৷’’ লঘু উদ্যোগ প্রসঙ্গে তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘কেন্দ্র সরকারের গবেষণা অনুযায়ী ১ কোটি টাকার বিনিয়োগে ৩৭ থেকে ৪২টি চাকরি হবে৷ কিন্ত্ত এ বছর মমতা বন্দোপাধ্যায় ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে কাজ করে দেড় লক্ষ কোটি টাকা ধার দিয়েছেন ছোট ব্যবসায়ীদের৷ এর ফলে বাংলায় বিপুল সংখ্যায় চাকরি তৈরী হবে৷’’ জিএসটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘৫ লক্ষ কোটির বেশি জালিয়াতি হয়েছে জিএসটিতে৷ কারণ কেন্দ্র সরকার ৭৪০টি বিজ্ঞপ্তি ইসু্য করেছে৷ নথিবিহীন কোম্পানি গুলি নিজের ট্রানসাকশান দেখিয়ে দিচ্ছে যে আদৌও কোনো ট্রানসাকশান হয়নি৷ এভাবেই সরকারের পয়সা অর্থাৎ আপনার আমার পয়সা ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট করে জালিয়াতি হচ্ছে৷’’ এদিন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও ইস্তেহারে বর্ণিত মহিলাদের ক্ষমতায়নের কথা তুলে ধরেন৷ তিনি বলেন, একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ই নারীদের চোখের জল মুছিয়ে দিতে পারেন৷ যেখানে প্রধানমন্ত্রীর উজ্জ্বলা যোজনা ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর অঙ্গীকার বিনামূল্যে সিলিন্ডার প্রদান করার৷ পাশাপাশি, শিক্ষাক্ষেত্রে বৃত্তি প্রদানের মাধ্যমেও মেয়েদের অংশগ্রহণকে বাড়ানো হবে৷ যুব থেকে নারী, কৃষক থেকে শ্রমিক, তপশিলি জাতি, উপজাতি কেউই বাদ যাবেন না তৃণমূল কংগ্রেসের দৃষ্টি থেকে৷