গণ আন্দোলনের নেত্রী মমতা

প্রবীর ঘোষাল

১৯৮৪ সালে প্রথম লোকসভায় পা রাখেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ কিছুদিনের মধ্যেই রাজনৈতিক মহলের মালুম হয়, বাংলার রাজনীতিতে এক জবরদস্ত জননেত্রীর আবির্ভাব হয়েছে৷ মিডিয়াও চায় এমন সুযোগ্য বিরোধী নেত্রীকে৷ সিপিএমের সঙ্গে নানা সংঘাত এবং বিতর্কের মধ্যে দিয়ে মমতা দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করেন৷ তাঁর পরিচয়ের গণ্ডি রাজ্যে ঘটিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যায়৷

স্বাভাবিকভাবেই বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে গোপনে অাঁতাত করে চলা কংগ্রেসের প্রথম সারির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার কিছুদিনের মধ্যেই চক্ষুশূল হয়ে যান মমতা৷ আড়ালে তো বটেই প্রকাশ্যে দলেরই কোনও কোনও নেতা-নেত্রী তাঁকে ব্যঙ্গ করতেন৷ কটূ মন্তব্যও তাঁদের মুখে শোনা যেত৷ অনেকেরই মনে হত মমতাকে এভাবে একঘরে করে দেওয়ার চেষ্টার ব্যাপারে নেপথ্যে সিপিএম নিশ্চয়ই কলকাঠি নাড়ছে৷ সেই সময় কোনও কোনও কংগ্রেস নেতা একান্তে বলতেন, ‘পাঁচ বছরের রাজনীতি৷ লোকসভার সদস্যদের মেয়াদ ফুরোলেই মমতাও ফিনিস৷ আর ওকে খুঁজে পাওয়া যাবে না৷’


১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মমতা হেরে যান৷ যাদবপুর কেন্দ্রে সেবার কী ধরনের সন্ত্রাস, রিগিং সিপিএম চালিয়েছিল, আজও মানুষ ভুলতে পারে না৷ এবপারও লোকসভা নির্বাচনের আগে এই আসনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে লাল পার্টি জেতার স্বপ্ন বাজারে ফেরি করেছিল৷ ভোটের ফল হল, তাদের জয়ের মার্জিন ৫ লক্ষ ভোটেরও বেশি৷ গোহারা সিপিএম৷ এখনও পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে তাদের৷ জোড়াফুলের বিপুল ভোটে জয় যাদবপুরে ……… প্রমাণ করল, তারা মমতাকে ভোলেনি৷

যাই হোক, লোকসভা নির্বাচনে সেবার মমতাকে হারিয়ে যে হিতে বিপরীত হল, সিপিএমের মতো কংগ্রেসেরও টের পেতে দেরি হল না৷ আরও জঙ্গী, আরও আক্রমণাত্মক মমতা৷ জলনেত্রীর একের পর এক প্রতিবাদী আন্দোলনে আতঙ্কিত আলিমুদ্দিন স্ট্রিট৷ অবশ্য মুখে তারা দেখাতে চাইত, মমতাকে পার্টি উপেক্ষা করছে৷ সেই সময় প্রবীণ বামপন্থী নেতা এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের কর্ণধার অশোক ঘোষ একদিন একান্ত আলোচনায় আমাকে বলেছিলেন, ‘মমতা সম্পর্কে আমাদের (বামফ্রন্ট) মূল্যায়ন মনে হয় সঠিক হচ্ছে না৷ খুব দ্রুত রাজ্যের বামবিরোধী আমজনতা ওকেই অাঁকড়ে ধরছে৷ বামপন্থীদের ধাঁচেই মমতা নিজের লড়াকু ইমেজ তৈরি করে ফেলছে৷ ওর জনপ্রিয়তা আমরা ঠিকমতো জরিপ করতে পারছি না৷
কেবল অশোকবাবু নন, বামফ্রন্টের একাধিক অ-সিপিএম নেতা মনে করতেন, ‘মমতাকে নানাভাবে আক্রমণে গিয়ে, তাঁরই সুবিধা করে দেওয়া হচ্ছে৷ বাম-বিরোধী মানুষের কাছে মমতার গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যাচ্ছে৷ কিন্ত্ত চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী৷ মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু থেকে শুরু করে পার্টির লোকাল, জোনাল, জেলা কমিটির অখ্যাত কর্মকর্তারাও সর্বদা মমতার বিরুদ্ধে কুৎসা এবং কুৎসিত সমালোচনায় মুখর৷ বারে বারে তাঁর ওপর অমানবিক হামলা মোটেই প্রমাণ করেছে৷

মমতাকে থামাতে সিপিএম কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, ১৯৯০ সালে, ১৬ আগস্টের ঘটনা৷ ওইদিন ছিল বালা বন্ধ৷ যারা বন্ধ ডেকেছিল, সেই কংগ্রেসের নেতা-নেত্রীরা সেদিন কলকাতায় বলতে গেলে রাস্তাতেই নামেননি৷ কিন্ত্ত ব্যতিক্রমী ছিলেন মমতা৷ তিনিই বনধের সমর্থনে কালীঘাট থেকে মিছিল নিয়ে বেরিয়েই হাজরা মোড়ে মিছিল পৌঁছতেই আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকা হার্মাদ বাহিনী পৈশাচিক হামলা চালায়৷ মমতাকে রাস্তায় ফেলে পেটানো হয়৷ রড-লাঠি অবাধে ব্যবহার করা হয়৷ জননেত্রীর মাথায় সজোরে ডান্ডা মেরে তাঁকে সেদিন হত্যার চেষ্টাও সিপিএম করেছিল বলে অভিযোগ ওঠে৷
অবস্থা বেগতিক বুঝে ঢোক গিলে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু স্বীকার করে নেন, তাঁদের হার্মাদরাই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে৷ কিন্ত্ত ঘটনার পরের দিন বামফ্রন্টের বৈঠকে সিপিএম বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে হিংসার সবচেয়ে ঘৃণ্য ঘটনার কোনও নিন্দা করেনি৷ বৈঠকের পর ফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘মমতার ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে কেউ বৈঠকে কোনও নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করেনি?’ বিমানবাবু সাফ জানিয়ে দেন, ‘না৷’ আরও আছে৷

ঘটনার কয়েকদিন পর পার্কসার্কাস ময়দানে সিপিএমের একটি সভা ছিল৷ মুখ্য বক্তা জ্যোতি বসু৷ মুখ্যমন্ত্রী সেই সভা শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমেছেন৷ সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, মমতার ওপর হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত এক পার্টি নেতা আপনার মঞ্চের সামনেই বসে আছেন৷ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করছে না কেন? জ্যোতিবাবু কিছুটা রাগত স্বরে জবাব দিয়েছিলেন, এক অর্থে ‘আরে নাম থাকলেই তাকে গ্রেফতার করতে হবে নাকি?’ ভাবুন পরিস্থিতিটা৷ এখন তো টেলিভিশনের টক শো’তে দেখা যায় সিপিএমের ছোটবড় সব নেতাই রাজ্যে ‘সন্ত্রাস’ নিয়ে সরব৷ গণতন্ত্রকে হত্যা করা হচ্ছে বলে তাঁরা অবিরাম অভিযোগ করে চলেছেন৷ অথচ বাম জমানায় মমতার ওপর ওই নৃশংস হামলাকে কীভাবে সিদিফন এবং প্রশাসনের কর্তাব্যক্তরা উপেক্ষা করেছিল সেটা কি মানুষ ভুলে যাবে?

তবে হাজরা মোড়ের ঘটনার পর রাজ্যজুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল তা বুঝতে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বেড়াল তপস্বীদের বিশেষ বেগ পেতে হয়নি৷ কিছুটা সুস্থ হয়েই মমতা বেরিয়ে পড়েন জেলা সফরে৷ যেখানেই মমতা, সেখানেই জনসমুদ্র৷ জানা যায় গুরুতর আঘাত পাওয়ার পর নেত্রী প্রায় ৪ মাস বিশ্রামে ছিলেন৷ তারপর শুরু করেন কর্মসূচি৷ প্রথম জেলা সফর ছিল বহরমপুর৷ মুর্শিদাবাদের সেই সফরে মমতার সঙ্গী ছিলাম আমিও৷ নেত্রীর গাড়িতে একসঙ্গে নিয়েছিলেন আরও দুই বর্ষীয়ান সাংবাদিক মিহির গঙ্গোপাধ্যায় এবং আশিস ঘোষ৷

বহরমপুর শহরের সেই সভা ছিল ঐতিহাসিক৷ এত ভিড় যে খোদ মমতাকেই সভার মঞ্চ পর্যন্ত নিয়ে যেতে উদ্যোক্তা এবং পুলিশ নাস্তানাবুদ হয়েছিল৷ মাঠের আশেপাশের বাড়ির ছাদ, গাছের ডালপালা, সবকিছুই যেন মানুষের মাথার দখলে চলে গিয়েছিল৷ তৎকালীন বিধানসভার বিরোধী দলনতা আবদুস সাত্তার ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার মানুষ৷ তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘ইন্দিরা গান্ধি, রাজীব গান্ধির সভাও দেখেছি, কিন্ত্ত মমতার জনসভা যেন সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে৷’

জেলায় জেলায় মমতার ওইসব রেকর্ড ভাঙা জনপ্লাবন সিপিএমের পাশাপাশি ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছিল রাজ্য কংগ্রেসের একাধিক নেতার৷ নেত্রীকে ঠেকাতে তাঁদের গোপন-অাঁতাত আরও গভীর হয়ে যায়৷ কারণ, দু’পক্ষের লক্ষ্য তো এক৷ ১৯৯১ সালের লোকসভা নির্বাচনের মুখে আততায়ীর গুলিতে অকালে চলে গেলেন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি৷ মমতাকে সেসময় বেশ মুষড়ে পড়তে দেখেছি৷ রাজীবের রাজত্বে গান্ধি পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে যান মমতা৷ যেন একজন দাদা, আর অন্যজন নিজের বোন৷

প্রধানমন্ত্রী হলেন নরসিমহা রাও৷ মমতাকে মন্ত্রী করে এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে চেয়েছিলেন এই তেলেগু ব্রাহ্মণ৷ যেমন এক, সিপিএমকে চাপে রাখা৷ দুই, আন্দোলনের রাস্তা থেকে তুলে এনে মমতাকে মনিত্রত্বের মোহজালে জড়িয়ে ফেলা৷ তিন, রাজ্যের কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে বাম-বিরোধী মনোভাবকে উৎসাহ দেওয়া৷ কিন্ত্ত নরসিমহার চাতুরি অচিরেই ধরে ফেলেন মমতা৷ তিনি বুঝে যান, আসলে সিপিএমের সুবিধা করে দিতেই মন্ত্রী করে তাঁর পায়ে বেড়ি পরানো হয়েছে৷ অবশ্য লালপার্টিকে তোয়াজ করা ছাড়া প্রধানন্ত্রীর বিকল্প কোনও পথ ছিল না৷ কারণ, কেন্দ্রের সরকার ছিল সংখ্যালঘু৷ বামপন্থীদের সমর্থন ছাড়া নিজের সরকার টিকিয়ে রাখা নরসিংহার পক্ষে সম্ভব ছিল না৷

ইতিহাসের নতুন নতুন অধ্যায়ে সৃষ্টি করেই আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে অধিষ্ঠান করছেন মমতা৷ বছর দেড়েক মন্ত্রী থাকাকালে মমতা বুঝলেন, কেন্দ্রীয় সরকারকে বগলে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম আরও বেপরোয়া সন্ত্রাস চালাচ্ছে৷ নিজেই মনে মনে দাওয়াই বাতলে ফেললেন৷ ১৯৯২ সালের ২৫ নভেম্বর ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে জনসভা ডাকলেন৷ সম্পূর্ম একক প্রচেষ্টায় সেই সভাকে ঐতিহাসিক করে তুললেন৷ একদিকে ভিড়ের বহরে এবং আর অন্যদিকে প্রকাশ্যে এক ঘোষণার মাধ্যমে৷ কংগ্রেস দলগতভাবে বাম জমানায় কলকাতায় এমন বৃহৎ আকারের জনসভা করার হিম্মৎ দেখাতে পারেনি৷ আর সেই জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে মমতা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফার কথা ঘোষণা করেছিলেন৷

কারণ? নিজেই কারণ জানিয়ে মমতা বলেছিলেন, ‘মন্ত্রিত্ব থেকে সিপিএম-বিরোধী আন্দোলনের জন্যে আমার নানা অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছিল৷ সেটা থেকে মুক্ত হয়ে মাঠে নামতেই ইস্তফা৷’ পরের বছর ১৯৯৩ সালে রাজ্যজুড়ে আন্দোলনের প্রস্ত্ততি হিসেবে জেলায় জেলায় ঘুরতে লাগলেন৷ বিশেষ করে সিপিএমের সন্ত্রাস-কবলিত অঞ্চলগুলি ছিল তাঁর টার্গেট৷ আসলে কংগ্রেসের অধিকাংশ নামকরা নেতা-নেত্রীরা তকন কেনা গোলাম৷ একমাত্র মমতাই জনতাকে মাতিয়ে রেখেছিলেন৷

এভাবেই আন্দোলন তুঙ্গে তুলে তিনি ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই কর্মসূচির ডাক দিলেন৷ তখন তিনি রাজ্য যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী৷ অবশ্য প্রথমে ঘোষণা হয়েছিল, ১৪ জুলাই হবে ‘মহাকরণ অভিযন’ কর্মসূচি৷ কিন্ত্ত তৎকালীন রাজ্যপাল নুরুল হাসানের মৃতু্যর কারণে দিনবদল হয়৷ ঠিক হয়, মমতার কর্মসূচি হবে ২১ জুলা‌ি৷ সেদিন আর এক ইতিহাস তৈরি করেছিলেন জননেত্রী৷ কালীঘাটের বাড়ি থেকে মমতার রওনার সঙ্গী এবং সারাদিনের ঘটনার সাক্ষী ছিলাম আমি৷ কী কী ঘটেছিল, প্রতক্ষেদর্শীর বিবরণ বিভিন্ন লেখায় লিপিবদ্ধ করেছি৷ ১৩ শহিদের তর্পণ যে দেশের সবচে‌ে? আগে করা উচি, সেই কংগ্রেস আজ সিপিএমের সঙ্গী৷ আর মমতা রয়েছেন, সেই রাজপথে৷ মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যিনি অতীতকে ভুলে যাননি৷