নিজস্ব প্রতিনিধি: তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দোপাধ্যায় হলেন একেবারে ‘প্রাকটিক্যাল’ রাজনৈতিক নেতৃত্ব। বহু অভিজ্ঞতা সম্পন্ন রাজনৈতিক নেতারাও হার মানেন অভিষেকের রাজনৈতিক চিন্তা এবং পরিকল্পনার কাছে। নির্বাচনী প্রচার চালানোর সময় যে নির্দেশ গুলি দলীয় নেতৃত্বদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দোপাধ্যায় যৌথ ভাবে দিয়েছিলেন, তা একে একে পূরণ করছেন দলীয় নেতৃত্বগণ। সেই নির্দেশের মধ্যে অন্যতম ছিল ‘যাঁরা ভালো কাজ করেছেন তাঁদের পুরস্কৃত করা’ এবং ‘দলীয় গদ্দারদের দল থেকে বহিস্কার করা’। এবার বীরভূম, উত্তরবঙ্গের কিছু জেলা সহ বাংলার বিভিন্ন কোনায় বাস্তবায়িত হচ্ছে সেই নির্দেশ। মূলত এবার অভিষেকের ‘পারফরমেন্স থিওরি’ই ছিল তৃণমূলের জয় ছিনিয়ে নেওয়ার এক ফ্যাক্টর। দলীয় সেনাপতির সোজা হিসেবে, কাজ করো নয়তো পদ থেকে সরে যাও। সেই ‘কর্পোরেট কায়দা’ই যেন বাস্তবায়িত হচ্ছে তৃণমূলের অন্দরমহলে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নির্বাচনী প্রচার চালানোর সময় দলীয় নেতা, কর্মীদের নিয়ে একাধিক অভ্যন্তরীন পর্যালোচনা বৈঠক করেছিলেন অভিষেক। নিজ গড় ডায়মন্ড হারবারে সেই বৈঠক করেই প্রথম অভিষেক স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, দলের প্রত্যেক নেতা, কর্মীদের সক্রিয় থেকে মাঠে-ময়দানে নেমে কাজ করতে হবে। যে লোকসভা কেন্দ্রের নির্দিষ্ট বিধানসভা, পঞ্চায়েত অঞ্চল থেকে ফলাফল ভালো হবে না সেখানেই বুঝতে হবে দলীয় নেতৃত্ব এবং কর্মীগণ যথাযথ নিজ দায়িত্ব পালন করেননি। যাঁরা নিজ কার্যে গাফিলতি করবে বা দায়িত্ব পূরণে খামতি রাখবে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে দল। প্রয়োজনে পদ থেকে সরিয়েও দেওয়া হতে পারে নির্দিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের। এরপরও বিভিন্ন বৈঠক থেকে এই একই নির্দেশ দিয়েছেন অভিষেক। পাশাপাশি ‘সেটিং তত্ত্ব’ এর অভিযোগ তুলেও সরব হয়েছিলেন মমতা, অভিষেক সহ অন্যান্য দলীয় নেতৃত্বগণ। মিনাখাঁর নির্বাচনী জনসভা থেকে মিনাখাঁর তৃণমূল বিধায়ক উষারানি মণ্ডল এবং তাঁর স্বামী মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে বিজেপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুলে মমতা বলেছিলেন, “তৃণমূলের এমএলএ থাকবেন কিন্তু মিটিংয়ে আসবেন না, তা চলবে না। যতক্ষণ ক্ষমা চেয়ে পায়ে না ধরবে, ততক্ষণ উষারানি মণ্ডলের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। যাঁরা বিজেপির সাথে আতাত করে আমার তাঁদের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। আপনাদের মতো লোক চাই না।” ঠিক এরপরই একই অভিযোগ তুলে সোনারপুরের নির্বাচনী জনসভা থেকে মমতা বলেছিলেন, “দু, একজন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে আমার কাছে অভিযোগ এসেছে। আমি তাঁদের বলবো, হয় শুধরে নেবে নয়তো আমি শুধরে দেবো।” বিভিন্ন জনসভা থেকে অভিষেক বলেছিলেন, “জনতা কর্তৃক নির্বাচিত হওয়ার পর আমাদের একটাই কাজ, মাথানত করে জনস্বার্থে কাজ করা। কেউ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে বা মানুষের সাথে গদ্দারি করলে দল তা বরদাস্ত করবে না।” এখানেই শেষ নয়, বিষ্ণুপুর কেন্দ্রের তৃণমূলের পরাজিত প্রার্থী সুজাতা মন্ডলও নিজ পরাজয়ের পর দলীয় বিধায়কদের বিরুদ্ধেই সরব হয়েছিলেন। তিনিও ‘সেটিং তত্ত্ব’ এর অভিযোগ এনেছিলেন। এবার একই অভিযোগ তুলে কিছু তাবড় নেতৃত্বদেরই দল থেকে সাসপেন্ড করলেন বীরভূমের নবনির্বাচিত সাংসদ শতাব্দী রায়।
ভোট মিটতেই এক অভিনব চিত্র দেখা গেলো তৃণমূলে। যেসকল দলীয় নেতৃত্বগণ তৃণমূলের জয়ের পথ কে সুগম করেছেন নিজ অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তাঁদের করা হচ্ছে পুরস্কৃত, আবার যাঁরা বিরোধীদের সঙ্গে ‘সেটিং’ করে বিরোধীদের হাত শক্তিশালী করেছেন তাঁদের দলে ঠাঁই টুকু দেওয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি বীরভূমের দুবরাজপুর বিধানসভার অন্তর্গত খয়রাশোলে ভোট পরবর্তী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন শতাব্দী। সেখানে দলের ‘বিভীষণদের’ উদ্দেশ্যে কড়া বার্তা দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা দলের জন্য ভোট করি। আগে যা হতো না এবার তাই হবে। যাঁরা দলে থেকে দলের সঙ্গে বেইমানি করেছে তাঁদের আগে তাড়ানো হতো না। এবার তাঁদের তাড়ানো হবে। দলে থেকে যাঁরা অন্য দলের হয়ে ভোট করিয়েছে তাদের দল থেকে তাড়াব। এটিই মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আদেশ এবং অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের ভাবনা।” ঠিক তার কয়েক ঘন্টা পরই জানা যায়, বীরভূমের রামপুরহাট ১ নং ব্লকের আয়াশ পঞ্চায়েতের দাপুটে তৃণমূল নেতা আকবর আলম কে দল বিরোধী কাজের অভিযোগে ছ’বছরের জন্য দল থেকে সাসপেন্ড করা হলো। শতাব্দী স্পষ্ট জানান, “দলের সিদ্ধান্তে আমি খুশি। বিভিন্ন জায়গা থেকে তালিকা আসছে, সেটি পৌঁছে যাচ্ছে দলের কোর কমিটির কাছে। কোর কমিটি তারপর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।” এখানেই শেষ নয়, শনিবার দুবরাজপুরে শাসক শিবিরের তরফে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানেই দুবরাজপুরের সেরা তিন ‘স্ট্রাইকারকে’ মেডেল দেন শতাব্দী। ভোট রাজনীতির ময়দানে যাঁরা সেরা স্ট্রাইকার হিসেবে উঠে এলেন, এবার তাঁদের সম্মানিতও করা হল।
দুবরাজপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে যে তিনটি অঞ্চল সবথেকে বেশি লিড দিয়েছে এবারের ভোটে, সেই তিনটি অঞ্চলের নেতৃত্বের হাতে তুলে দেওয়া হয় এই সোনালি রঙের মেডেল। এক কথায়, ‘নতুন ভাবনা’ তৃণমূলে। তবে এই ভাবনার নেপথ্যে আছেন কে? অবশ্যই, অভিষেক বন্দোপাধ্যায় এবং তাঁর রাজনৈতিক গুরু মমতা বন্দোপাধ্যায়। বীরভূমের হাত ধরেই শুরু হলো এই নতুন পথ চলা। মমতা-অভিষেকের নির্দেশ কে বাস্তবায়িত করে শতাব্দী তথা তৃণমূল বুঝিয়ে দিল দলে ‘বিভীষণ’দের কোনো জায়গা নেই। বদলের পালা আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদেও। ২০১১ সাল থেকেই এই পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন রানীগঞ্জের বিধায়ক তাপস বন্দোপাধ্যায়। এবারের লোকসভা ভোটে তাঁর বিধানসভা কেন্দ্রেই ভরাডুবি হয়েছে তৃণমূলের। তারপরই তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো তাঁকে। তাহলে সেই ধাক্কার মাসুলই কি গুনছেন তাপস? এই বদলের ঢেউ উত্তরবঙ্গেও। শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন সৌরভ চক্রবর্তী। এবারে নবান্নের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হলো, এই চেয়ারম্যানের অতিরিক্ত দায়িত্ব সামলাবেন দার্জিলিং এর জেলাশাসক। এখন স্বভাবতই বলা যায়, অভিষেক ফর্মুলার কোপের ভয়ে কাঁপছেন ‘দায়িত্বহীন’ দলীয় নেতৃত্বগণ। অভিষেকের এই কড়া ভাবনাই তৃণমূলকে আরও শক্তিশালী করতে পারে, এমনটাই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।