মমতা-অভিষেকের যুগলবন্দি প্রচার বিরোধীদের বেকায়দায় ফেলেছে

প্রবীর ঘোষাল

১৯৪৮ সালে যাদবপুর কেন্দ্রে সিপিএমের ‘বাঘা ব্যারিস্টার’ প্রার্থী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে হারিয়ে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ সেই জয়ের পর ‘জায়েন্ট কিলার’ সম্মান আদায় করেন কালীঘাটের নেত্রী৷

পরবর্তীতে যাদবপুরের কেন্দ্র ছেড়ে দক্ষিণ কলকাতা থেকে দক্ষিণ কলকাতা থেকে টানা ৬ বার লোকসভার নিয়েছেন মমতা৷ সিপিএমের বল্গাহীন সন্ত্রাস এবং নগ্ন রিগিংয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে তিনি এই সাফল্য অর্জন করেছেন৷ বলা হত, দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রে কেউ পর পর দু’বার জেতেননি, সেই রেকর্ড মমতা বাম জমানাতেই ভেঙে খান খান করে দিয়েছিলেন, ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে হার্মাদদের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসকে হারিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের একমাত্র জয়ী সাংসদ হয়েছিলেন মমতাই৷


সাংবাদিক হিসাবে মমতার সেই সময়ের সবকটি নির্বাচনী লড়াই কাছ থেকে দেখেছি৷ যাদবপুুর থেকে শুরু করে দক্ষিণ কলকাতার ৬ বারের ভোট যুদ্ধে তাঁর একটিই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছি৷ পরিশ্রম৷ প্রচারে পাড়ায় ঘুরে বেড়ানো৷ একেবারে ভোটারদের কাছে সরাসরি চলে যাওয়া, তাঁদের ঘরের মেয়ে হয়ে যাওয়া৷

যাদবপুরে নিজের বাড়িতে বসে সোমনাথবাবু যখন দম্ভের সঙ্গে মমতাকে উপেক্ষা করেছিলেন, প্রতিপক্ষ প্রার্থী তখনও মানুষের ঘরে ঘরে কড়া নাড়ছিলেন৷ ভোটাররা তো আগে কখনও তাদের কেন্দ্রে এমপি-কে এভাবে দেখতেই পায়নি৷ আসলে কোনও নির্বাচনকেই মমতা হালকা করে দেখেননি৷

মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও তাঁর স্বভাবের কোনও পরিবর্তন হয়নি৷ পঞ্চায়েত, পুরসভা, বিধানসভা এবং লোকসভা, কোনও নির্বাচনেই মমতার প্রচার পদ্ধতিতে কোনও গলদ নেই৷ বিগত লোকসভার নির্বাচনে এরাজ্যে বিজেপি কিছুটা ধাক্কা দেয় তৃণমূল কংগ্রেসকে৷ শিক্ষা নেন মমতা৷ দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে নিবিড় জনসংযোগ পরিকল্পনা এবং কর্মসূচী গ্রহণ করেন তিনি৷ প্রশাসনিক দিক থেকেও সমাজকল্যাণ নানা প্রকল্পকে দ্রুত বাস্তবায়িত করায় জোর দেওয়া হয়৷ প্রতি মাসে জেলায় জেলায় ঘুরে মুখ্যমন্ত্রী নিজে সেসব প্রকল্পের নজরদারি করেছেন৷ আর অভিষেক একটা কাজ করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সংগঠনকে সক্রিয় রাখতে৷ এবার ভোটের প্রচারেও মমতা-অভিষেকের যুগলবন্দি সারা দেশে রাজনীতিক মহলে রীতিমতো সোরগোল ফেলে দিয়েছে৷ জনমনে দাগ কাটতে নিখঁুত কৌশল৷ প্রতিপক্ষের শক্ত ঘাঁটিগুলিতে প্রচারে মমতা-অভিষেকের বিশেষ নজর৷ উত্তরবঙ্গে পাঁচ বছর আগের লোকসভা নির্বাচনে ৭টি আসনে দখল কায়েম করেছিল বিজেপি৷ গেরুয়া শিবির মনে করে উত্তরবঙ্গে এবার আর সেই ফল হবে না৷ কারণ ভোটের আগে সেভাবে কোচবিহার থেকে মালদহ পর্যন্ত মমতা-অভিষেক চষে বেড়িয়েছেন, তাতে জোড়াফুলের ঝড় উঠে গিয়েছে৷

৩১ মার্চ কৃষ্ণনগর থেকে প্রচার শুরু করেন মমতা৷ সেদিন ফিরে এসেছিলেন কালীঘাটে৷ কিন্ত্ত ঝড় জলে জলপাইগুড়ির ভয়ঙ্কর অবস্থা শুনে সেই রাতেই মুখ্যমন্ত্রী পেঁৗছে যান ঘটনাস্থলে৷ দেশের কোনও মুখ্যমন্ত্রী পারবেন? ৩ দিন পরে জলপাইগুড়ি থেকে চলে যান কোচবিহারের প্রচারে৷ তীব্র দাবদাহ উপেক্ষা করে ৪২টি কেন্দ্রেই মমতা টার্গেট কমপক্ষে ২টি জনসভা৷ কোথাও কোথাও পদযাত্রা বিরোধীদের দখলে থাকা কোনও কোনও কেন্দ্রে ২টির বেশি সভাও করেছেন৷ যেমন উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জে ৪টি এবং দক্ষিণবঙ্গে হুগলি কেন্দ্রে ৩টি সভা করেছেন মমতা৷ প্রায় ১০০ ছুঁই ছুঁই তাঁর সভা পদযাত্রার সংখ্যা৷

দিনে তিনটে সভা করে আবার বিকালে পদযাত্রাও করছেন৷ এই তো সেদিন হাওড়ায় পদযাত্রার আগে দুর্বিসহ গরমে দিনের সভা শেষ করে, সন্ধ্যায় রাস্তায় নামেন৷ কার্যক্রম শেষ করে মমতা ফিরে যাচ্ছিলেন কালীঘাটে হঠাৎ মনে পড়ল, হাওড়ার পিলখানা বস্তি অঞ্চলের কথা৷ ড্রাইভারকে বললেন, গাড়ি ঘোরাও৷ সেই মতো ফের হাজির হলেন হাওড়ায় এবং পিলখানায় পদযাত্রা করলেন৷

আগেই বলেছি, কোনও ভোটকেই তৃণমূলনেত্রী তুচ্ছতাচ্ছিল করেন না৷ নির্বাচন মানে মমতার অভিধানে যুদ্ধ৷ সেই যুদ্ধে এবার তাঁর বাড়তি শক্তি একসঙ্গে অভিষেক৷ কোনও সন্দেহ নেই, এবার মমতা অভিষেকের যুগলবন্দি প্রতিপক্ষ শিবিরকে প্রচারে রীতিমতো বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে৷