মহারাজ, একি সাজে, এলে হৃদয়পুর মাঝে

‘শারদোৎসব’, ‘রাজা’ আর ‘ডাকঘর’— এই তিনটি রবীন্দ্রনাটকে যে রাজার উপস্থিতি, তিনি অন্তরালে থাকলেও প্রকাশ্যে আসেন একসময়৷ জীবনে গভীর গহন যে পথ, যেখানে গিয়ে না দাঁড়ালে পাওয়া যায় না তাঁকে, সেই পথ তো উন্মুক্ত নয়৷ তাঁকে খুঁজতে জানতে হয় ভিতরের চলন৷ এই তিনটি নাটককে বিশ্লেষণ করে সেই রাজাকে চেনার পথটি দেখাতে চেয়েছেন ঈশা দেব পাল

অবিশ্বাসী আর বিশ্বাসীরা
‘চুপ কর অবিশ্বাসী, কথা বোলো না৷’— কে এই অবিশ্বাসী? কেন বলা হল একথা৷ ‘ডাকঘর’ পাঠ্যতালিকায় থাকা সকল ছাত্রকে একবার না একবার লিখতে হয় এর উত্তর৷ বাঁধা গতের সেইসব উত্তরের মধ্যে কি আদৌ স্থান পায় বিশ্বাসীর আলো কিংবা অবিশ্বাসীর অন্ধকার? রাজার পাঠানো চিঠির সাদা পাতায় যখন স্পষ্ট অক্ষর দেখেন ঠাকুর্দা তখন তা নিয়ে মাধব দত্ত সংশয় প্রকাশ করলে ঠাকুর্দা তাকে ‘অবিশ্বাসী’ বলেন৷ রাজা আছেন, তিনিই সেই ‘অন্তরতম’, যিনি অনায়াসে চিঠি পাঠাতে পারেন জানালার ধারে বসে থাকা রোগক্লিষ্ট অমলকে, তাঁকে ভালোবাসতে না পারলে দেখাও যায় না তাঁর চিঠি৷ ‘ডাকঘর’-এর মাধব দত্ত কিংবা ‘শারদোৎসব’-এর লক্ষেশ্বররা যে চোখে যা দেখা যায় শুধু তাকেই বিশ্বাস করে৷ তা-ই তো সব ‘অলক্ষ্য রং’ কিংবা ‘অশ্রুত’ সুর তাদের চেনাজানার বাইরে৷ ঠাকুর্দা যে অচিন দেশের মানুষ তাঁর কাছে তো এঁরাই ‘অবিশ্বাসী’৷ অথচ ‘গীতাঞ্জলি’র এই গান— ‘প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে/ প্লাবিত করিয়া নিখিল দু্যলোক-ভূলোকে/ তোমার অমল অমৃত পড়িছে ঝরিয়া৷’ যেন ধারণ করে থাকে ‘ডাকঘর’-এর বালক অমল৷

রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ (১৯১২) পর্বের আগেই যে লেখা হয়েছে ‘গীতাঞ্জলি’র গান৷ (১৯০৮-৯), তার অল্প ক’দিন পরে প্রকাশ পাচ্ছে ‘গীতিমাল্য’ (১৯১৪), ‘গীতালি’ (১৯১৪)৷ অমলের যে এই বিশ্বসংসারের প্রতি মুগ্ধতা ভালবাসা, যা বুঝে উঠতে পারে না তার পিসেমশাই মাধব দত্ত, কিংবা গ্রামের মোড়ল, সেই দেখা-নাদেখাকে কি বাঁধা উত্তর কিংবা একটা প্রতিবেদনেই লিখে ওঠা সম্ভব? ঠিক একইভাবে ‘শারদোৎসব’-এর উপনন্দ যেভাবে শরতের রোদে সোনা খুঁজে পেয়েছিল লক্ষেশ্বর তার লুকনো কৌটোয় সেই সোনা খুঁজতে চেয়েছিল৷ এই যে দুই দল, একদল দেখতে পায়, একদল পায় না৷ একদল বিশ্বসংসারকে ভালোবেসে মুক্তি পায়, আরেক দল পুঞ্জীভূত সোনা জমিয়ে মুক্তি খোঁজে, —বিশ্বের প্রতি বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসীর এই দ্বন্দ্বই তো বেশিরভাগ রবীন্দ্রনাটকের প্রাণ৷ ‘ডাকঘর’ আর ‘শারদোৎসব’ যেন এই বন্ধ আর মুক্তিরই খেলা৷ ১৯০৭ সালে মারা গিয়েছিলেন শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ কনিষ্ঠ সন্তানের এই মৃতু্যর পর ১৯১২-তে ‘ডাকঘর’-এ অমলের শান্ত সমাহিত মধুর (সম্ভবত) মৃতু্য যেন জগতের দুঃখ থেকে আনন্দের দিকে গভীর গহন পথের এক যাত্রা৷ দুঃখের বন্ধন থেকে আনন্দের মুক্তি৷ ঠিক এভাবেই মুক্তি চেয়েছে ‘শারদোৎসব’-এর উপনন্দও, মূল্য ঋণ চুকিয়ে অমূল্য আনন্দে৷


উপনন্দর এই যাত্রা রূপকথার কিংবা ব্রতকথার নায়কের মত কৃচ্ছসাধনায়, ব্রতের একনিষ্ঠতায়৷ এই যাত্রা বাইরের দেশবিদেশ ঘুরে নয়, এক জায়গায় বসে পুঁথি লিখে তবু তার এই পথ চলায় মনে পড়ে যায় ‘ঠাকুরমার ঝুলি’-র গল্পের কিরণমালা, সাত ভাইয়ের বোন চম্পা কিংবা বুদ্ধু ভুতুমের যেভাবে ব্রত উদযাপন হয় নিজেকে খুঁজে পেয়ে৷ পিতৃপরিচয় পুনরুদ্ধারের মাধ্যমেই তাদের মুক্তি হতে থাকে৷ বেশিরভাগ ব্রতের গল্পেই এই মুক্তি মিশে যায় ঋতুর উদযাপনে৷ মনে পড়ে যায় ‘শারদোৎসব’-এ মিশে থাকে শরৎ,
‘রক্তকরবী’-তে মিশে থাকে পৌষের শীত কিংবা ‘রাজা’-তে বসন্তের আনন্দ৷ এবং অদ্ভুতভাবে লক্ষ্যণীয় এই নাটকগুলিতে দেশি নাটকের যাত্রাপালার আকৃতি থাকে, থাকে এই উদযাপন নাচ গান মিলিয়ে আনন্দের বান ডেকে দিয়ে সর্বত্র৷

আবার লোককথার একটা প্যাটার্নে যেভাবে থাকে নায়কের বেরিয়ে পড়া, অভিযানে সামিল হওয়া, ইপ্সিতের কাছে পৌঁছনো এবং সত্য উদ্ঘাটন, তার অনেকটাই কি আমরা পাই না ডাকঘর, শারদোৎসব, রাজা কিংবা রক্তকরবীতে? কিংবা ‘অচলায়তন’, ‘মুক্তধারা’-তেও? বস্তুত যখন দেখি ১৯১০ সালে প্রকাশ পাওয়া দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’-র ভূমিকা লিখছেন রবীন্দ্রনাথ যা লোককথা নিয়ে সার বক্তব্য তুলে ধরে মাত্র দেড় পাতাতেই? কাছাকাছি সময়ে বিভূতিভূষণ গুপ্ত সংকলন করছেন ‘বিড়াল ঠাকুরঝি’ নামে একটি লোককথার বই, যাতেও একটি তাতপর্যপূর্ণ ভূমিকা লিখছেন রবীন্দ্রনাথ৷ আর ১৯০৮ সালেই লেখা হচ্ছে ‘শারদোৎসব’৷ ‘ডাকঘর’ ‘অচলায়তন’ ১৯১২, ‘রাজা’ ১৯১০৷ না, শুধু সময়ের সাযুজ্যেই নয়, দর্শন আর আকারেও মাঝে মাঝেই আমাদের রূপকথা ব্রতকথার মধুর গড়নটিকে ছুঁয়ে যায় যেন রবীন্দ্রনাটকগুলি৷ শুধু লোককথা নয়, লালনের গান কিংবা দর্শনও যেন মাঝে মাঝে নতুন করে চেনায় ‘ডাকঘর’-এর অমল, ‘শারদোৎসব’-এর উপনন্দকে৷ তাই আমাদের নিজস্ব রূপকথার গল্পে তরোয়াল দিয়ে খলনায়ককে যুদ্ধে হারিয়ে নয়, চেতনার উন্মেষে সমাপন হয়, রাজা নিজের ভুল বুঝতে পেরে ডেকে নেন দুয়োরানিদের, রবীন্দ্র নাটকেও যেন সেভাবেই প্রকৃত রাজার মহারাজত্ব উদ্ভাসিত হয়, নকল রাজাদের মুখোশ খুলে যায় এবং মাধব দত্ত, লক্ষেশ্বরেরা অন্তত নিজের অবস্থান বুঝতে পারে৷ শুধু সুদর্শনা ‘রাজা’কে চিনতে পেরে তাপিত হয়, দগ্ধ হয় অনুশোচনায়৷ তাই সে অমল বা উপনন্দের মতো মহারাজকে পায়৷ ‘রাজা’ নাটকে অভিযানটা তারই, ভুল থেকে ঠিকের দিকে৷

রাজপুত্র
উপনন্দকে এক দুর্লভ যুবক মনে হয় আমার৷ তার গুরুর শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার৷ যে বীণা বাজানোর উত্তরাধিকার বহন করেও পুঁথি লেখার বিদ্যা দিয়ে গুরুর ঋণ শোধ করে যেতে চায়৷ আজ ক্রেডিট সোসাইটিতে উপনন্দ যতটা দুর্লভ ততটাই আকাঙ্ক্ষিত হয়ে পড়ে যেন৷ এক অবিশ্বাস্য মধুর হয়ে ওঠে তার ঋণশোধ৷ আর সেই মাধুর্য যেন সম্পূর্ণ হয় সন্ন্যাসী অপূর্বানন্দের আগমনে এবং সাহচর্যে৷ হতে থাকে ‘শারদোৎসব’৷ শরৎ ঋতু তার আনন্দের ডালপালা বিস্তার করতে থাকে পৃথিবীতে৷ মিলে যায় পার্থিবতা আর অপার্থিবতা৷
‘আমি কখনো বা ভুলি, কখনো বা চলি
তোমার পথের লক্ষ্য ধরে—
তুমি নিষ্ঠুর সম্মুখ হতে
যাও যে সরে৷
এ যে তব দয়া জানি জানি হায়,
নিতে চাও বলে ফিরাও আমায়,
পূর্ণ করিয়া লবে এ জীবন
তব মিলনেরই যোগ্য করে
আধা-ইচ্ছার সংকট হতে
বাঁচায়ে মোরে৷’
‘গীতাঞ্জলি’র এই গান, এরকম একাধিক গানে যেন উপনন্দর আকুতিটাই স্পষ্ট হয়ে যায়৷ নিশ্চয়ই মনে রাখতে হবে ‘শারদোৎসব’

১৯০৮-এ লেখা, যখন ‘গীতাঞ্জলি’র গানগুলি লেখা হচ্ছিল, বই হয়ে বেরোলো ১৯১০-এ৷ উপনন্দর আকুতি যেন আরও স্পষ্টতা পেলো অমলে এসে৷ উপনন্দ চরিত্রটির মধ্যে উপনিষদের কাঠিন্য যেন বাউল ধর্মের সহজতা পেল অমলে এসে৷ উপনন্দ বুঝি পথ খুঁজতে চেয়েছে আর অমল নিশ্চিতভাবে জেনেছে পথে পথে কাজ খুঁজতে যাওয়াটাই পথ৷

উপনন্দ কাজ করে চলে, আর অমল কাজ খুঁজতে চায়৷ উপনন্দর কাজের চাপে উপায় নেই বাইরের প্রকৃতির সঙ্গে মেলার, অমলের রোগের জন্যেই উপায় নেই বাইরে যাওয়ার৷

আর দু’জনেই যেন এক বিন্দুতে এসে যায় যখন দেখি দু’জনেই অনাথ৷ তাদের পিতৃপরিচয় নেই৷ উপনন্দ তার গুরুর কুড়িয়ে পাওয়া৷ আর অমল মাধব দত্তের স্ত্রীর গ্রাম সম্পর্কের ভাইপো৷ তাকে দত্তক নেওয়া হয়৷ (‘মুক্তধারা’র অভিজিৎও ছিল পালিত সন্তান)৷ আমাদের মনে পড়ে যায় শিলাইদহ থেকে অল্প দূরে ঝিনাইদহ জেলার কুষ্ঠিয়ার লালন সাঁইয়ের জন্মবৃত্তান্ত৷ লালনের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে বহু মত প্রচলিত৷ শোনা যায় তিনি ছিলেন হিন্দু কায়স্থ৷ দাস বা কর তাঁর পদবী৷ অল্পবয়সেই পিতা মারা গেছিলেন তাঁর, বিবাহও হয়েছিল তাঁর অল্প বয়সেই৷ কিন্ত্ত একদা পুরীতীর্থে পায়ে হেঁটে যেতে গিয়ে বা ফিরতে গিয়ে বসন্ত রোগাক্রান্ত হন৷ দলের লোকেরা তাঁকে অচ্ছুত জ্ঞান করে জলে ভাসিয়ে দেন৷ এক মুসলমান দম্পতি তাঁকে সুস্থ করেন, সন্তানজ্ঞানে গৃহে আশ্রয় দেন৷ পরে লালন সিরাজ সাঁইয়ের কাছে দীক্ষা নেন, বাউল ধর্মকে আশ্রয় করেন৷ রবীন্দ্রনাথই প্রথম তাঁর গান শিক্ষিত সমাজের কাছে পৌঁছে দেন গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশ করে৷ বাংলার মৌখিক সাহিত্যের এই নির্যাস, এই আবেদন রবীন্দ্রনাথকে ঠিক কতটা স্পর্শ করেছিল তা গবেষণাযোগ্য, কিন্ত্ত লালনের অনাথ পরিচয়, গুরুর আশ্রয় মনে পড়ে যায় যখন উপনন্দ সন্ন্যাসী আর ঠাকুরদাদাকে বলে নিজের জন্মবৃত্তান্ত— ‘ছোট বয়সে আমার বাপ মারা গেলে আমি অন্য দেশ থেকে এই নগরে আশ্রয়ের জন্যে এসেছিলেম৷ সেদিন শ্রাবণমাসের সকালবেলায় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছিল, আমি লোকনাথের মন্দিরের এক কোণে দাঁড়াব বলে প্রবেশ করছিলেম৷ পুরোহিত আমাকে বোধহয় নীচ জাত মনে করে তাড়িয়ে দিলেন৷ সেইদিন সকালে সেইখানে বসে আমার প্রভু বীণা বাজাচ্ছিলেন৷ তিনি তখনই মন্দির ছেড়ে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরলেন৷ বললেন, এসো বাবা আমার ঘরে এসো৷’ তাই উপনন্দ যেমন বলে— ‘ইচ্ছা করছে, আমার প্রভুর জন্যে আজ আমি অসাধ্য কিছু একটা করি’, —লালনও তেমন গান বাঁধেন— ‘গুরু বিনে কি ধন আছে৷/ কি ধন খুঁজিস খেপা কারো কাছে৷’ যে অনাথ বালককে পুরোহিত তাড়িয়ে দেয়, সেই অনাথকে বুকে করে নেয় বীণা বাজানো ভিক্ষুক৷ উপনন্দ যাকে বলছে এই বৃত্তান্ত সেই অপূর্বানন্দ ওরফে মহারাজা বিজয়াদিত্য নিজেও পুঁথিপত্র পুড়িয়ে দিয়ে হাল্কা হতে চায়৷ অমলকেও ঠাকুর্দা বলেছিল হাল্কা দেশের কথা৷ প্রথাগত চলন, বিদ্যা, শিক্ষার বাইরে সহজিয়া আনন্দই কি সেই হাল্কা দেশে প্রবেশের মন্ত্র?

ছদ্মবেশ
রূপকথার গল্পে কিরণমালা ছদ্মবেশ ধরেছিল পুরুষের, যাতে মায়া পাহাড়ের ডাক তাকে কাবু না করতে পারে৷ বুদ্ধু ভুতুমও ছিল পেঁচা আর বাঁদরের ছদ্মবেশে৷ আর নীলকমল লালকমল ও ছদ্মবেশে গিয়েছিল রাক্ষস মারতে৷ ‘রাজা’ নাটকে রাজা যখন অন্ধকারের আড়ালে থাকেন তখন তা ছদ্মবেশের সামিল হয়৷ কিংবা ‘শারদোৎসব’-এ সন্ন্যাসী অপূর্বানন্দের আড়ালে থেকে যান রাজা বিজয়াদিত্য৷ কিন্ত্ত কেন এই ছদ্মবেশ? আগেকার দিনের রাজাদের ছিল এই ছদ্মবেশের আড়াল৷ রাজ পরিচয় লুকিয়ে সঠিক মানুষকে চিনে নিতে চাইতেন তাঁরা৷ প্রজাদের মধ্যে কে কতটা দেশভক্ত সেই আবিষ্কারও ছিল এর উদ্দেশ্য৷ ‘কিরণমালা’ গল্পে রাজা ছদ্মবেশে বেরিয়ে শুনে ফেলেন তিন বোনের গল্প৷ ছোট বোনটির সাধ ছিল রানি হবার, রাজা বড় বোনদের আকাঙ্ক্ষিত বরেদের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে নিজে বিয়ে করেন ছোটটিকে৷ ‘রাজা’ নাটকে রাজা চেয়েছিলেন রানি সুদর্শনা সঠিকভাবে চিনে নিন তাঁকে৷ তাঁদের অন্তরের মিল হোক আগে৷ তাই রানি তাকে বারবার দেখার জন্যে উৎসুক হলে রাজা গান করেন— ‘বাহিরে ভুল ভাঙবে যখন অন্তরে ভুল ভাঙবে কী…’

অপূর্বানন্দ ‘শারদোৎসব’-এ যখন লক্ষেশ্বরের কথার উত্তরে বলেন— ‘লক্ষেশ্বর তোমাদের চেয়ে ঢের বেশি মানুষ চেনে৷ যেমনি দেখেছে অমনি ধরা পড়ে গেছে! ভণ্ড সন্ন্যাসী যাকে বলে! বাবা লক্ষেশ্বর, এত দেশের এত মানুষ ভুলিয়ে এলেম, তোমাকে ভোলাতে পারলেম না!’ তখন কথার শ্লেষে স্পষ্ট হয়ে যায় মানুষের আসল নকল শুধু না, তাকে চেনার আসল নকল পদ্ধতি৷ বাইরে ভিতরে মানুষের ভিন্ন রূপ আর সেই আড়াল ভেদ করার জন্যে বাউলের আকুতি না থাকলে যে সব সম্পর্ক কেবলই সামাজিক নামকরণে সীমাবদ্ধ৷ তা যে আত্মার আত্মীকরণে পরিণত হতে পারে না৷ তা সে উপনন্দ আর অপূর্বানন্দের মধ্যেই হোক, রাজা আর সুদর্শনার মধ্যেই হোক৷ তখন এই আপাত ছদ্মবেশ মানুষের মধ্যে বিশ্বসংসারের মুক্তি আনায় আবশ্যিক হয়ে পড়ে যেন৷ জীবনের রূপকথা সম্পূর্ণ হয় এই বেশে৷ জীবনে গভীর গহন যে পথ, যেখানে গিয়ে না দাঁড়ালে পাওয়া যায় না তাঁকে, সেই পথ তো উন্মুক্ত নয়৷ তাঁকে খুঁজতে জানতে হয় ভিতরের চলন৷ ‘রাজা’ নাটকে ‘সুরঙ্গমা’ গান গেয়েছিল— ‘উৎসবরাজ কোথায় বিরাজে–/ কে লয়ে যাবে সে ভবনে,/ কোন নিভৃতে রে, কোন গহনে৷৷’ আর রাজা স্বয়ং সুদর্শনার জন্যে গান করেন— ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না/ ভালোবাসায় ভোলাব৷ আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো,/ গান দিয়ে দ্বার খোলাব৷’

এই ভালোবাসাই যে রূপকথা৷ এই ভালোবাসা যে প্রাপক আর দাতাকে এক বিন্দুতে এসে দাঁড় করায়৷ এক আনন্দে সামিল করে৷ তখন ছদ্মবেশ উন্মোচিত হয়৷ অবন ঠাকুরের সুও দুও গল্পের ক্ষীরের পুতুল প্রাণ পায়৷ তখনই হয় ‘ছুটি’৷

ছুটি
উপনন্দ কাজের মধ্যে মুক্তি চেয়েছিল৷ মিলে যেতে চেয়েছিল এই বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গেই৷ কিন্ত্ত তার পথটা ছিল ভিন্ন৷ তার ‘ছুটি’র সংজ্ঞা ছিল স্বতন্ত্র৷ সে নাটকের ছেলের দলের মত খেলে নেচে গান গেয়েই ছুটি উপভোগ করতে চায়, কিন্ত্ত তার ঋণের ভার তাকে অন্যত্র এই আনন্দ দেয়৷ তাই মেঘের কোলে রোদ এলে, সবাই যখন গান গেয়ে ওঠে ‘আজ বিনা কাজে বাঁজিয়ে বাঁশি কাটবে সকল বেলা’, আর সেই ‘ছুটি’ কাটায় যখন সবাই— ‘রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু, চরাবো আজ বাজিয়ে বেণু, মাখব গায়ে ফুলের রেণু, চাঁপার বনে লুটি’— তখন উপনন্দ এই ছুটির আনন্দে মেতে উঠতে পারে না, তাকে ছুটি দেয় কাজ৷ তার পুঁথি লেখা যত হতে থাকে, তার গুরুর ঋণ তত কমতে থাকে আর তার মন ছুটির আনন্দে মেতে ওঠে৷ বীণার তারের মত মধুর সুরে পৃথিবী ধরা দেয় তার কাছে৷ এই ভিন্নতর ‘ছুটি’ আমাদের কাছেও ‘ছুটি’ শব্দের একটা সম্পূর্ণ নতুন অর্থ নিয়ে আসে যেন৷ কাজ থেকে ছুটিই শুধু নয়, কাজের মধ্যে ছুটি আমাদের নতুন করে ভালোবাসায় উপনন্দকে, ঠিক যেভাবে সন্ন্যাসী তাকে ভালোবেসেছিল, চিনেছিল, আমরাও উপনন্দের দিকে, উপনন্দদের দিকে ফিরি৷ যে কাজ ব্যক্তিগত অর্থ উপার্জন আর সঞ্চয়ের কথা বলে না, তার চেয়ে বড় ছুটি আর হয় নাকি?

আর তখনই স্পষ্ট হতে থাকে ব্রত উদযাপনের মত শরতের এক অন্য ধারার উদযাপন৷ ঋতুর বহিরঙ্গ নয়, তার অন্তরের আনন্দকে স্পর্শ করে নিজেকে নতুন করে তোলাই যে সঠিক উদযাপন৷ আমাদের বাংলার পল্লীর ঘরে ঘরে যে আজও ঋতুর উৎসব হয় মনে পড়ে তা৷ শরতের ভাদ্র মাসের ভাঁজো কিংবা ভাদুগান, পৌষের টুসু লক্ষ্মী থেকে নবান্নের পুজো, বিশেষত বীরভূমের ‘লবাণ’-এ যে আনন্দ তা তো ঋতুকে বাইরে ভিতরে আত্মস্থ করে নিজেকে নতুন করে নেবার৷ এক ঋতু থেকে অন্য ঋতুতে প্রবেশের সঙ্গীতই তো ‘দে তোরা আমায় নূতন করে দে নূতন আভরণে’৷

মহারাজ একি সাজে
সেই ছুটির অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি তিনিই মহারাজ৷ ‘ডাকঘর’-এ অমলকে বলেছিলেন ঠাকুর্দা যে, তিনি এক হাল্কা দেশের কথা জানেন৷ যেখানে কারোর কোনো ভার নেই৷ সকলেই লঘু৷ অমল যেতে চেয়েছিল সেই দেশে৷ ‘শারদোৎসব’-এও অপূর্বানন্দ জানাচ্ছেন পুঁথিপত্র পুড়িয়ে দিয়ে রাজা হবার কথা৷ রবীন্দ্রনাটকে গানই যেন সেই হাল্কা দেশে প্রবেশের মন্ত্র৷ ঋতুর উৎসবের অন্দরে প্রবেশের খিড়কি দুয়ার৷ ‘রাজা’ নাটকে বাউলেরা গান গাইছে—
‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে৷
আছে সে নয়ন তারায় আলোক-ধারায়,
তাই না হারায়
ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়
তাকাই আমি যেদিন পানে৷’
তখন মনে পড়বেই লালন শাহের কথা—
‘কেন কাছের মানুষ ডাকছো জোর করে
আছিস তুই যেখানে সেও সেখানে
খুঁজে বেড়াও কারে৷৷’

এই ‘প্রাণের মানুষ’ বা ‘জীবনদেবতা’র অনুসন্ধানই বুঝি রবীন্দ্রনাটকের প্রাণ৷ তিনি আছেন আমারই মধ্যে৷ শুধু তাঁকে খুঁজে পাওয়াই সার৷ ‘চিত্রা’ কাব্যের ‘জীবনদেবতা’ কবিতাটিতে লিখেছিলেন—
‘ওহে অন্তরতম,/ মিটেছে কি তব সকল তিয়াস আসি অন্তরে মম’ অর্থাৎ কেবল অমল বা উপানন্দকেই তাঁর কাছে পৌঁছনোর সাধনা করতে হয় না, তাঁকেও যে আসতে হয় তৃষ্ণা মেটানোর প্রবল অভিসারে৷ তাই ‘গীতাঞ্জলি’র একটা গান হয়— ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার/ পরাণসখা বন্ধু হে আমার৷… সুদূর কোন নদীর পারে, গহন কোন বনের ধারে/ গভীর কোন অন্ধকারে হতেছ তুমি পার৷’ বাইরে দেখা যায়না সেই পথ৷ কিন্ত্ত গভীর গহন পথ ধরে রাজা নয়, মহারাজ স্বয়ং আসেন অমলের কাছে৷ রাজা বিজয়াদিত্য সন্ন্যাসী অপূর্বানন্দ হয়ে বলেন— ‘রাজা হতে গেলে আগে সন্ন্যাসী হতে হয়৷’ আর সেই রাজাও উপনন্দকে আঁকড়ে ধরে বলেন— ‘আমার পুত্র নেই বলে তোমরা সর্বদা আক্ষেপ করতে৷ এবারে সন্ন্যাসধর্মের জোরে এই পুত্রটি লাভ করেছি৷’ মহারাজের এই অপূর্বতাই তার সৌন্দর্য৷ তাই ‘রাজা’ নাটকে রাজা আর পাঁচজনের মত সুন্দর নয়, সে ‘অনুপম’৷ তার তুলনা নেই৷ তাঁর সেই অপূর্ব রূপে মুগ্ধ হয় যে সুদর্শনা সে যন্ত্রণার আগুনে পুড়ে নিজেও শুদ্ধ হয়েছে বৈকি৷ তাই ব্রত উদযাপনের আনন্দে সে ‘অবিশ্বাসী’দের দল থেকে ‘বিশ্বাসী’ হতে পেরেছে৷ মাধব দত্ত, লক্ষেশ্বরেরা যা পারেনি সেই পথ সে পেরোতে পেরেছে৷

তাই মহারাজ যখন অপূর্ব সাজে এসে ধরা দেন হূদয়পুরমাঝে, তখন ‘গর্বসম টুটিয়া মূর্ছি পড়ে লুটিয়া / সকল মম দেহ মন বীণাসম বাজে৷’