পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়
কাশ্মীরে হিন্দু পণ্ডিতদের নিগ্রহ-নিপীড়ন এক ঘটনাপঞ্জির মাধ্যমে সংক্ষেপে বিবৃত করা যাক৷
১৮৮৬ — ডোগরা মহারাজা গুলাব সিং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের কাছ থেকে কাশ্মীরকে কিনে নেন এবং তার সঙ্গে জম্মু ও লাদাখ অঞ্চলকে যোগ করে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য গঠন করেন৷
১৯৩১ — ডোগরা মহারাজা হরি সিংহের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ৷ সংখ্যাগুরু মুসলিমদের এক জনতা সংখ্যালঘু কাশ্মীরি হিন্দু পণ্ডিতদের আক্রমণ করে৷
জুলাই, ১৯৮৮ — দুটো কম ক্ষমতার বোমা বিস্ফোরণ হয়৷
সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯ — পণ্ডিত সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক কর্মী টিকা লাল টাপলু তাঁর বাড়ির সামনে গুলিতে নিহত হন৷
জানুয়ারি, ১৯৯০ — উপত্যকা জুড়ে বিশাল জনতা মসজিদে মসজিদে জমায়েত হয়ে ভারত-বিরোধী এবং পণ্ডিত-বিরোধী স্লোগান দিতে থাকে৷ কাশ্মীরি পণ্ডিতদের গণপ্রস্থান শুরু হয়৷ পরবর্তী কয়েক মাসে শত শত নিরীহ পণ্ডিত অত্যাচারিত, নিহত হয় এবং নারীরা ধর্ষিত হয়৷ বছরের শেষে, প্রায় ৩,৫০,০০০ জন পণ্ডিত উপত্যকা ছেড়ে চলে যায় এবং জম্মু ও অন্যান্য স্থানে আশ্রয় নেয়৷ মুষ্টিমেয় কিছু পণ্ডিত উপত্যকাতে রয়ে যায়৷
মার্চ, ১৯৯৭ — সংগ্রামপোরা গ্রামে সাতজন কাশ্মীরি পণ্ডিতকে সন্ত্রাসবাদীরা ঘর থেকে বের করে গুলি করে মারে৷
জানুয়ারি, ১৯৯৮ — নন্দীমার্গ গ্রামে শিশুসহ ২৪ জন কাশ্মীরি পণ্ডিতকে নৃশংসভাবে গুলি করে মারা হয়৷
২০০৮ — ইউপিএ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপত্যকাতে প্রত্যাবর্তনের জন্য ১৮৬৭ কোটি টাকার এক প্যাকেজ ঘোষণা করেন৷ এতে ৬০০০ পণ্ডিত যুবক কর্মসংস্থান এবং পরিবার প্রতি ৭.৫০ লক্ষটাকা অনুদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়৷ একমাত্র যুবতীরা শিক্ষিকার কাজে যোগ দিতে উপত্যকাতে আসেন৷ কারণ সামান্য সরকারি অনুদানে তাঁদের পরিবার চালানো সম্ভব হচ্ছিল না৷ কিন্ত্ত তাঁরা প্রাচীরবেষ্টিত মহল্লাতে এবং কর্মস্থলে মুসলিম জনসাধারণের নির্যাতনের শিকার হন৷ তাঁদের প্রত্যাবর্তন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি৷
সেপ্টেম্বর, ২০১৭ — কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজনাথ সিং ঘোষণা করেন যে, সরকার উত্তর, মধ্য এবং দক্ষিণ তিনটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শিবিরে ৬০০০টি বাড়ি নির্মাণ করে দেবেন৷ কিন্ত্ত ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী দলসমূহের বিরোধিতা করেন৷ মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সঈদ মারা গেলে এই প্রস্তাব আর এগোয়নি৷
২০২০ — তখনও হাজার হাজার পণ্ডিত ত্রাণশিবিরে চূড়ান্ত দূরাবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে৷ তিন যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও কাশ্মীরি পণ্ডিতসমাজ এখনও তাদের পৈতৃক বাসভূমিতে ফিরতে পারেনি৷
উপরের ঘটনাপঞ্জি থেকে এটা পরিষ্কার যে, গত ৯০ বছর ধরে পণ্ডিতেরা বিভিন্নভাবে নিপীড়িত হয়েছে৷ সেনসাস অনুযায়ী কাশ্মীর উপত্যকায় মোট জনসংখ্যা ১৯৮১ সালে ৩১,৩৪,৯০৪ থেকে ২০০১ সালে ৫৪,৭৬,৯৭০ জন হয়৷ আর ভারতীয় ধর্মভুক্ত (কাশ্মীর উপত্যকাতে মূলত পণ্ডিতেরা) জনসংখ্যা ওই সময়ে ১,৫৭,৫০৬ থেকে হয়েছে ১,৫১,৬১৩ জন (হিন্দু ১,০০,৯৬২ জন), যা কাশ্মীর উপত্যকাতে জনসংখ্যার শতকরা ৫.০২ ভাগ থেকে হয়েছে ২.৭৭ ভাগ (হিন্দু শতকরা ১.৮৪ ভাগ)৷ এই পরিসংখ্যান থেকে কাশ্মীর উপত্যকায় ১৯৮১ সালের পর কীভাবে পণ্ডিতদের নির্মূল করা হয়েছে তার আন্দাজ পাওয়া যায়৷ জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের ওয়েবসাইট অনুযায়ী ১৯৯০ সালে ১,৫০,০০০ থেকে ১,৬০,০০০ জন পণ্ডিত কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে চলে যায়৷
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুলওয়ামা জেলার এক পণ্ডিত ব্যাঙ্ককর্মী নিহত হওয়ার পরে কাশ্মীর উপত্যাকায় পণ্ডিত সমাজের নিরাপত্তাহীনতার নতুন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে৷ প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এর আগে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত এক প্যাকেজ অনুযায়ী ৬০০০ পণ্ডিত কাশ্মীর উপত্যকায় সরকারি চাকরি পান৷
ধর্মীয় কারণে দেশবিভাগের সময়ে বাঙালি এবং পাঞ্জাবি সম্প্রদায় নিপীড়িত হয়েছিল৷ এর জন্য দায়ী ছিল ব্রিটিশ সরকারসহ দুইটি নবগঠিত ভিন্ন দেশের সরকার, সেনাবাহিনী এবং ধর্মান্ধ মানুষ৷ অপরদিকে স্বাধীনতার পরেও পণ্ডিতেরা নিজ দেশে গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের শাসনকালে গত সত্তর বছরের বেশি সময় ধরে নির্যাতিত হয়ে চলেছে৷ কোনওক্ষেত্রেই নির্যাতকের বিরুদ্ধে আইনি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি৷ বিদেশি সরকারের প্ররোচনার দোহাই দিয়ে সরকার নির্যাতিত পণ্ডিতদের প্রতি অবৈধ অনুপ্রবেশকারীসুলভ আচরণ করতে পারে না৷ তাদের হূতভূমি ও হূতসম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার দায় সরকারের৷ সেই দায় পালন না করা মানবাধিকার ও আইন রক্ষার ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা৷ যারা ভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে আগত নিপীড়িত অমুসলিম জনগণের পুনর্বাসনকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিচ্ছেন, তাঁরা নিজদেশে বাসচু্যত ও নিপীড়িত অমুসলমান জনগণের কথা ভাবছেন কি?
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ৩৭০ ধারা রদ-ঘোষণা সংক্রান্ত মামলাসমূহের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে গত বছর ১১ ডিসেম্বর শীর্ষ আদালতের রায়ে৷ জম্মু ও কাশ্মীর এবং বাকি ভারতে একটিই সংবিধান বিরাজ করছে৷ জম্মু ও কাশ্মীরকে (লাদাখ বাদে) রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে কেন্দ্রীয় সরকার, যা শীঘ্র রূপায়িত করার নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত৷ পৃথক রায়ে বিচারপতি এস কে কল এক সত্য ও সমন্বয়সাধন কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার মতো৷ এই কমিশন ১৯৮০ সালের পর থেকে জম্মু ও কাশ্মীরে সংঘটিত রাষ্ট্রীয় এবং অরাষ্ট্রীয় মাধ্যমের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে অনুসন্ধান করবেন এক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমন্বয়সাধনের উদ্দেশ্যে৷ এই রায়কে মান্যতা দিয়ে নির্বাসিত ভূমিপুত্র পণ্ডিতসমাজের মানুষ কি তাদের ভিটেতে ফিরতে পারবেন, ফিরে পাবেন তাদের হূত অধিকার নতুন পরিবেশে এক সার্বিক সমন্বয়ের লক্ষ্যে?
সামান্য কিছু নির্ভীক পণ্ডিত পরিবার এখনও কাশ্মীর উপত্যকা এলাকায় বাস করে চলেছেন৷ ৩৭০ ধারা রদের পরে তাঁরা কেমন আছেন এই প্রশ্ন করা হয় ‘কাশ্মীরি পণ্ডিত সংঘর্ষ সমিতি’র প্রধান সঞ্জয় টিকুকে৷ তিনি উত্তর দেন, ‘‘একদিকে পুলিশ আমাদের বিকেল পাঁচটার পরে ঘরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে৷ অন্যদিকে জনগণের কাছে প্রচার করছে যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক৷ ২০০৩ সালে নন্দীমার্গে পণ্ডিত সম্প্রদায়ের ২৪জন বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গিদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন৷ জঙ্গিদের কাছে পণ্ডিত সম্প্রদায়ের মানুষ ‘জনসংঘি’৷ আর তাঁদের বর্তমান পরিচয় প্যালেস্তাইনে ‘বসতকারী ঔপনিবেশিক’ ইজরায়েলিদের মতো৷’’
গত ১১ ডিসেম্বরের রায়ে বিচারপতি কল এও বলেছিলেন, ‘‘আমি গুরুত্ব সহকারে আশা করি যে কাশ্মীরিরা তাদের অতীতকে হূদয় দিয়ে গ্রহণ করবে এবং যারা উপত্যকা থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল তারা মর্যাদার সঙ্গে ফিরে আসবে৷’’ সেই দিকে সত্যিই কি কাশ্মীর কিছু এগিয়েছে? বিচারপতি কল নির্দেশিত ‘সত্য এবং সমন্বয়সাধন কমিশন’ কি সত্যিই গঠিত হয়ে কাশ্মীর উপত্যকায় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নতুন দিশা দেখাবে? নির্বাচনের পর নবগঠিত সরকার কী করে তা এখন দেখার৷