প্রবীর মজুমদার
মে দিবসের সংগ্রামের মূল দাবি ছিল ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবস৷ এই দাবিতে শ্রমিকদের মধ্যে আন্দোলনের চেতনা একদিনে গড়ে ওঠেনি৷ শ্রমিকদের মধ্যে মালিকরা এই ধারণা গড়ে দিয়েছিল যে, মালিক কাজ দেয় বলেই শ্রমিক বেঁচে আছে৷ মালিকরা অন্নদাতা৷ মালিকদের কল্যাণ হলে তবেই শ্রমিকদের কল্যাণ, ফলে তাকে কোনওভাবেই বিব্রত করা চলে না৷ এই ধারণা আজও একাংশ শ্রমিকের মধ্যে আছে৷ সেদিন তো আরও ব্যাপকভাবেই ছিল৷ তা সত্ত্বেও মালিকের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের অসন্তোষ, বিক্ষোভ চেপে রাখা যায়নি৷ তা মাঝে মাঝেই ফেটে পড়ত৷ এই ভ্রান্ত ধারণায় প্রথম আলো ফেলে মার্কস ও এঙ্গেলস-এর লেখা ‘কমিউনিস্ট ইস্তাহার’, মে দিবসের সংগ্রামের ৩৮ বছর আগে৷ ১৮৪৮ সালে লেখা এই কমিউনিস্ট ইস্তাহার মালিকের দ্বারা শ্রমিকের শোষণ স্পষ্ট করে দিয়েছিল এবং শ্রমিক শ্রেণির হাতে তুলে দিয়েছিল মুক্তির পথনির্দেশ৷ ঘোষণা করেছিল পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণির ‘শৃঙ্খল ছাড়া’ হারাবার কিছু নেই, ‘জয় করবার জন্য আছে গোটা দুনিয়া’৷
মজুরি শ্রমিকের জন্ম ও বিকাশের সঙ্গে পুঁজিবাদের জন্ম ও বিকাশের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ৷ মজুরি শ্রমিকের সংখ্যাবৃদ্ধি ছাড়া পুঁজিবাদের অস্তিত্ব ও বিস্তার সম্ভব হয় না৷ সেজন্য ইউরোপে শিল্পবিপ্লব কালে একদিকে যেমন পুঁজিপতি একটি শ্রেণি হিসাবে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, অন্যদিকে তেমনি তৈরি হয়েছে শ্রমিক শ্রেণি৷ একইসময়ে যুক্তরাষ্ট্রেও প্রায় একই চিত্র ছিল৷ কাজের সময় কিংবা মজুরির তখন ঠিক ছিল না৷ ক্রমেই নারী-শিশুসহ শ্রমিকদের অবর্ণনীয় জীবন পরিবর্তনের জন্য অসংখ্য প্রতিবাদ-বিক্ষোভ তৈরি হয়, সংগঠন গড়ে ওঠে৷ উনিশ শতকের ৬০/৭০/৮০ দশকের এসব আন্দোলনের ধারাবাহিকতাতেই ১৮৮৬ সালের মে মাসের ১ তারিখে তিন লক্ষাধিক শ্রমিকের ধর্মঘট চলাকালে শিকাগো শহরের বড় সমাবেশে হামলা হয়৷ গুলিতে নিহত হন শ্রমিকরা, পরে আবার প্রহসনমূলক বিচারে শ্রমিক সংগঠকদেরই ফাঁসিতে ঝোলানো হয়৷ এ জীবনদান বৃথা যায়নি৷ একসময়ে যে দাবিকে বলা হয়েছে উন্নয়নবিরোধী, সন্ত্রাসী-ক্রমে সারা বিশ্ব সেই দাবিই গ্রহণ করেছে, মে দিবস পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক দিবসে৷
পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় পুঁজির দ্রুত সংবর্ধনের পাশাপাশি শ্রমের সঙ্গে যুক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অস্তিত্বের লড়াইয়ে মে দিবসের কথাই আসে বারবার৷ অব্যাহত প্রান্তিকীকরণ ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে তাদের বিকশিত হওয়ার তাগিদ দেয় মে দিবস৷ এ লড়াইয়ের দুর্বলতা থাকলে তা শ্রমিক শ্রেণিকে কতটা হীন অবস্থায় ফেলতে পারে, আজকের ভারত তার দৃষ্টান্ত৷ সংগঠিত হওয়ার সুযোগ শিক্ষিত শ্রমজীবী মানুষদের জন্যও খুবই ক্ষীণ৷ সে কারণে ব্যাঙ্ক, বিমা, মিডিয়া, এনজিও, বেসরকারি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লিনিক, অনলাইন খাত কোথাও কাজের ও আয়ের নিরাপত্তা দেখা যায় না৷ এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মানুষদের যে কোনো সময় ছাঁটাই এবং তাদের ওপর অন্যায়-অবিচারের প্রতিকারের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই৷ সরকার সর্বত্রই নীরব দর্শক৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের স্বার্থ দেখা প্রশ্নে আইনগত, প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি ব্যবস্থা ভারতের মতো এতটা নিষ্ক্রিয় কমই দেখা যায়৷
দারিদ্র্য আর বঞ্চনার মধ্যে আছে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, তাদের জীবনে কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি ছাড়াই দেশে মোট দেশজ উৎপন্ন (জিডিপি) আর গড় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ৷
পরিসংখ্যানের চাতুর্য আর গড় হিসাবের প্রতারণায় ঢাকা থাকছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনের নির্মমতা৷ কৃষিতে কৃষকদের, কারখানায় শ্রমিকদের রক্ত আর ঘাম দিয়ে তৈরি হচ্ছে প্রবৃদ্ধির উঁচু হার৷ অন্যদিকে বাণিজ্যিকীকরণের ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে গেছে৷ পরিবহণ ব্যয় বেড়েছে৷ করোনা-পরবর্তী বছরে কাজ ও আয়ের বিপর্যয়ে পড়েছে বেশিরভাগ মানুষ৷ পুঁজিবাদ বিকাশ প্রক্রিয়ায় মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বেড়েছে; কিন্ত্ত স্থায়ী স্থিতিশীল পরিবেশসম্মত, সম্মানজনক কাজের সুযোগ বাড়েনি৷
বিশ্বের সব অঞ্চলেই পুঁজির ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার কাছে শ্রমশক্তি বিক্রির মানুষ অর্থাৎ মজুরেরও বিস্তার ঘটে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বহুদূর৷ সেজন্য শুধু শিল্প খাতের মধ্যেই শ্রমিক পরিচয় সীমাবদ্ধ রাখলে পুঁজির আধিপত্য ও ক্রিয়ার প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না৷ প্রযুক্তি বিকাশের মধ্য দিয়ে শ্রমশক্তি বিক্রেতাদের মধ্যে বহু ধরন তৈরি হয়েছে৷ আপাতদৃষ্টিতে মধ্যবিত্ত, কিন্ত্ত সর্বক্ষণ অনিশ্চিত কাজে নিয়োজিত ডিগ্রিপ্রাপ্ত এখন অনেকেই৷ কাজেই মে দিবস যাদের ঐক্য ও সংহতির বার্তা দেয়, তারাই সমাজের ৯৯ শতাংশ৷
আজ বাম-ডান কত শ্রমিক সংগঠনই তো মে দিবস পালন করে৷ কিন্ত্ত মে দিবসের শহিদের এই আবেদনের মূল্য দেয় ক’জন? এই উপলব্ধি জনিত ঘাটতি এবং শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে পুঁজিবাদ বিরোধী সংগ্রাম দুর্বল থাকায় মালিকরা আজ বেপরোয়া৷ শ্রমিকদের অধিকারগুলি এক এক করে হরণ করছে তারা৷ বহু সংগ্রামের এবং আত্মদানের মধ্য দিয়ে ‘মে দিবস’-এর যে গৌরবময় অর্জন- মালিকরা তা নস্যাৎ করে দিয়েছে৷ আজ আবারও ১২ ঘণ্টা/১৪ ঘণ্টা করে শ্রমিকদের খাটানো শুরু হয়েছে৷ ‘মে দিবসে’র অর্জিত অধিকারগুলি লুট হয়ে গেছে শুধু এ দেশে নয়, সব পুঁজিবাদী দেশেই৷ লেনিন-স্ট্যালিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র শ্রমদিবস ৮ ঘণ্টার থেকে কমিয়ে আনা শুরু করেছিল৷
১৯২৬ সালে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় কাজের দৈনিক সময় কমিয়ে করা হয় সাড়ে সাত ঘন্টা৷ ১৯২৯ সালে ঘোষণা করা হয় সপ্তাহে ৫ দিন কাজ করতে হবে৷ সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ঘোষণা করেছিল সবাইকে সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করতে হবে এবং উপযুক্ত কাজ দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের৷ শ্রমিকদের এখানে এত অধিকার ছিল যে, বেতন কাঠামো কী হবে, কর্তৃপক্ষের সাথে সেই বৈঠকে ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক শ্রমিক অংশগ্রহণ করত৷ এই সমাজতন্ত্র শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করেছিল৷ নর-নারীর বেতন বৈষম্য দূর করেছিল৷ এই সমাজতন্ত্রেই মানুষ মুক্তির স্বাদ পাচ্ছিল৷ কিন্ত্ত আন্তর্জাতিক পুঁজিতন্ত্র ও দেশের মধ্যে পরাজিত পুঁজিবাদ এবং মার্ক্সবাদ বিচু্যত সংশোধনবাদ সমাজতন্ত্রকে ভেঙে দিয়েছে৷ পুঁজিবাদী রাশিয়া শ্রমিক শ্রেণির পায়ে আবার পরিয়েছে মজুরি দাসত্বের শৃঙ্খল৷ পুঁজিবাদী রাশিয়া এখন সাম্রাজ্যবাদী রূপ ধারণ করে ইউক্রেনে ছাব্বিশ মাসের বেশি সময় ধরে স্থল ও আকাশ পথে হামলা চালিয়ে দেশটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে৷ আজ ইউক্রেন, রাশিয়া সহ গোটা বিশ্বের মানুষ উপলব্ধি করছেন শান্তির জন্য সমাজতন্ত্র কত জরুরি৷
‘দুনিয়ার শ্রমিক এক হও’, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের শ্লোগান৷ কেন এক হবে দুনিয়ার শ্রমিক? কারণ, সব দেশের শ্রমিকই মালিকি শোষণের কারাগারে বন্দি৷ এই শোষণ মুক্তির সংগ্রামে তারা একে অপরের বন্ধু৷ মে দিবসের সংগ্রামে ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবি প্রধানত থাকলেও এর মধ্যে নিহিত ছিল পুঁজিবাদ উচ্ছেদের মর্মবস্তু৷ মে দিবস পালন করব আবার মালিকি ব্যবস্থা রক্ষা করব বা যে সমস্ত দল পুঁজিবাদকে সেবা করে চলেছে তাদের পতাকা বহন করব-এটা দ্বি-চারিতা৷ শ্রমিক আন্দোলনকে এর প্রভাব থেকে মুক্ত করার মধ্যেই রয়েছে মে দিবস উদযাপনের যথার্থ তাৎপর্য৷