পরিবর্তনের ইঙ্গিত সূচকে

কথায় আছে ডুবন্ত জাহাজ থেকে বাঁচার তাগিদে সবার আগে পালানোর চেষ্টা করে ইঁদুররা৷ বিপদের অাঁচ নাকি ইঁদুররাই প্রথম টের পায়৷ তেমনই পঁুজিবাদী ব্যবস্থায় পঁুজির স্বার্থহানির সামন্যতম কোনও আশঙ্কা যদি কখনও মনে হয় তাহলে তার প্রথম প্রতিফলন দেখা যায় শেয়ার বাজারে৷ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বা রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সরকারের নীতিগত অবস্থান বা পদক্ষেপ যদি পঁুজির মুনাফা সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলার উপক্রম করে তাহলে তা প্রথম শেয়ার বাজারকে আন্দোলিত করে৷ পঁুজিবাদের শৃঙ্খলাহীন খোলা হাওয়ার উৎসকেন্দ্র হচ্ছে শেয়ারবাজার৷ ফাটকাবাজ জুয়ারিরা সেখানে শেয়ার মূল্যের উত্থান-পতনের কারিগর৷ পঁুজির স্বার্থে শেয়ার বাজার সূচক হাওয়া মোরগের কাজ করে৷

দেশের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন এমনই এক বার্তা দিয়েছে শেয়ার বাজার৷ গত ৯ মে আচমকা এক ধাক্কায় শেয়ার সূচক সেনসেক্স এবং নিফটি অনেকটাই নেমে যায়৷ বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রধানত দু’টি কারণে শেয়ার বাজারের উত্তাপ অনেকটা কমে শীতল হয়ে যায়৷ একদিনেই সূচক কমে যায় দেড় শতাংশ৷ তাতে লগ্নিকারীদের সম্পদ মুছে যায় সাত লক্ষ কোটি টাকারও বেশি৷

প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক নির্বাচনী জনসভায় বলেছিলেন আদানি ও আম্বানিরা নাকি বস্তা বস্তা কালো টাকা টেম্পো বোঝাই করে রাহুল গান্ধিদের দফতরে পঠিয়েছে৷ সেইজন্য নাকি নির্বাচন পর্ব শুরু হবার পর থেকে আদানি-আম্বানিদের জড়িয়ে মোদিকে আক্রমণ করছেন না রাহুল গান্ধি৷ মোদির মুখে আদানি-আম্বানিদের কালো টাকা নিয়ে এমন মন্তব্য দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ায় জোর ধাক্কা লাগে শেয়ারবাজারে৷ ফাটকাবাজরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে অনিশ্চয়তায়৷


দ্বিতীয়ত, প্রথম দফার ভোটগ্রহণের পর থেকে জনমানসে ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যে মনোভাবের পরিবর্তন ঘটছে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর আচরণ, বক্তৃতার ধরন এবং বক্তৃতার বিষয় যেভাবে বদলে গেছে তাতে শাসকদলের পক্ষে দুঃশ্চিন্তারই বার্তা দিচ্ছে৷ এই আলোচনা ক্রমশ বাড়ছে যে ৪০০ আসন তো দূরের কথা মোদিরা আদৌ ক্ষমতায় ফিরতে পারবেন কিনা সেটা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠে গিয়েছে৷ স্বাভাবিকভাবেই তার অাঁচ পড়েছে শেয়ার বাজারে মোদিরা ক্ষমতায় ফিরবে না, মোদি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হবেন না, এমন দুঃশ্চিন্তা ফাটকাবাজদের উৎসাহে জল ঢেলে দিয়েছে৷

কর্পোরেট পঁুজির বিশ্বস্ত বন্ধু নরেন্দ্র মোদি৷ তাঁরই হাত ধরে গৌতম আদানিদের মতো শিল্পপতিদের উত্থান৷ মোদি প্রধানমন্ত্রী হবার আনন্দে ভারতের শেয়ারবাজারে নজিরবিহীন উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল৷ তাঁর দশ বছরের কর্পোরেট পঁুজিবান্ধব শাসন শেয়ার সূচককে ২৫ হাজার থেকে তুলে নিয়ে যায় ৭৫ হাজারে৷ সেই মোদি ক্ষমতা হারাতে চলেছেন এমন বার্তায় শেয়ার বাজারে শোকের ছায়া নামবে সেটাই স্বাভাবিক৷
মেঠো বক্তৃতা আর বিজ্ঞাপনের প্রচারে গল্পের গরু আকাশে ওড়ে ঠিকই, কিন্ত্ত বাস্তবের অঙিনায় গাঢ় অন্ধকারে তার কিছুই দৃশ্যগোচর হয় না৷ মোদি জমানায় সাধারণ মানুষ কেমন আছেন প্রচারে তার কোনও ছবিই ধরা পড়ে না৷ তবে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন সরকারি রিপোর্টে যেসব তথ্য বেরিয়ে আসে সেগুলিকে এক জায়গায় হাজির করলে প্রকৃত সত্যের খানিকটা আন্দাজ করা যায়৷ ধরা যাক ভারতের জনগণের পারিবারিক সঞ্চয়ের বিষয়টি৷ সমাজ এবং পরিবারে মানুষ ঠিক কি অবস্থায় জীবনযাপন করছেন তা ধরা পড়ে এই পারিবারিক সঞ্চয়ের তথ্য থেকে৷ সাধারণ জ্ঞান বলে সঞ্চয় তখনই বাড়ে যখন আয় বাড়ে৷ মোদি জমানায় মানুষের প্রকৃত আয় বাড়েনি উচ্চ মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায়৷ ফলে জীবনধারণের মান বজায় রাখতে একটা বড় অংশকে ঋণ নিয়ে পণ্য পরিষেবা কিনতে হচ্ছে৷ মোদি জামানায় তাই পারিবারিক ঋণ বেড়েছে৷ সঞ্চয় বাড়ছে না অথচ ঋণ বাড়ছে৷ পারিবারিক জীবনে ঝঁুকি ও অনিশ্চয়তা বাড়ছে৷ এই নির্মম বাস্তবকে আড়াল করতেই মোদির গ্যারান্টির মিথ্যা ফানুস ওড়ানো হচ্ছে৷ সন্দেহাতীতভাবে এই নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইসু্য মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারি৷ তবু মানুষকে অবাক করে মোদির দাবি, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং এই কৃতিত্ব রিজার্ভ ব্যাঙ্কের৷ প্রধানমন্ত্রী মোদির দাবিকে ‘ভুল’ প্রমাণ করে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর জানিয়েছেন, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ হয়নি৷ তা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা ৪ শতাংশের উপরেই রয়েছে৷ চলতি অর্থবর্ষে খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির গড় হার ৪.৫ শতাংশ থাকার সম্ভাবনা৷ তীব্র দাবদাহের কারণে জিনিসপত্রের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে৷ সব মিলিয়ে তাই এখনই কোনও আশার সম্ভাবনা দেখছে না রিজার্ভ ব্যাঙ্ক৷

দেশের আর্থিক পরিস্থিতির এই হাল আর কোনও কিছু দিয়েই চাপা রাখা যাচ্ছে না৷ শেয়ার বাজারেও তাই এর প্রতিফলন৷