ভোটের উত্তাপে ‘রবি’র কাছে ছায়া খুঁজলেন রাজনৈতিক নেতারা

মধুছন্দা চক্রবর্তী: এবছর বৈশাখ শুধু রবীন্দ্র জন্মমাসই নয়, লোকসভা নির্বাচনেরও মাস৷ তাই এবার রবীন্দ্রনাথের ১৬৪তম পঁচিশে বৈশাখে, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের আড়ম্বরটা তেমন চোখে পড়ল না৷ নির্বাচনী আচরণবিধির নিষেধাজ্ঞায় লাগাম পড়ল রবীন্দ্রউন্মাদনায়৷ রাস্তায় মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরের ফিউশান ঘটল না, পাড়ায় পাড়ায় তারস্বরে মাইকে মাইকে মধুর গম্ভীর আহ্বান ধ্বনিল না তেমন একটা৷ তবুও পঁচিশে বৈশাখ মানেই বাঙালিয়ানার একটা পেটেন্ট৷ তাই এদিন কবি স্মরণে রবীন্দ্রনাথেরই শরণ নিলেন রাজনৈতিক নেতারা৷

এমনকী দেশের প্রধানমন্ত্রী, শান্তিনিকেতনকে হেরিটেজ ঘোষণার সময়ে রবীন্দ্রনাথের নাম মুছে দেওয়ার সময় যিনি নির্বাক হয়ে রয়েছিলেন, তিনিও এদিন রবীন্দ্রজয়ন্তীতে বাঙালিভক্ত হয়ে উঠলেন৷ নির্বাচনী আবহে টুইটারে লিখলেন — ‘গুরুদেব টেগোরের জন্মজয়ন্তীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য, তাঁর সহিষ্ণুতা, প্রজ্ঞা ও প্রতিভা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অসংখ্য মানুষকে প্রাণিত ও আলোকিত করবে৷’ শুধু টুইট বার্তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উচ্চারিত একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভিডিও প্রচারিত হয়েছে৷ সেটি ছিল — ‘চলায় চলায় বাজবে জয়ের ভেরী, পায়ের বেগে পথ কেটে যায়…’৷ মোদির কথায় গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ নতুন যুগের ধর্মে অগ্রগামী পদক্ষেপ ঘোষণার কথা বলেছিলেন৷ চলার পথে নতুন রাস্তা তৈরির কথা বলেছিলেন৷ বলা বাহুল্য, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এদিন ‘ওরে নতুন যুগের ভোরে,…কী রবে আর কী রবে না, কী হবে আর কী…’ এই রবীন্দ্রগানটিকে ভিডিও বার্তার জন্য চয়ন করে রাজনীতিতে ‘নতুন যুগের ভোর’ আনার কথাই বলতে চেয়েছেন, লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের কথা মাথায় রেখে৷

তবে শুধু জাতীয় রাজনীতিই নয়, এবারের পঁচিশে বৈশাখে রাজ্য রাজনীতিও ছায়া খঁুজেছে সেই রবীন্দ্রনাথের কাছেই৷ সকাল বেলা থেকেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে অগণিত মানুষের ঢল৷ বৈশাখ এবার তাপ কমিয়েছে, তাই সকাল থেকেই আমজনতা থেকে সেলিব্রিটি সকলেই মেতেছেন কবি প্রণামে৷ নারী-পুরুষের পরনে রাবীন্দ্রিক পোশাক, মানে ধুতি-পাঞ্জাবি আর ডিজাইনার শাড়ি-অ্যাক্সেসরিজ৷ জোড়াসাঁকোয় কবির বিভিন্ন প্রতিকৃতির সামনে বিভিন্ন পোজে সেলফি তোলার হিড়িক৷ তার মধ্যেই চোখে পড়ল এসএফআই-এর চওড়া ব্যানার নিয়ে তরুণ প্রজন্মের দল৷ তাতে লেখা– ‘ঝড়কে আমি করব মিতে / ডরব না তার ভ্রূকুটিতে’৷


শুধু এসএফআই নয়, বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুকে এদিন দেখা গেল তাঁদের একদা ‘বুর্জোয়া কবি’ রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে৷ জো.ড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্র প্রতিকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও মানেই হয় না৷ যতদিন মানব সভ্যতা থাকবে, ততদিন রবীন্দ্রনাথ থাকবেন৷ আজ যে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কথা বলা হচ্ছে, তা রবীন্দ্রনাথ বহু যুগ আগে ভেবে গিয়েছেন৷ তাই পরিবেশ রক্ষার কথা বলে গিয়েছেন৷

বিশ্বব্যাপী পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷ মানুষের কল্যাণে সমাজব্যবস্থার কথা বলে গিয়েছেন তাঁর সৃষ্টিতে৷ বিমান বসু বলেন, রবীন্দ্রনাথ যে কাজ করে গিয়েছেন, তার মূল্যায়ন করা এক জীবনে কখনই সম্ভব নয়৷ এদিন আরএসপি-এর পক্ষ থেকে অশোক ঘোষকেও দেখা গিয়েছে জোড়াসাঁকোতে ফুলের মালায় কবিকে সম্মান জানাতে৷

সদ্য দলবদল করা উত্তর কলকাতা কেন্দ্রের প্রার্থী তাপস রায়কে এবার পঁচিশে বৈশাখে দেখা গেল জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্র প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করতে৷ বললেন, আমাদের নিজেরে জন্মদিনের থেকেও রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনটি বেশি প্রিয়৷ এদিন তাপস রায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে ‘ভারত মাতা কী জয়’ বললেন৷ শেষে উচ্চারণ করলেন ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল…’৷ যে গানটিকে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য সঙ্গীতের মর্যাদা দিয়েছেন৷

পঁচিশে বৈশাখের সকালে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি পরিণত হয়েছিল সমস্ত রাজনৈতিক দলের মহামিলনের স্থান হিসেবে৷ এদিন মন্ত্রী শশী পাঁজা এসেছিলেন জোড়াসাঁকোয় ঠাকুরবাড়িতে৷ রবীন্দ্র প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে বললেন, এবার নির্বাচনী আচরণবিধির জন্য কবি প্রণাম অনুষ্ঠান বাহ্যিকভাবে আড়ম্বরহীন হলেও অন্তরের শ্রদ্ধার্পনে কোনও খামতি নেই৷ উত্তর কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি যেখানে রবীন্দ্রনাথ শিশুকালে পড়েছিলেন, রবীন্দ্রকানন যেখানে বঙ্গভঙ্গ আন্দোনের সময়ে রবীন্দ্রনাথ রাখীবন্ধন উৎসবের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেখানে রবীন্দ্র জন্মোৎসব মর্যাদার সঙ্গে পালিত হচ্ছে৷ তৃণমূল সরকারের আমলেই নিমতলা শ্মশানে যেখানে রবীন্দ্রনাথের দাহ করা হয়েছিল, তার সংস্কার হয়েছে৷ সেখানেও রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে৷

তবে এবার যে ভোটের আবহে রবীন্দ্র আবেগের উষ্ণতা কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে, সেকথা অস্বীকার করা যাবে না৷ তবুও বিধানসভায় যথারীতি রবীন্দ্র প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়৷

আর বিকেল পাঁচটায় ক্যাথিড্রাল রোডে তথ্য সংস্কৃতি দফতর আয়োজিত রবিপ্রণাম অনুষ্ঠানে ফুলে ফুলে ছেয়ে একাই প্রকট জেগে রইলেন রবীন্দ্রনাথ৷ তাঁকে গানে- কবিতায়- আলেখ্যে প্রণাম জানালেন বিভিন্ন শিল্পীরা৷ নিবাচনী আচরণবিধির জন্য মঞ্চে ওঠার ক্ষেত্রে বাধা রয়েছে রাজনৈতিক নেতাদের৷ তবুও কবির প্রতি শ্রদ্ধা অর্পণ করতে হুগলিতে নির্বাচনী প্রচার সেরে সন্ধে ছ’টা নাগাদ ক্যাথিড্রাল রোডের অনুষ্ঠানে এলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যা৷ মঞ্চের নীচে রাখা রবীন্দ্র প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে মাথা নত করলেন৷

ভোটের আবহে নির্বাচনী প্রচারে কোনও ছেদ পড়েনি৷ তবুও রবীন্দ্রনাথের চরণে মাথা নত করে মনে মনে গাইতেই হল আমারে না যেন করি প্রচার আমার আপন কাজে৷ বোঝা গেল ভোটের উত্তাপে ‘রবি’র কাছে ছায়া খুঁজলেন রাজনৈতিক নেতারা৷