কুৎসার জবাবে উন্নয়ন অস্ত্রেই বাজিমাত তৃণমূলের

প্রবীর ঘোষাল: ফের প্রমাণ হল, বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়! মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূল কংগ্রেসের ‘সেকেন্ড ইন কম্যান্ড’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিপুণ পরিকল্পনায় ভেস্তে গেল বিজেপির সব কেরামতি৷ নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ বুঝেও বোঝেননি, বাংলার মাটি তৃণমূল কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি৷ খুব সহজে এই পবিত্র ভূমিকে অপবিত্র করা যাবে না৷ উন্নয়ন বনাম কুৎসার লড়াই ছিল এবারের বাংলার ভোটের প্রধান ইসু্য৷ উন্নয়নকে হাতিয়ার করেই মমতা-অভিষেক উড়িয়ে দিলেন বিরোধীদের৷

উত্তরপ্রদেশে যেমন রামমন্দির, ঠিক তেমনই পশ্চিমবঙ্গে ছিল সন্দেশখালি ইসু্য৷ যোগীরাজ্যে তো খোদ রামমন্দির সংলগ্ন লোকসভা কেন্দ্র ফৈজাবাদেই হেরে ভূত হয়েছে গেরুয়া ধ্বজাধারীরা৷ আর এ রাজ্যে সন্দেশখালি ইসু্যতে বিজেপি বসিরহাটে মুখ থুবড়ে পড়েছে৷ বাংলায় তো কেবল পদ্মফুল নয়, ভোটযুদ্ধে তাদের সঙ্গে ছিল সিপিএম-কংগ্রেসের অশুভ জোট৷ বেচারি অধীর চৌধুরি এখন নিশ্চয়ই নিজের হাত কামড়াচ্ছেন! তৃণমূল নেত্রী ভোটের আগে জাতীয় রাজনীতির স্বার্থে কংগ্রেসকে এ রাজ্যে দু’টি আসন ছাড়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন৷ কিন্ত্ত অধীর যে প্রস্তাব করে বন্ধুত্বের বন্ধনে আলিঙ্গন করেছিলেন মহম্মদ সেলিমদের সিপিএমকে৷ ভোটের ফলে দেখা গেল, কংগ্রেসের জাত গেছে, কিন্ত্ত পেট ভরেনি৷ অধীর-সেলিম, দু’জনেরই ভোটে ভরাডুবি হয়েছে৷

২০১১ সালে রাজ্যে পরিবর্তনের পর মসনদে বসেই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর প্রধান লক্ষ্য, ৩৪ বছর অনুন্নয়নের অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া রাজ্যটিকে উন্নয়নের দিশা দেখানো৷ মমতার কথার সঙ্গে কাজের মিল, কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই রাজ্যবাসী দেখতে অভ্যস্ত৷ রাজ্যপাটে এসে কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি প্রমাণ করেছেন, ইচ্ছা থাকলে উন্নয়নের কাছে দরাজ হওয়াই যায়৷ মুখ্যমন্ত্রীর চেম্বারে বসে আমলাদের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি উন্নয়নের কাজ সারেননি৷ টিম নিয়ে জেলায় জেলায় ঘুরেছেন৷ জনপ্রতিনিদিদের সামনে সরকারি আধিকারিকদের হাজির করে প্রশাসনিক বৈঠক করেছেন নিয়ম করে৷ কোন কাজে কোথায় সমস্যা হচ্ছে, কীভাবে তার সমাধান করতে হবে, ওইসব বৈঠকেই তার ফয়সালা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ ভূভারতে আজ পর্যন্ত কোনও মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি সাধারণ মানুষের মধ্যে গিয়ে এভাবে প্রশাসন পরিচালনা করেননি৷ তার পাশাপাশি ছিল, নানা জনমুখী সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্প৷ মা-মাটি-মানুষের এইসব প্রকল্প জনতা জনার্দনকে উদ্বুদ্ধ করেছে৷ তাই তারা মনে করে, বংলার মেয়েই শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় তাদের প্রধান ভরসা৷
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বাংলায় কিছুটা ভালো ফল করে বিজেপি৷ তারপরেই তৃণমূল কংগ্রেসের হাল ধরতে মমতার সঙ্গী হন অভিষেক৷ টিম নিয়ে তিনি মাঠে নামেন৷ মমতার মস্তিষ্কপ্রসূত নানা সরকারি কর্মসূচির সফল রূপায়ণের সঙ্গে দলীয় সংগঠনকে মানুষের মধ্যে আরও নিবিড় সংযোগ গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করেন অভিষেক৷ তার ফল মেলে দু’বছর পর ২০২১ সালে বিধানসভার নির্বাচনে৷ রেকর্ড আসনে জিতে তৃতীয়বারের জন্য মমতা মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন৷ তিনি প্রশাসনকে সজাগ এবং সতর্ক রাখেন, যাতে কোনও পরিষেবার কাজে ত্রুটি না থাকে৷


আর অভিষেক দলকে চাঙ্গা রাখতে নানা কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন৷ বাংলার প্রতি মোদি সরকারের বঞ্চনার অভিযোগে দিল্লির রাজপথ পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেন তিনি৷ বার বার সিবিআই-ইডি’কে তাঁর পিছনে লেলিয়ে দেন মোদি-শাহরা৷ কিন্ত্ত অভিষেক মাথা নত করেননি৷ তিনি বিজেপি-বিরোধী জেহাদে অবিচল থেকেছেন৷
তিন-চার মাস আগে থেকেই মমতা এবং অভিষেক লোকসভার ভোটে প্রচারে মাঠে নামেন৷ দু’জনে সভা, পদযাত্রা মিলিয়ে কমপক্ষে ৩৫০ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন৷ এই প্রতিবেদক আগেই একটি প্রতিবেদনে বলেছিলেন, প্রচারে মমতা-অভিষেকের যুগলবন্দি বিরোধীদের নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছে৷ শেষ প্রহরে তো মোদিকে যেভাবে প্রচারে তাড়া করে বেড়িয়েছেন মমতা, সেটাও উল্লেখের অবকাশ রাখে৷ ৪৪ ডিগ্রি গরমের মধ্যে তিনি অবলীলাক্রমে ১০-১২ কিলোমিটার পদযাত্রা করেছেন৷ অভিষেক তো রোদে পুড়ে দিনভর ঘুরে প্রচার করে বেড়িয়েছেন৷ রাতে বসে গোটা রাজ্যের সব ব্লকে দলের কোথায় কী কাজ হচ্ছে, কোথায় দুর্বলতা, তা নিয়ে ম্যারাথন মিটিং করেছেন৷ দিন-রাতকে এক করে অভিষেকের কাজের সঙ্গে মমতার বাংলাকে বাঁচানোর আওয়াজ সব মানুষের ঘরে পৌঁছেচ্ছে৷ তাতেই বজিমাত করেছে তৃণমূল কংগ্রেস৷ আর কুপোকাৎ হয়েছে বিজেপির সহ প্রতিপক্ষ৷