• facebook
  • twitter
Sunday, 8 September, 2024

‘জান দেব তবু জবান দেব না, করুক না যত হামলা’

১৯-এর কবিতা ও গান ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষাশহিদদের সম্পর্কে বিশ্বের মানুষ আজ অবহিত৷ বাংলা ভাষাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে মর্যাদা দিতে হবে— এই দাবিতে শুরু হয়েছিল আন্দোলন৷ আর এই আন্দোলন করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বর, শফিউরের মতো তরুণরা৷ কালক্রমে ওই দিনটিই আজ সারা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা

১৯-এর কবিতা ও গান

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষাশহিদদের সম্পর্কে বিশ্বের মানুষ আজ অবহিত৷ বাংলা ভাষাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে মর্যাদা দিতে হবে— এই দাবিতে শুরু হয়েছিল আন্দোলন৷ আর এই আন্দোলন করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বর, শফিউরের মতো তরুণরা৷ কালক্রমে ওই দিনটিই আজ সারা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃত৷

১৯৬১ সালে অনুরূপ একটি আন্দোলনে আসামের বরাক উপত্যকায় শিলচর শহরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন ১০ জন তরুণ ও একজন তরুণী৷ তাঁরাও আন্দোলন করেছিলেন মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে৷ তাঁদের দাবি ছিল, বাঙালি অধু্যষিত বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দিতে হবে৷ কিন্ত্ত তৎকালীন আসাম সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারও প্রথমে এই দাবির প্রতি কর্ণপাত করেনি৷ তখন এখানকার বাঙালিরা আওয়াজ তুলেছিলেন, ‘জান দেব তবু জবান দেব না’৷ এই আন্দোলনের কথা, শহিদদের প্রাণ বিসর্জনের কথা বহুদিন পর্যন্ত আসামের বাইরে সেভাবে আলোচিত হয়নি৷ কালক্রমে এখন এই ভাষা আন্দোলনের কথাও পৃথিবীব্যাপী বাঙালির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে৷ অন্যান্য ভাষার গবেষকরাও জেনেছেন এই আন্দোলনের কথা৷

বরাক উপত্যকার ওই ভাষা শহিদদের মধ্যে যে তরুণী প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁর নাম কমলা ভট্টাচার্য৷ কবি মণীশ ঘটক তাঁর ‘শিলচরের কমলা ভট্টাচার্যের মায়ের কান্না’ কবিতায় লিখেছেন— ‘সে যে বলে গেল জান দেব তবু জবান কখনো দেব না৷ / ভাত বেড়ে রেখো, ফিরে এসে খাবো, না এলেও মাগো ভেবো না৷ /… যে ভাষায় মাকে প্রথম ভেবেছি, সে ভাষা আমার দেবতা / কথা কইবার অধিকার তাতে— নেবই আমরা নেব তা / নেহরু ফারুক চালিহার দল বলে, বুলেট না বাংলা / জান দেব তবু জবান দেব না করুক না যত হামলা৷’ এটাই ছিল সেদিনের সেই ভাষা আন্দোলনের মূল কথা৷

এই ভাষা আন্দোলন নিয়ে বাংলায় প্রচুর কবিতা এবং গানও রচিত হয়েছে৷ আসামের করিমগঞ্জের বাসিন্দা কবি দিলীপকান্ত লস্কর এইসব কবিতা ও গান নিয়ে বৃহৎ একটি সংকলন সম্পাদনা করেছেন ‘১৯-এর কবিতা ও গান’ নামে৷ এই সংকলনের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে বিশ্ব-সংকলন হিসেবে৷ দিলীপকান্তি লস্কর জানিয়েছেন— ‘বর্তমান সংস্করণের উদ্দেশ্য যেমন বিশ্বের কবিদের সঙ্গে উনিশে মে-র তথা মাতৃভাষার কবিতা নিয়ে সম্পর্ক ও আত্মীয়তা সৃষ্টি করা, তেমনই একাধারে উনিশের বার্তাটুকু কবিতার মাধ্যমে বিশ্ববাসী কবি বা কবিতাপ্রেমী ও পাঠকের মর্মে তুলে ধরা৷ কারণ কবিরা নিজ স্বজনকে হূদয় দিয়ে চেনেন এবং কবিতা কবির হূদয়ের কথা বলে৷’

ভাষা আন্দোলনে কবিতার পাশাপাশি গানের অবদান, বিশেষ করে লোকগানের অবদান কম নয়৷ সম্পাদক জানিয়েছেন, উনিশে মে-র আন্দোলনের ক্ষেত্রে ভাটসংগীত নামে এক বিশেষ ধারার সংগীতের সৃষ্টি হয়েছে৷ তাই এই সংকলনে সেই ধরনের কিছু সংগীতকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷ প্রতিবেশী অন্য ভাষার কবিতায় তাঁদের নিজস্ব ভাষা সংগ্রামের অভিজ্ঞতাপূর্ণ কবিতা, যা উনিশের আন্দোলনের মতোই সমভাবাপন্ন, সেরকম কবিতাও বাংলা ভাষান্তরে রাখা হয়েছে৷ আবার ভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলাতে উনিশে মে-র কবিতা লিখেছেন৷ তাঁদের কবিতা নিয়েও সমৃদ্ধ হয়েছে এই সংকলন৷

এই সংকলনের প্রথম সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০২ সালে৷ তার ভূমিকায় সম্পাদক দিলীপকান্তি লস্কর জানিয়েছিলেন, ‘ভারতে তথা বরাক উপত্যকায় সংগঠিত ভাষা সংগ্রামের প্রধান মূলটি রয়েছে ভারত বিভাগ এবং বিভিন্ন বিষয়ে প্রশাসনিক পদক্ষেপে৷ সিলেট তথা আসামের রাজনৈতিক মানচিত্রের অদলবদলের মধ্যেই প্রোথিত৷ এর থেকে উদ্ভূত উদ্বাস্ত্ত সমস্যা, আসমের বাঙালিদের অস্তিত্বের সমস্যা, বারংবার সংগঠিত বঙ্গাল খেদা ও আসাম আন্দোলন এবং কুখ্যাত ভাষা দাঙ্গার নগ্ননিষ্ঠুর বহিঃপ্রকাশ তথা হাজার হাজার বাংলা ভাষাভাষীর রক্তপ্লাবনে অলিখিত ভাষা শহিদদের ইতিহাস, ফরিয়াদি আন্দোলন, বিদেশি বিতাড়ন ইত্যাদি প্রতিটি বিষয় বা অনুষঙ্গই কোনও না কোনওভাবে বাংলাভাষা সংগ্রামের বিস্তৃত প্রেক্ষাপট ও অবয়বের পরিপূরক৷ ফলে ১৯-এর কবিতা তথা ভারতে বাংলা ভাষা সংগ্রামের কবিতা ব্যাপকার্থে উল্লিখিত সব অনুষঙ্গে লিখিত কবিতাবলীর সমষ্টি থেকেই সংগ্রহ করতে হয়, যদিও প্রধান বিবেচ্য যে ১৯শে মে— তাতে নেই কারোরই কোনও সংশয়৷’ সম্পাদকের এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, এই সঙ্কলনের মূল উদ্দেশ্য অথবা এর প্রয়োজনীয়তাই বা কী৷

বাংলাদেশের কবিদের লেখা একুশে ফেব্রুয়ারি-কেন্দ্রিক কবিতা হলেও তা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা ও ভাষা-আন্দোলনের ওপর সমভাবাপন্ন কবিতা৷ একুশের এবং উনিশের আন্দোলন আলাদা হলেও তা যেহেতু বাংলা ভাষারই মর্যাদা রক্ষার জন্য, তাই এই দুইয়ের মধ্যে ভাষাভিত্তিক সাদৃশ্য তো আছেই৷ সম্পাদক দিলীপকান্তি লস্কর বলেছেন— ‘আমি সম্পাদক হিসেবে সাধারণ মিলের জায়গায়, সমভাবাপন্নতা এবং প্রাসঙ্গিকতাকেই প্রাধান্য দিয়েছি৷’ প্রকৃতপক্ষে, বাংলা ভাষা যেহেতু উনিশে মে-র আন্দোলনের মূল বিষয়, তাই এই আন্দোলন বিষয়ক কবিতার পাশাপাশি শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষার গৌরব ধ্বনিত হয়েছে, এমন সব ধরনের কবিতাই এখানে সংকলিত হয়েছে৷ যেমন, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বঙ্গভাষা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশ পর্যায়ের গান ‘আজি বাংলাদেশের হূদয় হতে’ অথবা জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি৷’ তবে কুমুদরঞ্জন মল্লিক, বনফুল, সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী, মণীশ ঘটক, স্বপনবুড়ো প্রমুখ কবিরা যে সরাসরি উনিশে মে-র আন্দোলন নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন, তা এই সংকলন না পড়লে এখনকার অনেক পাঠকই হয়তো জানতে পারতেন না৷

কুমাররঞ্জন মল্লিক তাঁর ‘বাংলা ভাষার শহিদ’ কবিতায় লিখেছেন— ‘ভুখা হয়েছিল জানিনে কেন যে সেথা কামাখ্যা মাতা / মুণ্ডমালী কি প্রীত হইবেন লয়ে তোমাদের মাথা?’ বনফুল লিখেছেন— ‘প্রমাণ করে দিয়ে গেলে মৃতের দেশে তোমরা ছিলে জিতা / প্রমাণ করে দিয়ে গেলে তোমদেরই সত্যি ছিল প্রাণ / প্রাণের আগুন দিয়ে বন্ধু জ্বেলে দিলে অত্যাচারীর চিতা / প্রমাণ করে দিয়ে গেলে বাংলা মায়ের তোমরা সুসন্তান৷’ তৎকালীন দেশে শাসকদের প্রতি ধিক্কারও উঠে এসেছে কোনও কোনও কবিতায়৷ মণীশ ঘটক যেমন লিখেছেন, তেমনই রামেন্দ্র দেশমুখ্য সরাসরি বলেছেন— ‘কবির ধিক্কার শোন, হে চালিহা-নেহরুর দল,/ জীবনের রাঙা পদ্মে প্রভাতের আলোর শপথ, / দুর্বার বন্যায় নামে মৃতু্যঞ্জয়ী জনতার ঢল / প্রাণের বসন্তে জাগে মন আর দৃপ্ত মনোরথ৷’ এর পাশাপাশি একেবারে বর্তমান সময়ের কবিদের কবিতায় ফুটে উঠেছে বাংলা ভাষা ও ভাষা শহিদদের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা, আবেগ ও ভালোবাসা৷

৫৫২ পৃষ্ঠার এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ভারতের ২২৫ জন বাঙালি কবির কবিতা, বাংলাদেশের ৪৮ জন কবি ও বিদেশে বসবাসাকারী ১৫ জন কবির কবিতা৷ উনিশের গান আছে ১৯ জন কবি-গীতিকারের এবং অন্য ভাষা থেকে অনূদিত হয়েছে ১৩ জন কবির কবিতা৷ প্রায় দুশো বছরের কবিতা স্থান পেয়েছে এমন একটি সংকলন করে ওঠা খুব সহজসাধ্য কাজ নয়৷ কিন্ত্ত এমন কাজটি সুসম্পন্ন করেছেন দিলীপকান্তি লস্কর৷

অসমিয়া ভাষার কবি সমীর তাঁতির লেখা অসমিয়া কবিতার বাংলা অনুবাদে একটি কবিতা ‘বুকে একেকটি বুলেট নিয়ে’৷ এর কয়েকটি পঙ্ক্তি উল্লেখ করতেই হয়৷ ‘বুকে একেকটি বুলেট নিয়ে / তোমরা শুয়ে আছ / অনন্ত কালের জন্যে / … হে মৃত, আমাকে দোষী করো এই / দিনটির জন্যে… / … তোমাদের চিনতে / না-পারা ঘাতকের জন্যে, আমাকে দোষী করো’৷ অসমিয়া কবি হীরেন্দ্রকুমার ভগবতী লিখেছেন— ‘প্রতি বছরেই ১৯শে মে-র অশ্রু ঝরায় / চিৎকার করে ব্যথায় / আজকেও তুষের আগুনে চেপে রেখেছে সহস্র দলিল / বর্ণমালার পরশে আজও কৃষ্ণচূড়া ফোটে৷’ অসমিয়া কবি গীতাঞ্জলি বরকটকী লিখেছেন, ‘১৯শে মে’ নামেই একটি কবিতা৷ আর বড়োভাষী কবি অঞ্জলি বসুমাতারি লিখেছেন ‘শহিদ কৃষ্ণচূড়ার শোকগাথা’৷ তার কয়েকটি পঙ্ক্তি এরকম— ‘আজ আমার মৃতু্যদিবস / এই দিনটিতেই হয়েছিল শহিদের মৃতু্য / হাওয়া আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছিল ডালে ও পাতায় / পাখিরা গেয়ে যাচ্ছিল মুক্ত আকাশের গান / যখন, আজকের দিনটিতে আমি শহিদ হয়েছিলাম৷’

উনিশে মে-র দিনগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি গানের স্বরলিপিও ছাপা হয়েছে এই সংকলনে৷ আগ্রহী গায়কেরা এই স্বরলিপি অনুযায়ী গানগুলি কণ্ঠে তুলে নিতেও পারবেন৷ সব মিলিয়ে বৃহৎ এই সংকলনটি ভবিষ্যতের গবেষণার আকরগ্রন্থ হয়ে উঠেছে৷
—সৈয়দ হাসমত জালাল

১৯-এর কবিতা ও গান (দ্বিতীয় সংস্করণ), বিশ্ব-সংকলন৷ সম্পাদনা ও সংকলন: দিলীপকান্তি লস্কর৷ লালনমঞ্চ প্রকাশনী, করিমগঞ্জ-৭৮৮৭১০, আসাম৷ মূল্য: ৪০০ টাকা