বরুণ দাস
দীর্ঘ সাড়ে ছ’বছর কারাগারের অন্তরালে বন্দিজীবন কাটানোর পর সম্প্রতি দেশের শীর্ষ আদালতের নির্দেশে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা সোমা জামিন পেলেন৷ যদিও বেশকিছু কড়া শর্তে৷ সেসব শর্ত মেনে তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে৷ তাকে নিয়মিত স্থানীয় থানায় হাজিরে দিতে হবে৷ জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-এর সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা সহ তাঁর সেলফোনের সঙ্গে সংযোগ রাখতে হবে৷ ফোনের জিপিএস চালু রাখতে হবে৷
এখানেই শেষ নয়৷ আরও সব কঠিন শর্ত আছে৷ তাঁকে মহারাষ্ট্রেই থাকতে হবে৷ তিনি নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে পা ফেলতে পারবেন না ইত্যাদি ইত্যাদি৷ অর্থাৎ জামিন পেলেও তিনি নাগপুরে নিজের ফ্ল্যাটে পরিবারের সঙ্গেও থাকতে পারবেন না৷ শীর্ষ আদালতের মাননীয় বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসুর বেঞ্চ সোমা সেনের জামিন মঞ্জুর করে বলেছেন, তাঁর বয়স ও শারীরিক অবস্থা দেখে জামিনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোনও যুক্তি নেই৷ ছ’বছরের ওপর জেলে কাটিয়ে ফেলেছেন৷ তাঁর বিরুদ্ধে এখনও চার্জ গঠন হয়নি৷
জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ যেসব ‘তথ্যপ্রমাণ’ দিয়েছে, তাতে প্রাথমিকভাবে অধ্যাপিকা সোমা সেনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস আর্থিক মদতের যুক্তি খাড় করা যায়নি৷ প্রাথমিক তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর কোনও অভিযোগের প্রমাণও মেলেনি৷ অন্ততঃ দেশের শীর্ষ আদালতের তেমনই পর্যবেক্ষণ এবং অভিমত৷ তবে কেন তাঁকে দীর্ঘ সাড়ে ছ’বছর বন্দিজীবন কাটাতে হল? আসলে এদেশে এমনটাই হয়৷ এমনটাই হয়ে থাকে৷ এখানে উল্লেখ্য, ৬৬ বছরের শ্রীমতী সোমা সোমা সেন নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির বিভাগীয় প্রধান ছিলেন৷
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরের কয়েকমাস আগেই মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরেগাঁওয়ে দলিতদের অনুষ্ঠানে হিংসার ঘটনায় একাধিক সমাজকর্মী, আইনজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিক্ষাবিদদের সঙ্গে অধ্যাপিকা সোমা সেনকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল৷ পরে তাঁদের বিরুদ্ধে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে ‘খুনের ছক কষা’র গুরুতর অভিযোগও আনা হয়৷ পরন্ত্ত সোমা সেনের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ মাওবাদি সংগঠনকে ‘অর্থ জোগানো’র মতো বিভিন্ন অভিযোগে ভারতীয় দন্ডবিধির নানা ধারার সঙ্গে কঠোর সন্ত্রাস বিরোধি আইনে (ইউপিএ) মামলা রুজু করা হয়৷
সেই কুখ্যাত মামলার জেরেই তিনি ও তাঁর অন্যান্য সঙ্গীদের বিনাবিচারে কারাবন্দি করে রাখা হয়েছিল৷ গত বছর কড়া শর্তে সমাজকর্মী শ্রীমতী সুধা ভরদ্বাজ জামিন দিতে গিয়ে মহামান্য শীর্ষ আদালত কী বলেছেন একবার জেনে নেওয়া যাক৷ ‘প্রাথমিক ভাবে সঠিক’ বলে বিশ্বাস করার মতো কোনও সঙ্গত কারণ নেই৷ ইউএপিএ ধারায় এমন কোনও অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে নেই, যার জন্যে জামিন দেওয়া যায় না৷ কোনও সন্ত্রাসবাদি কার্যকলাপে জড়িত থাকার মতো প্রমাণও মেলেনি৷ তিনি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে অর্থ জুগিয়েছেন বা তার জন্য অর্থ পেয়েছেন-এমন কোনও ইঙ্গিতও মেলেনি৷ অথচ এসব সত্ত্বেও তাঁকে প্রায় সাড়ে ছ’বছর আটকে রাখা হল৷
এবার একটু পিছনে ফিরে তাকান৷ বিহার-ঝাড়খণ্ডের পশ্চাদপদ আদিবাসীদের সংবিধান-স্বীকৃত ন্যায্য নাগরিক অধিকার আদায় করা নিয়ে অজীবন লড়াই-আন্দোলন করা স্ট্যান স্বামীর ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছে৷ অভিযোগ প্রমাণ না হলেও বিনাবিচারে তাঁকে আমৃতু্য কারাগারে বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছে৷ বার বার জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য হয়েছে৷ এমন কি, বার্ধক্যজনিত কারণে চিকিৎসার প্রয়োজনেও জামিন মেলেনি তাঁর৷ অসুস্থতাজনিত কারণে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় খাবার গ্রহণ সম্ভব না হওয়ায় তিনি টিউব ব্যবহার করতেন৷
কারাগারে তাঁকে সে সুযোগটুকুও দেওয়া হয়নি৷ স্বাধীন রাষ্ট্রে একজন বিচারাধীন নাগরিকের নূ্যনতম মানবিক অধিকারটুকুও সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়েছে৷ জামিন না পাওয়ায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে অবশেষে জেলের মধ্যেই তাঁর যন্ত্রণাময় মৃতু্য ঘটে৷ এই মর্মান্তিক ঘটনাও আমাদেরকে কিছুমাত্র বিচলিত করেনি৷ আমরা স্বাভাবিক জীবনে যেমন ছিলাম, ঠিক তেমনই আছি৷ পণ্যবাদি জীবনে মেতে আছি ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আবর্তে৷ আসলে নিজের গায়ে তাপ না লাগা পর্যন্ত আমরা পিঠ ফিরে শুতে অভ্যস্থ নই৷
তাই সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার নিয়ে আজীবন কাজ করা স্ট্যান স্বামী-সোমা সেন-সুধা ভরদ্বাজ-গৌতম লাখটিয়াদের বিনাবিচারে বছরের পর বছর (‘সরকারের গোপন নির্দেশে’) পুলিশ-প্রশাসন কারাবন্দি করে রাখলেও আমরা সামান্য নড়েচড়ে বসি না৷ বসার প্রয়োজনটুকুও বোধ করি না৷ ফলে আমাদের এই নির্বিকল্প কাপুরুষতায়, আমাদের এই দায়বদ্ধতাহীন মানসিকতায় শাসক তার রাষ্টযন্ত্রকে সহজেই অমানবিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে৷ এবং পারছেও৷ আমরা ড্রয়িংরুমের নিরাপদ আশ্রয়ে বসে বিপ্লবের বানি আওড়াই৷
বর্তমানে তিহাড়বাসী ‘বীরভূমের বাঘ’কে শুধু দোষ দিয়ে লাভ নেই৷ আমাদের অধিকাংশই তো আসলে ‘সবজান্তা’ সব কাগুজে বাঘ৷ বামপন্থি সাজার ভনিতা বা ভাব দেখাই৷ অবসর সময়ে অন্যের দোষ-ত্রুটি নিয়ে মাথা ঘামাই৷ অথচ নিজেদের নাগরিক দায়িত্ব-কর্তব্য নিয়ে নিতান্তই নির্বিকার৷ মুখে নিজেদেরকে ‘বামপন্থি’ বলে বিজ্ঞপিত করলেও ব্যক্তিজীবনে চূড়.ান্ত অবামপন্থি (পণ্যবাদি) দর্শনে বিশ্বাসী৷ মোটা বেতনের চাকরি কিংবা পর্যাপ্ত পেনশন নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য-জীবন কাটাতে কাটাতে ‘মৌখিক বিপ্লব’-এ অভ্যস্থ হয়ে উঠেছি৷
আসলে রাজনীতি নয়, সংকীর্ণ দলীয় দর্শনে আটকে আছি৷ ভালো-মন্দ বিচারবোধ হারিয়ে ফেলেছি৷ সঠিক রাজনৈতিক দর্শন না থাকায় এক সময় ‘বুর্জোয়া’ ‘দুর্নীতিগ্রস্থ’ কংগ্রেসকে গালাগালি দিতাম; এখন সেই ‘বুর্জোয়া’ দুর্নীতিগ্রস্থ’ কংগ্রেসেরই গুণগান করতে বেশি আগ্রহ দেখাই৷ তাদের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগগুলি খণ্ডন করতে মুখিয়ে থাকি৷ অন্যদিকে সিপি(আই)এম-কে একসময় ‘সংশোধনবাদি’ বলে তীব্র গালাগাল দিলেও এখন তাদের বিকল্প খঁুজে পাই না৷ কী অদ্ভূত দর্শনে বিভোর আছি৷
এবার আসা যাক জামিনের কথায়৷ যে কথা দিয়ে এই উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধের সূত্রপাত৷ সদ্য জামিন পাওয়া অধ্যাপিকা সোমা সেনের প্রসঙ্গে৷ বিনাবিচারে বন্দি করে রাখার ক্রমশঃ প্রবণতা বাড়ছে৷ শুধুমাত্র পুলিশি অভিযোগের ভিত্তিতে সোমা সেনদের আটকে রাখার আইনি (নাকি বেআইনি) পদক্ষেপকে তীব্র ধিক্কার জানিয়েছেন নাগরিক অধিকার রক্ষাকারী সংগঠনগুলি৷ কিন্ত্ত দেশের বৃহত্তর নাগরিক সমাজ দিব্যি মজে আছেন ব্যক্তিসুখে৷ ‘মৌখিক বিপ্লব’ ছাড়া তাদের মধ্যে মানবিক তাপ-উত্তাপের নামমাত্র গন্ধ নেই৷
‘জামিনই নিয়ম, জেল ব্যতিক্রম, এই নীতি উপেক্ষিত হচ্ছে নিম্ন আদালতগুলিতে৷’ সম্প্রতি গুজরাতে জেলা আদালতের বিচারকদের একটি সম্মেলনে একথা স্মরণ করিয়ে দিলেন দেশের শীর্ষ আদালতের মাননীয় প্রধান বিচারপতি ডি.ওয়াই. চন্দ্রচূড়৷ তাঁর আরও সংযোজন, ‘নাগরিকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারকে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা বদালাতে হবে৷ তাতে একদিকে যেমন আমিন বিষয়ে সাধারণ মানুষের ধারণার পরিবর্তন হবে, অন্যদিকে তেমনই কমবে উচ্চতর আদালতগুলির উপর চাপ’
কিভাবে বাড়ছে ‘উচ্চতর আদালতগুলির উপর চাপ?’ নিম্ন আদালতে জামিন প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় দেশের উচ্চ এবং শীর্ষ আদালতে জামিনের আবেদন বাড়ছে৷ তাঁর কথায়, জামিন আবেদনের বিপক্ষে পুলিশের যুক্তিগুলিকে যথেষ্ট খঁুটিয়ে না দেখেই বিচারকরা জামিন প্রত্যাখ্যান করছেন৷’ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশ তো আসলে সরকারের মুখাপেক্ষি হয়েই ‘কাজ’ করে৷ প্রকৃত নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করে না; ‘ওপরওয়ালার নির্দেশ’-এর দিকে তাকিয়ে থাকে৷ তাদের নিজস্ব সত্তাও এখানে কাজ করে না৷ ‘কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম হয়৷’
শীর্ষ আদালতের মাননীয় প্রধান বিচারপতি ডি.ওয়াই. চন্দ্রচূড়ের অভিযোগ মোটেই অমূলক নয়৷ তার জ্বলন্ত প্রমাণ এদেশে বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা সাজাপ্রাপ্ত বন্দির তিনগুন৷ এগুলো আদৌ গালগল্প নয়, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র বিভাগের পরিসংখ্যানই একথা জানাচ্ছে৷ তাদের ২০২২-এর রিপোর্ট অনুযায়ী মোট ৫,৫৪,০৩৪ বন্দির মধ্যে ৪,২৭,১৬৫ জনই বিচারাধীন বন্দি-শতাংশের হিসেবে ৭৬%৷ এদের একটা বড় অংশই নিম্মবর্গের গরিব ও দুস্থ মানুষ৷ অভাবের জন্য অনেক সময়ই আইনজীবীর খরচ বহন করতে পারেন না৷
আগের কুখ্যাত ইউএপিএ আইনে অভিযুক্তকে কমপক্ষে নব্বই দিন আককে রাখা যেত৷ সরকার-বিরোধিতাকে ‘রাষ্টবিরোধি’ তকমা দিয়েই সমাজকর্মী সোমা সেনদের জামিন বার বার নাকচ করা হয়েছে৷ পুলিশ-প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন চক্রান্তেই সরকারি আইনজীবী মহামান্য আদালতে বার বার অভিযুক্তদের জামিনের তীব্র বিরোধিতা করেছেন এখনকার সংশোধিত নতুন ফৌজদারি আইনেও (জুলাই থেকে লাঘু হবে) অভিযুক্তকে পুলিশের হেফাজতে রাখার সময়সীমা পনেরো দিন থেকে বেড়ে নব্বই দিন করা হয়েছে৷
বাস্তব ঘটনা হল, সরকার তথা পুলিশ-প্রশাসন (রাজনৈতিক মতবাদ নির্বিশেষে রাজ্য কিংবা কেন্দ্র) যার ওপরে বিরূপ, তাকে বিচারাধীন বন্দি করে কারাগারে আটকে রেখে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে আগ্রহী৷ পুলিশ ইচ্ছে করেই ঢিমেতালে তদন্তের কাজ চালায় যাতে অভিযুক্তকে বেশিদিন আটকে রাখা যায় গারদে৷ অভিযুক্তের পরিবারকেও আর্থিক ও মানসিক দিক থেকে চূড়ান্ত বিপর্যস্থ করে তোলা যায়৷ একই সঙ্গে দুই উদ্দেশ্য পূরণ করা আর কি৷ এভাবেই নাগরিক অধিকারকে গলা টিপে হত্যা করা হয় রাষ্ট্রীয় মদতে৷
গণতান্ত্রিক দেশে এভাবেই দিনের পর দিন নাগরিক অধিকারকে খুন করে চলেছেন রাজ্য ও কেন্দ্রের গণতান্ত্রিক সরকার বাহাদুর৷ আর আমরা অর্বাচিনের মতো প্রতি পাঁচ বছর অন্তর রোদে-জলে-শীতে ভিজে তাদেরকে ভোট দিয়ে ক্ষমতার শীর্ষ আসনে বসাচ্ছি৷ আমাদের সর্বনাশ আমরাই করে চলেছি৷ এতে কিছু দেখেশুনেও আমাদের কোনও শিক্ষা হয় না৷ আমাদের চেতনার নূ্যনতম উন্মেষ ঘটে না৷ ’৫২-র পর থেকে যে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি৷ সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই উপমহাদেশের গণতন্ত্র৷