• facebook
  • twitter
Saturday, 21 September, 2024

আমজনতার পাল্স ভালো বোঝেন তিনি

দেবাশিস দাস: পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী প্রচারে ২২বার এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদি৷ রোড শো করেছিলেন উত্তর কলকাতায়৷ শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোডে় নেতাজি সুভাষচন্দ্রের মূর্তিতে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে গিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের বাডি়৷ সেখানেও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিলেন বিবেকানন্দকে৷ কিন্ত্ত তার এই সব প্রচার তেমন কোন কাজে লাগলো না৷ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে যেভাবে মোদি ঝড় উঠেছে বলে দেখানো হয়েছিল , সেই মোদী

দেবাশিস দাস: পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী প্রচারে ২২বার এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদি৷ রোড শো করেছিলেন উত্তর কলকাতায়৷ শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোডে় নেতাজি সুভাষচন্দ্রের মূর্তিতে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে গিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের বাডি়৷ সেখানেও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিলেন বিবেকানন্দকে৷ কিন্ত্ত তার এই সব প্রচার তেমন কোন কাজে লাগলো না৷ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে যেভাবে মোদি ঝড় উঠেছে বলে দেখানো হয়েছিল , সেই মোদী ঝড় কে পশ্চিমবঙ্গে থামিয়ে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ শুধু তাই নয় সারা দেশের মধ্যে নির্বাচনে জয়ের রেকর্ড গড়লেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্র থেকে প্রায় ৭ লক্ষেরও বেশি ভোটে ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন তিনি৷ অভিষেকের এই জয় যে বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গে বিপর্যস্ত করে দিয়ছে সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ অভিষেকের সেনাপতিত্বে একদিকে তরুণ ব্রিগেড,অন্যদিকে পোড় খাওয়া তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে প্রবীণ ও নবীন নেতারা— সবমিলিয়ে এই সমন্বয় তৃণমূলের ভোট জেতার পক্ষে চমৎকার ফলপ্রসূ হয়েছে৷

তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে কত পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষের নাড়ির স্পন্দন যে তিনি কত ভালো বোঝেন তা আবার প্রমাণিত হলো৷ তাই বুথফেরত সমীক্ষায় যখন বিজেপি কে এগিয়ে রেখেছিল দেশজুডে় টিভি চ্যানেলগুলো, তখন ও মমতা বলেছিলেন ‘বিশ্বাস করিনা৷’ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে এত আত্মবিশ্বাস তিনি পেলেন কীভাবে?

পশ্চিমবঙ্গের ৪২ টি লোকসভা আসনের প্রায় ৭৩ শতাংশ আসন তিনি জিতে নিয়েছেন৷
যদিও এবার তার দলের বিরুদ্ধে ছিল বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ, রেশন শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী নিয়োগ, সন্দেশখালি ইত্যাদি বিষয়গুলি বিরোধীরা বারবার সামনে নিয়ে এলেও তা যে পশ্চিমবঙ্গে সাধারণ মানুষের মনে বিশেষ দাগ কাটতে পারিনি, তা তো দেখাই যাচ্ছে৷ এর কারণগুলো একটু দেখে নেওয়া যেতে পারে৷
২০১১ সাল থেকেই দেখা গেছে রাজ্যের মহিলা ভোটার বড় অংশ বরাবরই মমতার পক্ষে থেকেছেন৷ তথ্য ঘাটলে দেখা যাবে,২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে পুরুষ ভোটারদের তুলনায় বেশি সংখ্যা মহিলা ভোট দিয়েছেন৷ সংখ্যা হিসেবে সেখানে ৮১.৩৫% পুরুষ ভোট দিয়েছিলেন, মহিলা ভোটারদের শতকরা হিসাব ছিল ৮১.৭৯%৷ রাজ্য সরকারের বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্যের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষেরা যেভাবে উপকৃত হয়েছেন, তার তো একটা প্রতিফলন নির্বাচনে পড়েই৷ লক্ষীর ভান্ডার, সবুজ সাথী ,কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্য সাথীর মতো প্রকল্পগুলি যে সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়েছে এবং এতে উপকৃত হয়েছেন মহিলারা, তাতে কোন সন্দেহ নেই৷ প্রায় দু কোটি তিরিশ লক্ষ মহিলা সরাসরি এইসব প্রকল্পের আওতায় আছেন৷ তাঁরা প্রত্যেক মাসে লক্ষীর ভান্ডার থেকে এখন প্রতিমাসে এক হাজার টাকা করে পান৷ ২০২১ থেকে চালু হয়েছে এই প্রকল্প৷ এখন একটি পরিবারের যদি তিন জন ২৫ থেকে ৬০ বছরের বয়সী মহিলা থাকেন, তাহলে সেই পরিবার মাসে ৩ হাজার টাকা করে পাবে ৷ একটি গ্রামীণ পরিবারের ক্ষেত্রে এটা কম সাহায্য নয়৷ ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মহিলা ভোটারদের ৫০ শতাংশ এর বেশি ভোট পেয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস৷ এবার লোকসভা নির্বাচনেও তারা সেই ভোট অটুট রাখতে পেরেছে৷

এই নির্বাচনের ফলাফলে আরও একটি অপ্রত্যাশিত চমক রয়ে গেছে তা হল বহরমপুরের পাঁচ বারের কংগ্রেস সাংসদ এবং লোকসভার বিরোধী দলের নেতা অধীর চৌধুরীর পরাজয়৷ ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে সুপরিচিত ইউসুফ পাঠানকে বরোদা থেকে উডি়য়ে এনে বহরমপুরে তৃণমূলের প্রার্থী করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ অনেকেই মনে করেছিলেন, ভিন্ন প্রদেশের প্রার্থী অধীর গড়ে নিশ্চয়ই জিততে পারবে না৷ কিন্ত্ত ইউসুফ পাঠান যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ব্যবধানে জিতেছেন, এখানেই মমতার ক্যারিশমা৷ পাশেই মুর্শিদাবাদ আসনেও তৃণমূল প্রার্থী আবু তাহের খানের কাছে হেরে গেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহ: সেলিম৷ সিপিএমের এই হেভিওয়েট প্রার্থীর পরাজয়ে অনেককে বিস্মিত ও করেছে৷

কিন্ত্ত এবারের ভোটও যে বিজেপি হাওয়ার বিরুদ্ধেই হয়েছে, সেটা এতে প্রমাণিত হয়৷ মোদী- শাহের এনআরসি ইসু্য যে বাঙালিকে অনেকটা সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল, সে কারণেই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তারা মমতার উপরেই নির্ভর করেছেন৷

সাধারণভাবে পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের মনে হয়েছে,এই রাজ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করার জায়গায় বাম – কংগ্রেস নেই৷ সুতরাং তাদের ভোট দিয়েও লাভ নেই৷ উত্তরবঙ্গে বিজেপি শক্ত জমি গড়ে তুললেও অমিত শাহের প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের পরাজয় যে বিজেপির জন্য বড় ধাক্কা, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষের পরাজয়েও তৃণমূলের উল্লসিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে৷ এবারে নজর পড়বে অবশ্যই শুভেন্দু অধিকারীর দিকে এবং তার দায়িত্ব আরও বেডে় গেল৷ কিন্ত্ত একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠে গেল যে নির্বাচনী কৌশল ও দক্ষতা নিয়ে৷ সামগ্রিক ভাবে এই নির্বাচনে প্রার্থী ও কেন্দ্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তিনি যে ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাতে তাঁর মুখ রক্ষা হল না৷

তমলুক ও কাথি কেন্দ্র শুভেন্দুর নিজের লড়াই৷ ওই দুই কেন্দ্রের প্রার্থী যথাক্রমে প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ও শুভেন্দুর সহোদর সৌমেন্দু অধিকারীকে জেতানোর দায়িত্বও শুভেন্দুরই৷ সে দায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্ন করে তিনি হয়তো একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন৷ কিন্ত্ত সব মিলিয়ে বাংলায় বিজেপি রাজত্ব করার স্বপ্ন এখনও সুদূর পরাহত৷ বাংলার মানুষ সাম্প্রদায়িক বিভাজন চান না৷

এবারের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ৪৬% ভোট, বিজেপি ৩৮% এবং বাম কংগ্রেস মিলিতভাবে ১১%৷ সবাইকে পেছনে ফেলে এবং বুথ ফেরত সমীক্ষাকে উল্টে দিয়ে শেষ হাসি হাসছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ কারণ এবার ইন্ডিয়া জোটেও তার গুরুত্ব বেডে় গেল আরও অনেকটাই৷ আর শুভেন্দু অধিকারীকেও এক হাত নিলেন অভিষেক৷