• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

সুভাষচন্দ্রের ভাবনার বিপরীত কাজ করে চলেছে গেরুয়াশিবির

নরেন বেরা দেশের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি সাম্প্রতিক কালের প্রায় প্রতিটি সভায় মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়িয়ে বাষণ দিচ্ছেন, যা ভারতের মতো ঘোষিত সেকু্যলার রাষ্ট্রে মূল নীতির বিরোধী এবং নির্বাচনী বিধি ভঙ্গের অপরাধে দুষ্ট৷ নির্বাচন কমিশন মুক ও বধিরের চরিত্র নিয়ে নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ অবাধে চলতে দিচ্ছে৷ বিজেপি এবং আরএসএস

নরেন বেরা

দেশের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি সাম্প্রতিক কালের প্রায় প্রতিটি সভায় মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়িয়ে বাষণ দিচ্ছেন, যা ভারতের মতো ঘোষিত সেকু্যলার রাষ্ট্রে মূল নীতির বিরোধী এবং নির্বাচনী বিধি ভঙ্গের অপরাধে দুষ্ট৷ নির্বাচন কমিশন মুক ও বধিরের চরিত্র নিয়ে নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ অবাধে চলতে দিচ্ছে৷ বিজেপি এবং আরএসএস নেতারা একদিকে মুসলমান বিদ্বেষ ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কাজ করে চলেছেন, অন্যদিকে নিজেদের বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্রের আদর্শ নিয়ে চলেন বলে দাবি করেন, তখন বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্রের প্রকৃত অনুগামীদের কাছে উদ্বেগের বিষয় হয়ে ওঠে৷ বিবেকানন্দ এবং সুভাষচন্দ্র কেউই মুসলমান বিদ্বেষী তো ছিলেনই না, দুজনেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলেছেন এবং জীবনে সেই রীতি মেনে চলেছেন৷ আদর্শ ও চরিত্রের প্রশ্নে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেও এই দুই মহান মনীষী সম্পর্কে দেশবাসীর যে গভীর শ্রদ্ধা ও আবেগ আছে, তা আত্মসাৎ করতেই আরএসএস এবং বিজেপির এই হীন প্রচেষ্টা৷

প্রথমে স্মরণ করি বিবেকানন্দের কিছু কথা৷ ১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর চিকাগো ধর্মসভায় অভ্যর্থনার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘যে ধর্ম জগৎকে চিরকাল পরমত সহিষ্ণুতা ও সর্ববিধ মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়া আসিয়াছে আমি সেই ধর্মভুক্ত বলিয়া নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি৷ আমরা শুধু সকল ধর্মকেই আমরা সত্য বলিয়া বিশ্বাস করি৷ … সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি ও এগুলির ভয়াবহ ফলস্বরূপ ধর্মোন্মত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করিয়াছে, বারবার ইহাকে নরশোনিতে সিক্ত করিয়াছে, সভ্যতা ধ্বংস করিয়াছে এবং সমগ্র জাতিকে হতাশায় মগ্ন করিয়াছে৷ এই সকল ভীষণ পিশাচগুলি যদি না থাকিত, তাহা হইলে মানবসমাজ আজ পূর্বাপেক্ষা অনেক উন্নত হইত৷’ (বাণী ও রচনা, ১ম খণ্ড)

নৈনিতালের মহম্মদ সরফরাজ হোসেনকে এক চিঠিতে বিবেকানন্দ লিখেছেন, ‘আমাদের নিজেদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মরূপ এই দুই মহান মতের সমন্বয়ই—বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ একমাত্র আশা৷ … আমি মানসচক্ষে দেখিতেছি এই বিবাদ-বিশৃঙ্খলা ভেদপূর্বক ভবিষ্যৎ পূর্ণাঙ্গ ভারত বৈদান্তিক মস্তিষ্ক ও ইসলামীয় দেহ লইয়া মহামহিমায় ও অপরাজেয় শক্তিতে জাগিয়া উঠিতেছে৷’ (বাণী ও রচা, ৮ম খণ্ড) তিনি অন্য একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমার যদি একটি সন্তান থাকত তাকে মনঃসংযমের অভ্যাস এবং এবং সেই সঙ্গে এক পঙতি প্রার্থনা মন্ত্রপাঠ ছাড়া আর কোনও প্রকার ধর্মের কথা আমি শিক্ষা দিতাম না৷ … তারপর সে বড় হয়ে নানা মত এবং উপদেশ শুনতে শুনতে এমন কিছু একটা পাবে, যা তার কাছে সত্য বলে মনে হবে৷ তখন সেই সত্যের যিনি উপদেষ্টা তাঁরাই শিষ্য হবে৷ … এটা খুবই স্বাভাবিক যে, একই সময়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে এবং নির্বিরোধে আমার ছেলে বৌদ্ধ আমার স্ত্রী খ্রিস্টান এবং আমি মুসলমান হতে পারি৷’ (বাণী ও রচনা, ৩য় খণ্ড)

স্বামী অখণ্ডানন্দকে এক চিঠিতে বিবেকানন্দ লিখেছেন, ‘Orphange (অনাথাশ্রম) অতি অবশ্যই করিতে হইবে, তাহাতে আর সন্দেহ কি? … মুসলমান বালকও লইতে হইবে বৈকি এবং তাহাদের ধর্ম নষ্ট করিবে না৷ তাহাদের খাওয়া-দাওয়া অলগ্ করিয়া দিলেই হইল এবং যাহাতে তাহারা নীতিপরায়ণ, মনুষ্যত্বশালী এবং পরহিতরত হয়, এই প্রকার শিক্ষা দিবে৷’ (বাণী ও রচনা, ৮ম খণ্ড)

বিবেকানন্দ হিন্দু সন্ন্যাসী ছিলেন৷ তিনি মুসলমান বিদ্বেষী তো ছিলেনই না, বরং একই পরিবারে বিভিন্ন ধর্মের সহঅবস্থানের পক্ষপাতী ছিলেন৷ ধর্মোন্মাদদের বিবেকানন্দ পিশাচ বলেছিলেন, যারা পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করে রেখেছে৷ আজকের হিন্দুত্বের ফেরিওয়ালা মুসলমান বিদ্বেষের জিগির ছড়াচ্ছে ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নোংরা খেলায় মেতেছে৷ বিবেকানন্দের চিন্তা ও চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীতে এদের অবস্থান৷ এদের মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দুত্বের প্রচারের মহিমায় সাম্প্রদায়িকতামুক্ত উদার হিন্দু সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ সম্পর্কে জনমানসে বিকৃত ধারণাই গড়ে ওঠার আশঙ্কাই থেকে যায়৷

আরএসএস প্রধান মোহন ভগবত এবছর জানুয়ারি মাসে এক আলোচনায় বলেছিলেন, সুভাষচন্দ্রের ভাবনাতেই সঙ্ঘ চলছে, এও বলেছিলেন, সুভাষচন্দ্রের চিন্তাধারার সাথে সঙ্ঘের চিন্তাধারার কোনও পার্থক্য নেই৷ ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর নেতাজির মূর্তির আবরণ উম্মোচনে নরেন্দ্র মোদি নিজেকে সুভাষচন্দ্রের অনুগামী বলে দাবি করেছিলেন৷ যারা সুভাষচন্দ্রের চিন্তাধারা ও সংগ্রামী চরিত্রের সাথে পরিচিত তাঁরা অতি সহজেই বুঝবেন যে, এদের এই দাবি অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক এবং এই মহান মনীষীর চরিত্রহননের এক ঘৃণ্য কৌশলমাত্র৷ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরো সময়েই আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভা স্বাধীনতা সংগ্রামের বাইরেই ছিল৷ তারা ভারত ছাড় আন্দোলনের বিরোধিতা ও সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের সাহায্য করেছে৷ স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে সুভাষচন্দ্র মুসলিম লিগ ও হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন৷ সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মিলবে এমনই তাঁর কিছু বক্তব্য এখানে তুলে ধরা যাক৷

সুভাষচন্দ্র বলেছেন, ‘ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে রাজনীতি হইতে বাদ দেওয়া উচিত৷ ধর্ম ব্যক্তি বিশেষের বিষয় হওয়া উচিত৷ ব্যক্তি হিসেবে মানুষ যে ধর্ম পছন্দ করে, তাহা অনুসরণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকিবে, কিন্ত্ত ধর্মীয় কিংবা অতীন্দ্রিয় বিষয়ের দ্বারা রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত নহে৷ ইহা পরিচালিত হওয়া উচিত শুধু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক বিচারবুদ্ধির দ্বারা৷’ (সুভাষ রচনাবলী ৫ম খণ্ড)
‘হিন্দু মুসলমানের স্বার্থ পরস্পরের পরিপন্থী, একথা যারা বলেন, তাঁরা খাঁটি কথা বলেন না৷ খাদ্যাভাব, বেকারত্ব, জাতীয় শিল্পের অবক্ষয়, মৃতু্যর হার বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যহীনতা, শিক্ষার অভাব এগুলিই মূল সমস্যা৷ এই সকল বিষয়ে হিন্দু-মুসলমানের স্বার্থ অভিন্ন৷’ (সুভাষ রচনাবলী ৪র্থ খণ্ড)

‘‘হিন্দুরা ভারতে সংখ্যা গরিষ্ঠ সম্প্রদায় বলিয়া ‘হিন্দুরাষ্ট্র’-এর ধ্বনি শোনা যায়৷ এগুলির সর্বৈব অলস চিন্তা৷ দারিদ্র্যপীড়িত শ্রমজীবী জনসাধারণের কৃষক ও শ্রমিকের স্বরাজ সর্বাধিক প্রয়োজন৷’’ (সুভাষ রচনাবলী ৪র্থ খণ্ড)

‘‘হিন্দু মুসলমান সমস্যা বাংলার প্রধান সমস্যা৷ … বাধাবিঘ্ন যতই বড় হউক না কেন এই সমস্যা আজ সমাধানের পথে চলিয়াছে৷ … প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিরা হিন্দু মহাসভার নামে রাজনীতিতে প্রবেশ করিয়া উহাকে কলুষিত করিয়াছেন৷ … সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদিগকে ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোট ভিক্ষায় পাঠাইয়াছেন৷ ত্রিশূল ও গৈরিক বসন দেখিলে হিন্দু মাত্রেই শির নত করে ধর্মের সুযোগ নিয়া, ধর্মকে কলুষিত করিয়া হিন্দু মহাসভা রাজনীতি ক্ষেত্রে দেখা দিয়াছে, হিন্দুমাত্রেরই তাহার নিন্দা করা কর্তব্য.’ (১২ মে, ঝাড়গ্রামে ভাষণ, আনন্দবাজার পত্রিকা ১৪ মে, ১৯৪০)

সুভাষচন্দ্রের এই চিন্তাধারার ঠিক বিপরীত কতা বা কাজ আরএসএস এবং বিজেপি বলছে বা করছে৷ তারা যদি নিজেদের সুভাষচন্দ্রের অনুগামী বলে দাবি করে প্রচার চালায় তবে তাদের প্রচারের ঢক্কানিনাদে এবং অপকর্মের আবর্জনায় সুভাষচন্দ্রের মহান আদর্শ এবং মহৎ চরিত্র লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যাবে৷ শাসক দলগুলোর সৃষ্ট হাজার প্রতিবন্ধকতা সত্বেও রেনেশাঁ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের মহৎ চরিত্রগুলোর প্রভাবে সমাজে আজও যতটুকু বিবেক মনুষ্যত্ব টিকে আছে সেটুকুও বিলীন হয়ে যাবে৷ বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্রের প্রকৃত অনুরাগীরা তা হতে দেবেন, নাকি প্রতিরোধে এগিয়ে আসবেন—তা তাঁদেরই ঠিক করতে হবে৷