সব দলের প্রেস্টিজ ইসু্য কোচবিহার কেন্দ্রে নির্লিপ্ত নির্বাচকরা
সুভাষ মন্ডল, কোচবিহার: নির্লিপ্ত নির্বাচকরা, সরব রাজনীতিকরা৷ ঠিক এমনই পরিস্থিতিতে ভোট হচ্ছে কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রে৷ সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত কোচবিহার লোকসভা কেন্দ্রের পাখির চোখ দিনহাটা৷ রাজনীতির আঁতুর ঘর৷ এই দিনহাটা বিধানসভা কেন্দ্র থেকেই ২০২১ সালের উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী বর্তমান উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহ ১ লক্ষ ৬৪ হাজারের বেশি ভোটে জয়ী হয়েছিলেন৷ তৃণমূল কংগ্রেস দল বিশেষ করে উদয়ন গুহর মাথা ব্যথার কারণও সম্ভবত এটাই৷ ঠিক তার আগে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে ৫৭ ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন উদয়ন গুহ৷ নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক৷ বিধানসভার সদস্য পদ থেকে নিশীথের পদত্যাগে ফের ভোট হয় এই দিনহাটায়৷ হারের বদলা নিতে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমে পডে়ন বর্তমানের বিধায়ক উদয়ন গুহ৷ সমস্তরকম রাজনৈতিক কৌশলকে কাজে লাগিয়ে উদয়ন গুহ জয়ী হন ওই বিরাট ব্যবধানে৷ তার রেকর্ড ভোট প্রাপ্তির ফলস্বরপ কমল পুত্র উদয়ন গুহর ঝুলিতে আসে সেই কাঙ্খিত পদ৷ মন্ত্রিত্বপ্রাপ্তি ঘটে৷ তিনি এখন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী৷ পিতা কমল গুহ ছিলেন বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘদিনের মন্ত্রী৷ দাপুটে, অভিজ্ঞ ও পোড়খাওয়া এই রাজনীতিকের সুযোগ্য সন্তান উদয়ন গুহ ফরওয়ার্ড ব্লক ছেডে় ২০১৬ সালে যোগদান করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস দলে৷ নতুন দলে যোগদানের পর তার সামনে ২০১৯ সালে লোকসভার ভোট হাজির হয়৷ সেই ভোটে ক্যাপ্টেন উদয়ন গুহ দিনহাটা শহরে বিজেপির কাছে ভোটের ব্যবধানে পরাস্ত হন৷ বছরখানেক যেতেই দিনহাটা শহরে পৌরভোট হয়৷ পৌরসভার এই ভোটেও দিনহাটার মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেন উদয়ন গুহ থেকে৷ বারবার এমন ঘটার পিছনে কি কারন তা খুঁজতে ময়নাতদন্ত চলে দলের ভিতর এবং এবং উদয়ন গুহ নিজেও কাটাছেঁড়া করেন বিষয়টি৷ তার হাত দিয়ে এত উন্নয়ন যে শহরে সেই শহর কেন বারবার তাকে বঞ্চিত করছে৷ অথচ ২০১৫ সালে তৃণমূলের রমরমা বাজারেও উদয়ন বাবু ফরওয়ার্ড ব্লক দলের নেতা হিসাবে দলকে সম্মানজনক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন৷ সেদিন প্রয়াত ও পিতা কমল গুহুর মতো তার প্রতিবাদী লড়াইকে সম্মান জানিয়ে দিনহাটার মানুষ দু’হাত ভরে ভোটও দিয়েছিলেন পৌরসভা নির্বাচনে ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থীদের৷ কিন্ত্ত তারপর এমনকি ঘটলো৷ দিনহাটার মানুষ তার রাজনৈতিক নতুন চরিত্রকে অন্যভাবে দেখতে শুরু করলো৷ নির্বাচনী পরীক্ষায় পরপর ব্যর্থ হয়েও দিনহাটার মানুষের উপর ভরসা করে নতুন উদ্যমে লড়াইয়ের ময়দানে আসীন হন৷ জয় আসে ২০২১ সালের উপ নির্বাচনে৷ পরিশ্রমের ফসল ঘরে তোলেন উদয়ন গুহ৷ মন্ত্রী হন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দপ্তরের৷ তারপর থেকে তিনি আর পিছন ফিরে তাকাতে চান না৷ তাই এই লোকসভা নির্বাচনে দিনহাটার মাটি কামডে় পডে় রয়েছেন এক সময়ের বামপন্থী নেতা উদয়ন গুহ৷ বাবার হাত ধরে তিনি শিখেছেন রাজনীতির এ বি সি৷ সেই অভিজ্ঞতাই প্রয়োগ করে তিনি আজ একজন সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বলে মনে করেন রাজনৈতিক মহল৷ তবে প্রশ্ন উঠছে, উপ নির্বাচনে যিনি রেকর্ড ভোটে জয়ী হন এবং উন্নয়নের কারিগর তাকে লোকসভার ভোটে দলীয় প্রার্থীর জয় নিয়ে কেন এত মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হচ্ছে৷ পৌরসভা কিংবা পঞ্চায়েত ভোটের মতোই বাডি় বাডি় নানা কৌশলে প্রচার চলছে দলের হয়ে৷ দিনহাটার নির্বাচকরা এ নিয়ে অবশ্য কোনো মুখই খুলছেন না৷ শাসক শিবির বারে বারে মানুষের মনের ভিতর ঢোকার চেষ্টা করলেও এখানকার গণদেবতারা এখনো নির্লিপ্ত৷ মিটিং মিছিলে জন সমাগম তৃণমূল কংগ্রেস শিবিরকে আশ্বস্ত করার পক্ষে যথেষ্ট৷ তথাপি একটি জিজ্ঞাসা চিহ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দলের অন্দরে৷ তাই সর্বস্তরের কর্মীকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে ভোটারদের মন জয় করতে৷ দিনহাটা বিধানসভার মতো সিতাই বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস সাংগঠনিক শক্তি যথেষ্ট মজবুত৷ এখানেও একসময়ের বামপন্থী নেতা জগদীশ রায় বর্মা বসুনিয়া তৃণমূল কংগ্রেস দলের লোকসভার প্রার্থী৷ একজন মাস্টারমশাই হিসেবে তার স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কথা তৃণমূল কংগ্রেস তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সভা সমাবেশে৷ অপরদিকে, মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি প্রার্থী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক আলিপুরদুয়ারে সোনার দোকানে ডাকাতির সাথে যুক্ত বলে অভিযোগ তুলে নিজেদের পালে হাওয়া টানার চেষ্টা করছেন৷ প্রেস্টিজ ফাইট কেন্দ্র কোচবিহারে এবার লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী জগদীশ বর্মা বসুনিয়াকে জয়ী করার লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা দলের সুপ্রিম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃণমূল কংগ্রেস দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঘাটালের সাংসদ অভিনেতা দীপক অধিকারী (দেব) জেলার নানাপ্রান্তে একাধিক সভা ও রোড শো করেছেন৷ প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রচুর জনসমাগম ঘটে৷ বরাবরই ক্রাউড পুলার হিসাবে পরিচিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ কম যান না দলের প্রভাবশালী নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও৷ তাঁর মিটিং-মিছিলে প্রচুর সংখ্যক মানুষের জমায়েত চোখে পডে়৷ লক্ষ্মীর ভান্ডারের মত জনহিতকর ইসু্যসহ নাগরিকত্ব আইনকে সামনে রেখে তৃণমূল নেতা নেত্রীরা সাধারণ ভোটারদের বোঝানোর চেষ্টা করেন৷ বিধানসভার ভোট না হলেও তারা জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন এটা কোনও অংশেই তাদের সরকারি সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে লোকসভার ভোটের গুরুত্ব কম নয়৷ সীমান্তবর্তী জেলা কোচবিহার সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে সংখ্যালঘু ভোটের কথা মাথায় রেখে তৃণমূল কংগ্রেস দল তাদের ঘুঁটি সাজিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন৷
প্রচারে পিছিয়ে নেই রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপিও৷ দলীয় প্রার্থী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের সমর্থনে জেলার বিভিন্ন স্থানে একটানা প্রচার পর্ব চলে৷ তাকে জেতানোর লক্ষ্য নিয়ে দিল্লি থেকে ছুটে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ প্রধানমন্ত্রী বিনামূল্যে আরো পাঁচ বছরের জন্য দেশের ৮২ কোটি মানুষকে রেশন, মহিলাদের জন্য উজ্জ্বলা গ্যাস, লাখপতি দিদি কিংবা আয়ুষ্মান ভারতসহ নিউ জলপাইগুডি়কে কেন্দ্র করে এতদাঞ্চলে রেলের প্রভূত উন্নয়নের কথা তুলে ধরেন বক্তব্যে৷ কোচবিহারে বিজেপির ভোট প্রচারে অংশ নিয়েছেন দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীও৷ তিনি আলিপুরদুয়ার ছাড়াও কোচবিহারের একাধিক স্থানে রোড শো ও মিটিং করেন৷ তৃণমূল কংগ্রেসের ১০০ দিনের কাজের টাকা আটকে রাখার অভিযোগের পাল্টা হিসাবে বিজেপি দলের পক্ষ থেকে বলা হয় রাজ্য সরকার টাকার হিসেব দেননি৷ অথচ ১০০ দিনের টাকা কেন্দ্রীয় সরকার আটকে রেখেছে বলে মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে৷ অনুরূপভাবে, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকাও কেন্দ্রীয় সরকার দিচ্ছে না বলে তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগের প্রতু্যত্তরে বিজেপি নেতৃত্ব বলেন, ওরা বাডি় তৈরির টাকার হিসাব দেননি৷ যে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল তাও তৃণমূল নেতারা চুরি করেছে বলে অভিযোগ আনেন৷
যুযুধান তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি ছাড়াও এবার লোকসভা ভোটে কোচবিহার কেন্দ্রে লড়াইয়ের আসরে অবতীর্ণ হয়েছেন আরো বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল৷ এর মধ্যে রয়েছেন জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থী পিয়া রায় চৌধুরী, বামফ্রন্ট প্রার্থী ফরওয়ার্ড ব্লকের নীতিশ চন্দ্র রায়, এসইউসিআই দলের দিলীপ চন্দ্র বর্মন, বহুজন সমাজ পার্টির পূর্ব মোহন রায়, কামতাপুর পিপলস্ পার্টির প্রদীপ কুমার রায় প্রমূখ৷ এইসব রাজনীতির দলগুলি নিজেদের সাধ্যমত জেলা জুডে় মিটিং মিছিল খুলি বৈঠক করে প্রচার চালায়৷ তারাও মানুষের কাছে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি দলের জনবিরোধী বিভিন্ন নীতির কথা তুলে ধরে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করেন৷ জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে প্রার্থী পিয়া রায় চৌধুরী ছাড়াও কমল দাশগুপ্ত, আইনজীবী হরিহর রায় সিংহ, প্রাক্তন মন্ত্রী ড. মোঃ ফজলুল হকের ছেলে আজিজুল হক প্রমুখ প্রচারে অংশ নেন৷ ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী নিতীশ চন্দ্র রায়ের পক্ষে বিভিন্ন মিছিল, মিটিংয়ে বক্তব্য রাখেন সিপিএমের জেলা সম্পাদক অনন্ত রায়, ফরওয়ার্ড ব্লক দলের প্রাক্তন সাংসদ নৃপেন রায়, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা আব্দুর রউফ, বিকাশ মণ্ডল, আজগর আলী ব্যাপারী, সিপিএম নেতা প্রবীর পাল, শুভ্রালোক দাস প্রমূখ৷ রাজনীতির এই দলগুলির পাশাপাশি নির্দল হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মোট ছয় জন প্রার্থী৷ কোচবিহার লোকসভা অন্যতম আরেকটি কেন্দ্রের নাম মাথাভাঙ্গা৷ এখানে রাজ্যের দুই প্রাক্তন মন্ত্রীর বসবাস৷ একজন হলেন হিতেন বর্মন এবং অপরজন বিনয় কৃষ্ণ বর্মন৷
২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে কোচবিহার আসন থেকে বিজেপি দলের প্রার্থী নিশীথ প্রামাণিক জয়ী হন৷ তিনি তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেস দলের প্রার্থী পরেশ চন্দ্র অধিকারীকে ৫৪ হাজার ২৩১ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন৷ কেন্দ্রে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দিনহাটার ভেটাগুডি়র বিজেপি দলের তরুণ তুর্কি নিশীথ প্রামাণিককে দেশের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী করা হয়৷ সেই সময় দিনহাটাসহ গোটা কোচবিহারের একশ্রেণীর মানুষ যথেষ্ট উচ্ছ্বসিত হয় বটে৷ কিন্ত্ত বিগত পাঁচ বছরে মানুষের সেই উচ্ছ্বাসে অনেকটাই ভাটা পডে়ছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক মহল৷ নিশীথ প্রামাণিকও ছাড়ার পাত্র নন৷ তিনিও বিজেপি দলের কোচবিহার জেলা সভাপতি সুকুমার রায়, বিরাজ বসু, বিধায়ক মিহির গোস্বামী, অজয় রায় প্রমুখকে নিয়ে গোটা তৃণমূল দলের সাথে এবং বিশেষ করে পোড়খাওয়া রাজনীতিক উদয়ন গুহ, রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, অভিজিৎ দে ভৌমিকদের সাথে সমান তালে লডে় যাচ্ছেন৷ একাধিক ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর সঙ্গে নিশীথ প্রামাণিকের টানাপোড়েন দিনহাটা ও গোটা জেলার রাজনীতিকে উত্তপ্ত করে তোলে৷ জনমানষে এর প্রভাবও পড়ে যথেষ্ট৷