সংরক্ষণ আর হিন্দুত্বের খেলায় মোদি, কিন্ত্ত শেষ হাসি হাসতে পারবেন তো?

পুলক মিত্র

আমাদের প্রধানমন্ত্রী কি টেনশনে রয়েছেন? ভোটপর্ব শেষের দিকে যত এগোচ্ছে, নরেন্দ্র মোদিকে ততই বেশি নার্ভাস দেখাচ্ছে৷ তবে কি তিনি অন্য কোনও ইঙ্গিত পাচ্ছেন? ৪০০ আসনে জেতার হুঙ্কার দিয়ে যেভাবে উচ্চস্বরে প্রচার শুরু করেছিলেন, তা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে৷ তাই আর কোনও ঢাক ঢাক গুড় গুড় নয়, এবার একেবারে সরাসরি মেরুকরণের খেলায় নেমে পড়েছেন৷

সাত দফার ভোটের শেষ পর্ব ক্রমশ এগিয়ে আসছে৷ আর আমরা দেখছি, প্রধানমন্ত্রীর মরিয়া প্রচার৷ তিনি যেভাবে মরুকরণের খেলা শুরু করেছেন, তা স্বাধীন ভারতে কখনও যায়নি৷ মুসলিমদের সংরক্ষণ দেওয়া নিয়ে সরাসরি নিশানা করছেন সংখ্যালঘুদের৷ রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গ, যেখানেই তিনি সভা করছেন, সেখানে জোর গলায় বলছেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলেই তফশিলি জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য বরাদ্দ সংরক্ষণ সব মুসলিমদের দিয়ে দেবে! সেইসঙ্গে নজির হিসেবে টেনে আনছেন কর্নাটকের প্রসঙ্গ৷ এতেই থামেননি মোদি৷ তিনি আরও বলছেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলেই, দেশের সব সম্পদ মুসলিমদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে দেবে৷


সম্প্রতি বাংলায় লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এসে ব্যারাকপুরে বিজেপি প্রার্থী অর্জুন সিংয়ের সমর্থনে এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে মোদি বলেছেন, “ইন্ডিয়া জোট এলে তফসিলি জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ তুলে দেবে৷ ওরা বলছে পুরো সংরক্ষণ এবার মুসলমানদের দেওয়া হোক৷ আপনারা এটা মেনে নেবেন? দেশের দলিত, আদিবাসী, অনগ্রসর শ্রেণি এই অন্যায় সহ্য করবে?” এর আগে, ২৩ এপ্রিল রাজস্থানের সওয়াই-মাধোপুরে এক সভায় কর্নাটকে কংগ্রেসের মুসলিমদের সংরক্ষণ দেওয়া নিয়ে একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন মোদি৷

যাঁরা একটু আধটু খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা আদার ব্যাকওয়ার্ড কাস্টের মধ্যে মুসলিমদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই দেশের বিভিন্ন রাজ্যে চালু রয়েছে৷ এর ব্যতিক্রম নয় পশ্চিমবঙ্গও৷

তবে কর্নাটকে মুসলিমদের সংরক্ষণের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে৷ কিন্ত্ত মিথ্যাচারের রাজনীতিতে বিশ্বাসী মোদি বিভ্রান্তি তৈরি করছেন৷ দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি৷ উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই মহীশূর রাজ্যে সংরক্ষণের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু হয়৷

সরকারি চাকরি তো বটেই, বিভিন্ন উচ্চপদেও ব্রাহ্মণদের একাধিপত্য থাকায়, তা দূর করতে প্রথম সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিল তখনকার মহীশূর রাজ্য৷ ১৮৭২ সালে বড়লাট লর্ড মেয়োর আমলে ভারতে প্রথম জাতীয় জনগণনার উদ্যোগ নেওয়া হয়৷ প্রথমদিকে শুধুমাত্র পুলিশের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ রাখা হয়৷ তখন অব্রাহ্মণ হিন্দু এবং মুসলিমদেরও একটা বড় অংশ পিছিয়ে থাকার কারণে, মহীশূরে মুসলিমদেরও সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হয়৷ বলতে গেলে, ভারতে ওটাই ছিল প্রথম সংরক্ষণ৷

স্বাধীনতার পরে কর্নাটক রাজ্য তৈরি হলে, সেখানে মুসলিমদের সংরক্ষণ বহাল রাখা হয়৷ কিন্ত্ত তা নিয়ে মামলা শুরু হয়৷ মামলাকারীদের বক্তব্য ছিল, সংবিধানে শুধুমাত্র জাতিগতভাবে অনগ্রসর হিন্দুদের জন্য অর্থাৎ তফশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য সংরক্ষণ স্বীকৃত৷ সেই সংরক্ষণের সুবিধা মুসলিমদের কেন দেওয়া হবে? কিন্ত্ত আদালতের রায়ে অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে মুসলিমদের সংরক্ষণের বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়৷

১৯৭৫ সালে এল জি হাভানুরের নেতৃত্বাধীন  কর্নাটকের রাজ্য অনগ্রসর শ্রেণি কমিশন মুসলিমদের জন্য সংরক্ষণকে যথার্থ আখ্যা দেয়৷ কমিশনের ঘোষণাকে মান্যতা দিয়ে ১৯৭৭ সালে কর্নাটকের দেবরাজ আর্স-এর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার এই সংরক্ষণ চালু করে৷ কর্নাটক হাইকোর্টে এ নিয়ে মামলা হলেও, আদালত সংরক্ষণকে বৈধ ও আইনসম্মত বলে স্বীকৃতি দেয়৷

এরপর মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্টে৷ ১৯৮৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট নতুন কমিশন গঠনের পক্ষে রায় ঘোষণা করে৷ সেই অনুযায়ী, ১৯৮৪ সালে তৈরি হয় বেঙ্কটস্বামী কমিশন৷ এই কমিশনও মুসলিমদের সংরক্ষণের পক্ষে মত দেয়৷ কিন্ত্ত লিঙ্গায়ত ও ভোক্কালিগাদের মতো কিছু জনজাতিকে বাদ দেওয়ার অভিযোগ তুলে কমিশনের রিপোর্ট বাতিল করে দেয় কর্নাটকের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী রামকৃষ্ণ হেগড়ের নেতৃত্বাধীন জনতা পার্টি সরকার৷

এই জটিলতা দূর করতে নতুন করে তৈরি হয় চিন্নাপ্পা রেড্ডি কমিশন৷ এই কমিশনও মুসলিমদের সংরক্ষণের পক্ষে মত দেয়৷ সেসময় কর্নাটকে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস সরকার৷ আর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বীরাপ্পা মইলি৷ তিনি শেষ পর্যন্ত মুসলিম, বৌদ্ধ এবং দলিত খ্রিস্টানদের ক্যাটেগরি-২ ধরে ৬ শতাংশ সংরক্ষণ প্রস্তাব দেন৷
অন্যদিকে, মণ্ডল কমিশন মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয় যে, মোট সংরক্ষণ ৫০ শতাংশের বেশি করা যাবে না৷ পরবর্তীকালে এইচ ডি দেবগৌড়ার জনতা দল যখন কর্নাটকে ক্ষমতায় আসে, শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য ক্যাটেগরি ২বি তৈরি করে ৪ শতাংশ সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়, যা আজও বহাল রয়েছে৷

এখানে একটা জিনিস স্পষ্ট, তা হল ‘তফশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য বরাদ্দ সংরক্ষণ মুসলিমদের দিয়ে দেওয়া’-র যে অভিযোগ মোদি করে চলেছেন, তা সর্বৈব মিথ্যা৷ বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক হলেও, কর্নাটকে মুসলিমদের সংরক্ষণের বিষয়টি পরিপূর্ণ রূপ পায় এইচ ডি দেবগৌড়ার আমলেই, যিনি এখন বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন৷ এ প্রসঙ্গে কর্নাটকের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলেছেন, “দেবগৌড়া একসময় শুধুমাত্র মুসলিমদের সংরক্ষণ দেওয়া নিয়ে গর্ব করতেন৷ এখনও কি তিনি সেই জায়গাতেই অনড় রয়েছেন? নাকি মোদীর কাছে আত্মসমর্পণ করে নিজের অবস্থানও বদলে ফেলবেন?”
গত বছর বিধানসভা নির্বাচনের আগে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাই মুসলিমদের ২বি ক্যাটেগরি থেকে সরিয়ে তাদের ১০ শতাংশ আর্থিকভাবে অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে রাখতে চেয়েছিলেন৷ কিন্ত্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তা বাতিল হয়ে যায়৷

আসলে যেভাবে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী মিথ্যাচার করে চলেছেন, হিটলারের প্রধানমন্ত্রী গোয়েবলস বেঁচে থাকলে তাতে লজ্জা পেতেন৷ গোয়েবলস মনে করতেন, একটা মিথ্যা বারবার বললে, মানুষ একসময় তা সত্যি বলে বিশ্বাস করতে শুরু করবেন৷ অতীতেও মোদি নানা মিথ্যাচার করেছেন৷ কিন্ত্ত এতটা কদর্য ভাষায় কখনও মুসলিমদের আক্রমণ করতে দেখিনি৷

বাংলায় নির্বাচনী প্রচারে এসে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিভাজনের নানা কৌশল প্রয়োগ করছেন মোদি৷ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলায় হিন্দুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হয়েছে৷ বিরোধীরা ক্ষমতায় এলে, তফশিলি জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ তুলে দেওয়া হবে৷ মোদির কথায়, “ওরা চায় মুসলমানদের জন্য পুরোপুরি সংরক্ষণ৷”

উপস্থিত জনতার উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, “আপনারা কি এটা মেনে নেবেন? দেশের দলিত, আদিবাসী, অনগ্রসর শ্রেণি এই অন্যায় সহ্য করবে?”

আসলে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রতিটি সভাতেই মোদী সুকৌশলে ভারতে বহুচর্চিত সেই হিন্দুত্বের তাস খেলে চলেছেন৷ শুধু মোদি নন, পিছিয়ে নেই তাঁর দলের অন্য নেতা মন্ত্রীরাও৷ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলছেন, “বিরোধীরা সরকারে এলে, অযোধ্যার রাম মন্দিরে বাবরি নামের তালা ঝুলিয়ে দেবে৷”
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাও বাংলায় প্রচারে এসে বলেছেন, “ভারত তৈরি করেছে হিন্দুরাই৷ তাই এদেশে থাকতে হলে, হিন্দু হয়েই থাকতে হবে৷” উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন, “কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে, মুসলিমদের জন্য গরুর মাংস খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে৷ অর্থাৎ গো-মাতাকে আবার হত্যা করা হবে৷”

প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি নেতারা যে বার্তা দিতে ছড়িয়ে দিতে চাইছেন, তা হল, একমাত্র বিজেপি-ই হিন্দুদের কল্যাণ করতে পারে৷ আর কংগ্রেস তথা বিরোধীরা, শুধুমাত্র মুসলিমদেরই ভালো চায়৷ বাস্তব হল, কংগ্রেস বা বিরোধী নেতারা কখনই হিন্দু স্বার্থবিরোধী কোনও কথা বলেননি৷ কিন্ত্ত মোদি তথা তাঁর অনুগতরা দেশের ৮০ শতাংশের বেশি হিন্দুর মনে এটা গেঁথে দিতে চাইছেন যে, বিরোধীরা শুধুমাত্র মুসলিমদের স্বার্থরক্ষাই করবে৷ অর্থাৎ খুল্লমখুল্লাভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর খেলায় নেমেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী৷ অঙ্কটা খুব পরিষ্কার৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোট পকেটস্থ করতে পারলে, ক্ষমতায় আসার পথ মসৃণ হবে৷

প্রাক্ নির্বাচনী সমীক্ষায় মোদির দল এগিয়ে থাকলেও, তাতে নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা৷ তাই ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের সেই পুরনো খেলা শুরু করেছেন৷
মোদি ভেবেছিলেন, অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধন তাঁর তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করবে৷ কিন্ত্ত রামমন্দিরের ঢেউ এখন স্তিমিত হয়ে এসেছে৷ তাই ৪ জুন কী ঘটবে, তা নিয়ে নিশ্চিত হতে না পেরেই হিন্দুত্বের ওপর ভরসা করতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী৷