কমলেন্দু ধর
ভারতের একদা কমপ্যাশনেট গণতন্ত্র বর্তমানে মাসকুলার গণতন্ত্রে পরিণত হয়েছে৷ অর্থাৎ স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে শাসকদের দেশবাসীর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন গণতন্ত্র থেকে আজ দেশবাসী অপরিশীলিত আগ্রাসী ও প্রচারজীবী গণতন্ত্রের মুখোমুখি৷ এই অপরিশীলিত আগ্রাসী ও প্রচারনির্ভর গণতন্ত্র ভারতে প্রসারিত হয় রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রয়োজনে নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক বাণিজ্য-চক্রে, যাকে আমরা ‘পলিটিক্যাল বিজনেস সাইকেল’ বলে চিহ্নিত করতে পারি৷ বিষয়টি বিস্তৃত আলোচনা সাপেক্ষ, বিশেষ করে তার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় কাঠামোর নানা রূপান্তর সহ একাধিক স্তরবিন্যাসে বিন্যস্ত৷ এখানে সংক্ষিপ্ত উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি স্পষ্ট করে নেওয়া যাক৷
উদাহরণ, পুঁজির বিনিয়োগ একান্তই মুনাফাকেন্দ্রিক৷ তাই বৃহৎ পুঁজি নিয়ন্ত্রিত শিল্প-বাণিজ্য গোষ্ঠী থেকে ছোট-বড়-মাঝারি পুঁজির উদ্যোগীদের রাজনৈতিক দানকে অর্থ ‘দান’ বা নির্বাচনকেন্দ্রিক ‘দান’কে শিল্পবাণিজ্য উদ্যোগীদের বিনিয়োগ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, মুক্তিপরম্পারে৷ কারণ, বর্তমান কালে শিল্প-বাণিজ্য উদ্যোগীদের বিনিয়োগের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য মুনাফা, অকসঙ্গে মুনাফা করা৷ এছাড়া তাদের অর্থ ‘দান’-এর পরিসরে অন্য কোনও আদর্শ-নীতি-নৈতিকতা কাজ করে কি? মুনাফা ছাড়া? যা রাজনৈতিক বামিজ্য চক্রে পরিণত হয়৷ সাম্প্রতিক সময়ে তার বলিষ্ঠ উদাহরণ হল ‘নির্বাচনী বন্ড’ নামক রাজনৈতিক চক্র৷
আর সহানুভূতিসম্পন্ন গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি শাসকের মানবিকতা ও দেশবাসীর প্রতি মানবিক কল্যাণকর্ম৷ বিপরীতে কোনও শাসক বা রাজনৈতিক দলের অন্তিম আদর্শ যদি শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের স্তরে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে সহানুভূতিসম্পন্ন গণতন্ত্রের বিপন্নতা বাড়ে এবং গণতন্ত্রের নাভিশ্বাস ওঠে৷ এই গণতন্ত্রে শাসক বিরোধী শক্তির কণ্ঠরুদ্ধ হয় এবং ভারতের গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ সংবিধান অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে৷ এবং গণতন্ত্রের অপর দুই স্তম্ভ আইন-আদালতের সুশাসন ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাও বিপন্ন হয়ে পড়ে৷
সামান্য উদাহরণ, ২০২২-এ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী জেলে বন্দিদের সংখ্যা ৫,৫৪,০৩৪ জন৷ যার মধ্যে ৪,২৭,১৬৫ জন (শতাংশের হিসাবে ৭৬ শতাংশ) বিচারাধীন বন্দি৷ তার সঙ্গে ইউএপিএ (বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন) প্রয়োগ করে যাদের গ্রেফতার ও বন্দি করা হয়েছিল, তাঁদের নামগুলি জুড়ে নিয়ে বিষয়টি কোথায় পৌঁছবে‘ আর ২০২৩-এ ‘রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারর্স সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাসূচক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৬১-তে৷ ২০১৪ সালে তা ছিল ১৪০ এবং ২০০৪ সালে ছিল ১২০৷
পরিণতিতে ভারতের পরিশালীত গণতন্ত্রের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ছিন্নভিন্ন করে রক্তাক্ত হয় ২০১৪ ভারতের ষষ্ঠদশ লোকসভার নির্বাচনের আগে পর্যন্ত ভরাট রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কেন্দ্রীয় স্তরে এই অপরিশীলিত গণতন্ত্র ও মিথ্যা প্রতিশ্রুতির এক পর্ব শেষ হয়েছিল৷ তার নতুন পর্বের সূচনা হয় ২০ মে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ও পরে যে ‘মিথ্যা প্রতিশ্রুতি’গুলি দিয়েছিলেন তা ২০২৪ সালের অষ্টাদশ লোকসভার নির্বাচনের আগে ‘মোদি গ্যারান্টি’ নামে প্রচারিত হয়ে চলেছে, বিপুল প্রচার তরঙ্গে প্রচারজীবীর ছবি দিয়ে৷
নরেন্দ্র মোদির ‘মিথ্যা প্রতিশ্রুতি’গুলি ক্রমান্বয়ে তুলে ধরলে তার নির্মাণ হলে ‘অচ্ছে দিন’ থেকে ‘অমৃতকাল’ হয়ে ‘বিকশিত ভারত’-এর অপরিশীলিত বা মাসকুলার গণতন্ত্রের নমুনা৷ নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে তাঁর প্রতিশ্রুতিগুলি সংক্ষেপে তুলে ধরা যাক৷
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩ থেকে ৩০ এপ্রিল ২০২৪ সালে ষষ্ঠদশ লোকসভার লোকসভার নির্বাচনের আগে দেশবাসীর কাছে নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতি ছিল— (১) ভারত দুর্নীতিমুক্ত দেশ হবে৷ (২) বিদেশ থেকে কালো টাকা উদ্ধার করে প্রত্যেক দেশবাসীর অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ করে টাকা তিনি অর্থাৎ সরকার জমা করে দেবেন৷ (৩) প্রতিবছর ২ কোটি দেশবাসীর নতুন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হবে৷ (৪) কৃষিক্ষেত্রে ২০০৬ সালের এম এস স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ তিনি বাস্তবায়িত করবেন৷ (৫) ভারতীয় টাকার তুল্যমানে আমেরিকান ডলার-এর দাম ৪০ টাকায় নামিয়ে আনা হবে৷ ইত্যাতি… প্রভৃতি৷
২০১৪ সালের ২০ মে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ২০২৪ সালের প্রথম তিনটি ধাপ অতিক্রান্ত৷ সময়ের ব্যবধানে প্রায় এক দশকের৷ ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি তাঁর আবেগ ও বিশ্বাসে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলি সমাজবাস্তবতায় কীভাবে, কতটা বস্ত্তগত সত্য ও তমে প্রতিফলিত হয়েছে? ২০১৪ সালের পর ২০১৯ সালেও তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং দেশবাসী ‘অমৃতকাল’-এর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও অপরিশীলিত গণতন্ত্রের মুখোমুখি হলেন৷ কীভাবে? কেন?
(১) স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে নতুন কর্মসংস্থান সংকুচিত হতে হতে শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের সংখ্যা সর্বোচ্চ শৃঙ্কে পৌঁে্ছ গেল৷ তাই কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকের রিপোর্টে ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে কেকারত্বের শতাংশের (৪.৪ শতাংশ) ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে (৩.২ শতাংশ) সামান্য উন্নতি৷ তবে প্রায় সব অসরকারি সংস্থার সমীক্ষায় দেখা যায় ভারতে বেকারত্বের হার অনেক বেশি৷ যেমন সিএমআইএই-এর রিপোর্টে জানা যায় মার্চে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৭.৬ শতংশ৷ যেমন অনেক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরে মতে, ‘গত এক দশক দেশ কার্যত কর্মহীন বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে গিয়েছে৷ একইভাবে ২০২৪ সালের ১৬-২৩ এপ্রিল, ২৬ জন অর্থনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলে রয়টার্স যে রিপোর্ট তৈরি করেছে, তার মধ্যে ১৫ জনই আগামী কেন্দ্রীয় সরকারের সামনে বেকারত্বকেই ‘বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন৷ আবার ওই অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ৮ জন গ্রামের মানুষের ‘ক্রয়ক্ষমতা’ কমে যাওয়াকে চিহ্নিত করেছেন আর দুই জন ‘মূল্যবৃদ্ধ’ ও একজন ‘দারিদ্রের’ কথা বলেছেন৷
অর্থাৎ, দেশের ভয়াবহ বেকারত্ব, গ্রামের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া, মূল্যবৃদ্ধি ও দারিদ্র— একটি অন্যটির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং গভীরভাবে যুক্ত৷
(২) নরেন্দ্র মোদির ২০১৪ সালে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মতো আমেরিকার ডলারের তুলনায় ভারতের টাকার মূল্য ৪০ টাকা হলেও বদলে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে (০৬.০৯.২০২৩) ৮৩.১৩ টাকা ছুঁয়ে, নিম্নস্তরে পৌঁছল৷ ২০২৪ সালে তা ৮৪ টাকার সামান্য নীচে৷
(৩) কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে এম এস স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়ে নরেন্দ্র মোদি প্রায় বিনা আলোচনায় ‘কৃষি’ বিল সংসদে পাশ করিয়ে নেন৷ পরে কৃষিজীবীদের আস্ফালনের ফলে সেই বিল প্রত্যাহার করে নিতে তিনি বাধ্য হন৷ কিন্ত্ত কৃষকরা কৃষিপণ্যের সঠিক দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করে চলেছেন ধারাবাহিকভাবে৷ এবং মহারাষ্ট্র ও গুজরাতের কৃষকরাও আত্মহত্যা করেছেন৷ দেশের অন্যান্য রাজ্যের মতো৷
(৪) ভারতে নরেন্দ্র মোদির শাসনে ‘অচ্ছে দিন’-এর মধ্যানগগনে ২০১৫ সালে ক্ষুধার্ত বিশ্বে ১০৪টি দেশের মধ্যে দেশের স্থান ছিল ৮০তম৷ আর ২০১৬ সালে ‘অচ্ছে দিন’ প্রসারিত হতে হতে ১১৮টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হল ১০০তম৷ তারপর ‘অচ্ছে দিন’কে ম্লান করে ‘বিকশিত’ ও ‘অমৃত কাল’-এর ভারতে ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে’ তথ্যসূত্রে ২০২৩ সালে দেশবাসীর স্থান হল ১২৩টি দেশের মধ্যে ১১১তম৷ ২০২২ সাল থেকে আরও চার ধাপ নীচে৷
এই ‘অচ্ছে দিন’ ও ‘বিকশিত ভারত’-এর মধ্য পর্বে কালো টাকা উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে নরেন্দ্র মোদি ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর রাত দশটায় ‘বিমুদ্রাকরণ’ নামে ‘ঐতিহাসিক’ ঘটনা ঘটালেন ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে৷ বিমুদ্রাকরণের পরের দিন থেকে ডিসেম্বরের শেষ দিন পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদি ও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত অরুণ জেটলি বিমুদ্রাকরণের কারণ নিয়ে কতবার তাঁদের মত বদলেছেন, কতবার ভিন্ন ভিন্ন বয়ান দিয়েছেন— তা অপরিশীলিত গণতন্ত্রের ‘মিথ্যা প্রতিশ্রুতি’র আরও এক বলিষ্ঠ উদাহরণ৷
আর কালো টাকা উদ্ধারের নামে বিমুদ্রাকরণের ফলে কত পরিমাণ কালো টাকা উদ্ধার হয়েছিল, তার তথ্যপ্রমাণ ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থ দফতর সূত্রে দেশবাসী আজও জানতে পারেননি৷ নাকি বিমুদ্রাকরণের নামে ধনীদের কালো টাকা সাদা হয়েছিল?
এছাড়া বিমুদ্রাকরণের পরে যে নতুন ৫০০ ও ২০০০ টাকার নতুন নোট ছাপা হয়েছিল তা জাল করা যাবে না বলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দাবি করেছিলেন৷ বাস্তবে ৫০০ ও ১০০০ টাকার জাল নোটের দৌরাত্ম, বিশেষ করে ২০০০ টাকার জাল নোটের দৌরাত্মে ২০০০ টাকার নোট নিষিদ্ধ না করে কেন্দ্রীয় সরকার বাজার থেকে তুলে নিতে বাধ্য হলেন৷
বিমুদ্রাকরণের পরিণতিতে কালো টাকা উদ্ধার না হলেও বাস্তবে ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামো তথা মেরুদণ্ডই ভেঙে পড়েছিল৷ তার প্রমাণ ভারতের অর্থনীতি স্থায়ীভাবে মন্দা আক্রান্ত হল৷ কারণ, বিমুদ্রাকরণের ফলপ্রবাহে সর্বধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কৃষিক্ষেত্র তথা কৃষিপণ্যের প্রান্তিক ক্রেতা-বিক্রেতারা৷ এছাড়া ক্ষুদ্র-মাঝারি ছোট শিল্পগুলি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল, যে ক্ষেত্রগুলিতে৷
(৫) ক্ষুধার্ত ভারতের দরিদ্র ও ঋণের বোঝায় চাপা পড়ে ২০২২ সালে ভারতে ১১,২৯০ জন কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ ভারতের সর্বাধিক মানুষের জীবন-জীবিকা এখনও নির্ভরশীল৷ তাই ভারতে বেকার শ্রমজীবীদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পৌঁছেছে এবং খাদ্যপণ্য সহ সমস্ত ভোগ্যপণ্যের দাম ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে, এখন বেড়ে চলেছে৷
এবার ভারতের সার্বিক মন্দা-আক্রান্ত অর্থনীতির সামান্য তথ্য তুলে ধরা যাক৷ এখানে বলে নেওয়ার প্রয়োজন আছে যে পরপর তিন বছর উন্নয়নের হার কমলে সেই অর্থনীতিকে মন্দা-আক্রান্ত বলা হয়৷ ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষ থেকে শুরু করে ভারতের উন্নয়নের হার হল:
২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে উন্নয়নের হার ৭.২ শতাংশ৷ ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে হল ৬.১ শতাংশ৷ ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে উন্নয়নের হার হল ৪.২ শতাংশ৷ আর ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের শেষ ত্রৈমাসিক (জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ) কোভিড জানার আগে ৩.১ শতাংশ৷
আবার কোভিড হানার পর এই উন্নয়নের হার যে বিয়োগান্তক হবে তা আগেই নিশ্চিত ছিল, যেমন সব দেশেই হয়েছে৷ তবে অাঁতকে ওঠার মতো ভারতে এই হার ২০২০-২১ সালে ছিল নিয়োগাত্মক (-) ৭.৭ শতাংশ৷ এই কোভিড হানার আগে থেকেই ভারতের অর্থনীতি মন্দা-আক্রান্ত তথ্যে প্রমাণিত৷
ভারতের অর্থনীতি মন্দা-আক্রান্ত, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারতে জ্বালানি তেল-গ্যাসের দাম সর্বোচ্চস্তরে পৌঁছে যাওয়া থেকেও৷ ২০১৪ সালের আগে আমদানি নির্ভর জ্বালানির হার ছিল কমবেশি ৭০ শতাংশ এখন তা বেড়ে হয়েছে কমবেশি ৮৫ শতাংশের কাছাকাছি৷ ২০১৪ সালের যে মাসে জ্বালানি তেলের ব্যারেলে প্রতি আমদানি মূল্য ছিল ১০৮.০৫ ডলার৷
২০১৪ সালের মাস পর্ব থেকে জ্বালান তেল গ্যাসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমতে শুরু করে এবং ২০১৫ সালে দাম নেমে এল ২৭ ডলারে৷ আর ২০২০ সালের ৪ মে দাম আরও কমে, তলানিতে পৌঁছল ২৩.৬৮ ডলার ব্যারেল প্রতি৷
কিন্ত্ত আন্তর্জাতিক বাজারে দাম তলানিতে পৌঁছলেও ভারতে এই পণ্যের দাম ক্রমাগত বেড়ে সর্বোচ্চস্তরে পৌঁে্ছ গেল৷ উদাহরণ, ২০১৪ সালে এক লিটার পেট্রোলের দাম ছিল ৬০ টাকা ও ডিজেলের দাম ৫০ টাকা৷ ২০২৪ সালে দাম ক্রমাগত বেড়ে পৌঁছল পেট্রোল ১০৬.৯৪ টাকা ও ডিজেল ৯০.৭৬ টাকা৷
আর গৃহস্থের রান্নার গ্যাসের দাম ২০১৪ সালে ছিল ৪৯৪ টাকা, সিলিন্ডার প্রতি৷ ২০১৬ সালে দাম বেড়ে হল ৬০৫.৫০ টাকা, ২০১৭ সারে ১ ডিসেম্বর ৭৬৬.০০ টাকা, ২০১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ৮৪৯.০০ টাকা, ২০২২ সালের ১ মার্চ ৯২৬.০০ টাকা৷ ২০২২ সালের ১৯ মে ১০২৯.০০ টাকা, ২০২২ সালের ৬ জুলাই তা হল ১০৭৯ টাকা এবং ২০২৩ সালের প্রথম দকে তা বেড়ে হল ১১২৯ টাকা এবং ২০২৩ সালের প্রথম দিকে তা বেড়ে হল ১১২৯ টাকা৷ তবে ভোটের ঋতুকালীন সময়ে এই জ্বালান তেল-গ্যাসের দাম সাময়িকভাবে কমানো হয়৷ যেমন ২০১৯ সালের লোকসভার নির্বাচনের আগে দাম কমানো হয়েছিল, তারপর আবার বাড়ানো হয়েছিল৷ একইভাবে ২০২৩ সালের রান্নার গ্যাসের দাম ১১২৯.০০ টাকা থেকে কাটিয়ে ২০২৪ সালের নির্বাচনী ঋতুকালে করা হয়েছে ৮২৯.০০ টাকা৷
এখানে বলে রাখা হবে পেট্রোল ও ডিজেলের দাম বাড়লে মদ্যপান সহ সব পন্যেরই দাম বাড়ে এবং রান্নার গ্যাসের দাম বাড়লে সাধারণ গৃহস্তের জ্বালানি বাড়ে৷ আন্তজাতিক বাজারে দাম কমলেও বারতে আমদানি-নির্ভর এই পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়ল কেন? অথবা আমরা বলতে পারি কেন্দ্রীয় সরকার আমদানি খরচ কমলেও দাম বাড়াতে বাধ্য হলেন কেন?
ভারতে তেল-গ্যাসের দাম ক্রমাগত বাড়ার কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম যতবার কমেছে কেন্দ্রীয় সরকার এই পণ্যের ওপর ক্রমাগত শুল্কমাশুল ও সেস বসিয়ে দাম বাড়িয়েছে৷ যেমন, ২০২০ সালের ৪ মে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম তলানিতে পৌঁছে হয়েছিল ২৩.৬৮ ডলার, ব্যারেল প্রতি৷ আর ৫ মে, কেন্দ্রীয় সরকার অতিরিক্ত শুল্ক চাপালেন পেট্রোল লিটার প্রতি ১০ টাকা এবং ডিজেলে ১৩ টাকা৷
এবার দেখে নেওয়া যাক, পেট্রোপণ্যের উপর ক্রমাগত শুল্ক চাপিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার দাম বাড়াতে বাধ্য হলেন কেন? কারণ, ভারতের অর্থনীতি যে মন্দা-আক্রান্ত তা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি৷ পরিণতিতে সরকারের আয় কমেছে এবং আর্থিক ঘাটতি ক্রমাগত বেড়েছে, যেমন বেড়েছে ঋণের দায়৷
তাই কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় নির্বাহ ও আর্থিক ঘাটতি মেটানোর অন্য কোনও উপায় ছিল না বা দিশা ছিল না৷ দ্বিতীয় যে উপায় ছিল এবং এখনও আছে, তা হল ঋণ করা৷ জ্বালানি তেল ও গ্যাসের শুল্ক ও সেস বাবদ কেন্দ্রীয় সরকারের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বর্তমান শাসকরা ঋণ করেছেন বিপুল অঙ্কের টাকা৷
উদাহরণ, ২০১৪ সালের ৩১ মার্চ কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৮.৬ লক্ষ কোটি টাকা৷ আর ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫৫.৬ লক্ষ কোটি টাকা৷
এই তথ্যের সঙ্গে আরও একটি চমকপ্রদ তথ্য হল, প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বকাল পর্যন্ত মিলে যে পরিমাণ ঋণ করেছিলেনয প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একাই তার তেকে বেশি ঋণ করেছেন, তিনগুণেরও কিছু কম৷
তাই ‘অচ্ছে দিন’-এর পর ‘অমৃতকাল’-এর ভারতে বেকারত্ব ও অসাম্য শুধু সর্বোচ্চস্তরেই নয়, ঋণ জর্জরিতও৷ আর একদা ভারতের সহানুভূতিসম্পন্ন গণতন্ত্র অপরিশীলিত ও আগ্রাসী গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটেছে, মিথ্যা প্রতিশ্রুতির স্রোতধারায়৷