বিধানচন্দ্র রায় আজও মেঘে ঢাকা তারা

স্বপনকুমার মণ্ডল

বিধানচন্দ্র রায়ের (১.৭.১৮৮২-১.৭.১৯৬২) নাম মূলত দুটি কারণে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এবং এখনও এজন্য তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। প্রথমত, ১৯৪৮ থেকে তিনি আমৃত্যু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর (দ্বিতীয়) গুরুদায়িত্ব সফল ভাবে পালন করে নজির সৃষ্টি করেছেন। এজন্য তাঁকে ‘আধুনিক বাংলার রূপকার’ বলে অভিহিত করা হয়। তাঁর পরিকল্পনাতেই দুর্গাপুর, কল্যাণী ও বিধাননগর উপনগর গড়ে তোলা হয়েছে। অন্য যে-পরিচয়টি তাঁকে প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব করে তুলেছে, সেটি হল তাঁর চিকিৎসক পরিচিতি।  ভারত সরকার তাঁর জন্মদিনটিকে ‘জাতীয় চিকিৎসক দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করেছেন। তাঁর আরও যেসব উল্লেখযোগ্য পরিচয় রয়েছে, সেগুলি হল কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র (১৯৩১-৩২) এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯৪২) প্রভৃতি। এছাড়া তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী হিসাবেও পরিচিত হতে পারতেন। শিলং হাইড্রো ইলেকট্রিক কোম্পানির অন্যতম ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। এছাড়া জাহাজ, বিমান ও ইপিয়ারেন্স ব্যবসার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। ফলে জাতীয় জীবনে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বিধানচন্দ্রকে ভারত সরকার ১৯৬১-র প্রজাতন্ত্র দিবসে ‘ভারতরত্ন’ সম্মানে ভূষিত করে তাঁকে উপযুক্ত স্বীকৃতি প্রদান করে। কিন্তু এতসবের পরেও বলতে হয়, বিধানচন্দ্র রায় আজও অনাবিষ্কৃত হয়ে রয়েছেন। তাঁকে ‘আধুনিক বাংলার রূপকার’ বলে, কিংবা, তাঁর জন্মদিনকে ‘জাতীয় চিকিৎসক দিবস’ হিসাবে পালন করেই তাঁর প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা নিঃশেষ হয়ে যায় না। তিনি আজও মেঘে ঢাকা তারা। তাঁকে যেমন আবিষ্কারের প্রয়োজন রয়েছে, তেমনই তাঁর আদর্শকে পাথেয় করে অসম্পূর্ণ পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করা জরুরি ।

আজও বাংলার উন্নয়নে বিধানচন্দ্রের অবদানকে পরম শ্রদ্ধায় সঙ্গে স্মরণ করা হয় ঠিকই, কিন্তু তাঁকে অনুসরণ করে বাকি উন্নয়নের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা প্রতিফলিত হয় না। অর্থাৎ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেই আমাদের দায় সারার মানসিকতা আজও সজীব, কিন্তু তাঁকে মেনে চলার ফুরসৎ আমাদের নেই। অন্যদিকে তাঁর পরিচয় খ্যাতিতে মোড়া। অর্থাৎ বিধানচন্দ্রের রক্ত-মাংসের মানুষের অস্তিত্বকে তাঁর অতুলনীয় প্রতিভার কারণে অস্বীকারের মাত্রায় অসাধারণের মোড়কে ব্যতিক্রমী করে রাখা হয়েছে। অথচ তাঁর মহাজীবনকে রক্তমাংসের মানুষের আধারে ছড়িয়ে দিলে সেই মহানুভবতায় অপরকে সামিল করা সহজ ও সুন্দর হয়ে উঠবে। সেদিক থেকে তিনি কত বড় মাপের চিকিৎসক ছিলেন, তার চেয়ে একজন চিকিৎসককে কত বড় মাপের মানুষ হতে হয় তার আলোয় তাঁকে অনুভব করা এই সময়ের প্রেক্ষিতে একান্ত জরুরি। যেখানে মানুষের দুবেলা আহার জোটে না, সেখানে শারীরিক রোগের চিকিৎসা করা বিলাসিতারই সামিল। সেদিক থেকে শরীরের চিকিৎসার পূর্বে মানুষের অভাবের চিকিৎসা করা একান্ত প্রয়োজন। তা না-হলে অনাহারে অপুষ্টিতে দরিদ্র মানুষের কঙ্কালসার দেহই আমাদের সামনে ব্যঙ্গচিত্রের আস্বাদন বয়ে এনে আমাদের অমানবিক দিকের পরিচয়কেই প্রকট করে তুলে ধরে। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় রোগীর মুখ দেখেই তার নিদান দিতে পারতেন। কেননা তিনি অনায়াসেই তাঁর মহানুভবতায় রোগীর অন্তরে প্রবেশ করে অন্ত্রের সঙ্গীন অবস্থায় পৌঁছাতে পারতেন।


দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরিসরে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে আসায় বিধানচন্দ্রের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গকে নতুন করে গড়ে তোলার অবকাশ ছিল এবং তা তিনি স্বকীয় প্রতিভায় সম্পন্ন করেছেন। এমনকি, তিনি তাঁর মহানুভবতায় বিরোধী দলেরও শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছিলেন। সেরকম দৃষ্টান্ত আজ সত্যিই বিরল। আর তাই তাঁর মহানুভবতার আলোয় আমাদের পথ চলার সোপান তৈরি করা একান্ত কাম্য। কেননা নিজের কৃতকর্মের মাধ্যমে কীভাবে একজন শাসক শাসিতের হৃদয়ে আপনার জন হয়ে ওঠে এবং রাজনৈতিক পরিচয়ের শক্ত আবরণে আবৃত থাকা সত্ত্বেও তাকে অনাবৃত করে কী করে সকলের সামনে আত্মপরিচয়কে মেলে ধরা সম্ভব, তার দৃষ্টান্ত তিনিই আমাদের দিয়ে গিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সুযোগ্য ব্যক্তির দৌলতে কোনো পদ কীভাবে আমজনতার হৃদয়ের আসনে পরিণত হতে পারে, তার নিদর্শন তো মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ই আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন। আজ যখন ক্ষমতার অলিন্দে পদে আসীন ব্যক্তিমাত্রই আমজনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং মানুষের অশ্রদ্ধার কারণ হয়ে ওঠেন, তখন তাঁকে বেশি করে মনে পড়ে। আসলে সেক্ষেত্রে পদে আসীন ব্যক্তিমাত্রেই সেই পদ হয় আপদ, নয় বিপদ হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, সেই পদের মধ্যে নিজেকে নিরাপদ ভেবে বসার বাতিক ভর করে। সেক্ষেত্রে পদের গুরুত্ব আরও গুরুতর আকার ধারণ করে। সেখানে এই ক্ষমতাসর্বস্ব রাজনৈতিক আসরে বিধানচন্দ্র রায়ের মতো শাসকের বড়ই প্রয়োজন। কথায় আছে ক্ষমতার আসনে বসলেই মানুষের আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে। সেই চেহারার নিকষে বিধানচন্দ্র দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি খাঁটি সোনা। আমাদের এই ভেজালের দিনে ২৪ ক্যারেট সোনার প্রত্যাশা করতেও ভয় হয়। সেখানে চিরকুমার বিধানচন্দ্রের সুবর্ণগোলক মহানুভব আমাদের সদাই পরশপাথরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেজন্য তাঁর প্রতি বাৎসরিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের কৃত্রিমতাকে দূরে সরিয়ে রেখে তাঁর মহানুভবের রসদকে আমজনতার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া ভীষণ প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র সাগরময় ঘোষের ‘একটি পেরেকের আত্মকাহিনী’ বড়ই অপ্রতুল মনে হয়। কেননা তিনি যে মহানুভবতার অফুরন্ত খনি। সেই খনির দিকে বারে বারেই আমাদের চোখ ফেরাতে হবে, হাত পাততে হবে, আবার অনুসন্ধানও চালাতে হবে। তাতে নির্ভেজাল মনের তৃষ্ণা অন্তত একটু হলেও বৃদ্ধি পেলে জীবনধন্য হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।