সংসদে ‘ফিল্মি প্রত্যাবর্তন’ মহুয়ার! ছ’মাস পর ‘মাথা উঁচু’ করেই লোকসভায় পা রাখলেন কৃষ্ণনগরের সাংসদ

নিজস্ব প্রতিনিধি, দিল্লি, ২৪ জুন:  ছ’মাস পর ফের চেনা সংসদে পা রাখলেন কৃষ্ণনগরের নবনির্বাচিত তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। তিনি বলেছিলেন, “আমি ফিরবই। মাথা উঁচু করে ফিরব।” তাই করে দেখালেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ভরসা রেখেছিলেন মহুয়ার উপর। সাংসদ পদ খারিজ হওয়ার পর লোকসভার বাইরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মহুয়া গর্জে উঠে বলেছিলেন, “আমার বয়স এখন ৪৯ বছর। আগামী ৩০ বছর সংসদের ভিতরে-বাইরে লড়ব আমি। আমাকে ইডি বা সিবিআই দিয়ে দমিয়ে রাখা যাবে না।” ৮ ডিসেম্বর, ২০২৩-এর পর এবার ২৪ জুন, ২০২৪-এ আরও দাপটের সঙ্গে সংসদে পা রাখলেন মহুয়া। নিজ প্রত্যাবর্তন নিয়ে সোমবার মুখ খুললেন কৃষ্ণনগরের সাংসদ। বিঁধলেন প্রধানমন্ত্রী তথা এনডিএ সরকারকেও। তিনি বলেন, “৮ ডিসেম্বর যখন আমাকে অবৈধভাবে বহিষ্কার করা হয়েছিল এবং সংসদে আমাকে আমার বক্তব্য রাখতেও দেওয়া হয়নি, তখন আমি সংসদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মাথা উঁচু করে লোকসভায় ফিরব। আমাকে ইডি-সিবিআই দিয়ে ভয় দেখিয়ে দমানো বা হারানো যাবে না। আমি এবং আমরা সেটা করে দেখিয়েছি। আমরা ২৩৪ জন এখন লোকসভায় আছি। উল্টোদিকে, বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় যেতে তো পারেইনি, বিভিন্ন দলের সাহায্য নিয়ে নরেন্দ্র মোদি একটি পঙ্গু সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসেছেন! ওঁনার ‘অব কি বার ৪০০ পার’ — স্লোগানের এই হাল দেখার পরেও উনি প্রধানমন্ত্রী কী করে হলেন, সেটাই আশ্চর্যের!” মহুয়ার আরও সংযোজন, “আমরা (ইন্ডিয়া জোট) সকলে মিলে ২৩৪। বিজেপি একা ২৪০! মাত্র ছ’টা আসনের তফাত। ফলে এ বার সব কিছু আর অত সহজে হবে না।”

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, লোকসভা ভোটের আগে প্রশ্ন-ঘুষ কাণ্ডে নাম জড়িয়েছিল মহুয়ার। বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে অভিযোগ করেছিলেন, সংসদে আদানিদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করার জন্য মহুয়া দুবাইয়ের ব্যবসায়ী দর্শন হীরানন্দানির কাছ থেকে উপহার এবং নগদ টাকা নিয়েছেন। অভিযোগ জানিয়ে পৃথকভাবে সিবিআই প্রধানকে চিঠি লিখেছিলেন মহুয়ার প্রাক্তন বন্ধু জয় অনন্ত দেহাদ্রাইও। তারপর থেকে এই বিতর্ক রাজ্য তথা জাতীয় রাজনীতিতে ঝড় তোলে। মহুয়ার বিরুদ্ধে লোকসভার এথিক্স কমিটি তদন্ত করে। এবং তাঁর সাংসদ পদ খারিজের সুপারিশ করে। তাঁর সাংসদ পদ খারিজ করেছিলেন স্পিকার ওম বিড়লা। ৮ ডিসেম্বর, ২০২৩ এ লোকসভা থেকে মহুয়াকে বহিষ্কার করা হয়।

মহুয়ার অভিযোগ ছিল, সিদ্ধান্ত জানানোর আগে মহুয়ার বক্তব্য শুনতে চাননি স্পিকার। যদিও মহুয়ার বহিষ্কারকে হাতিয়ার করে লোকসভা নির্বাচনে কৃষ্ণনগর থেকে পদ্ম শিবির নিজ পাল্লা ভারী করতে পারেনি। তৃণমূল অবশ্য মহুয়া-গড় থেকে এই বহিষ্কৃত মহুয়াকেই লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী করেছিল। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন বিজেপি-র অমৃতা রায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একাধিকবার এই অমৃতার সমর্থনে কৃষ্ণনগরে প্রচারে এসে বক্তব্য রেখেছিলেন, এমনকি করেছিলেন রোডশোও। তাতেও দমানো সম্ভব হয়নি মহুয়াকে। ৫৬ হাজারের বেশি ভোটে জিতে পুনরায় সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। যে লোকসভা থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সাড়ে ছ’মাসের মধ্যে সেখানেই আবার প্রবেশ করলেন তিনি। মঙ্গলবার সাংসদ হিসেবে শপথগ্রহণ করবেন মহুয়া। ফের আওয়াজ তুলবেন দিল্লির বুকে।


উল্লেখ্য, সোমবার ১৮তম লোকসভার প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছে। প্রোটেম স্পিকার ভর্তৃহরি মহতাবের তত্ত্বাবধানে সাংসদ হিসাবে শপথ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা। সেই সঙ্গে একাধিক রাজ্যের নবনির্বাচিত সাংসদদের শপথগ্রহণও হবে সোমবারই। মহুয়া সেখানে উপস্থিত হন। এদিন যদিও তাঁর শপথগ্রহণ হবে মঙ্গলে। সোমবার লোকসভা শুরুর আগে সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ পুরনো সংসদ ভবনের চত্বরে গান্ধীমূর্তির পাদদেশে অবস্থান করছিল তৃণমূলের সংসদীয় দল। মহুয়া সেই কর্মসূচিতেও যোগ দিয়েছিলেন। এদিন লোকসভায় গিয়ে নিজ এক্সে হ্যান্ডেলে ছবিও পোস্ট করেন মহুয়া। তাঁর প্রত্যাবর্তন নিয়ে মহুয়া নিজে যেমন আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, তেমনই তাঁর দলও তাঁর প্রতি আস্থা রেখেছিল। তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহুয়ার সাংসদ পদ খারিজের পর বলেছিলেন, “লাভ নেই। কয়েক মাস পরেই তো ভোট! মহুয়া তো আবার জিতবে, আবার ফিরবে!” কৃষ্ণনগরে মহুয়ার সমর্থনে একাধিকবার নির্বাচনী প্রচারে গিয়েও মমতা এই প্রসঙ্গ তুলেছেন। বারংবার মমতাকে বলতে শোনা গিয়েছে, “মহুয়াকে ওঁরা ভয় পায়। ও বিজেপির ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল। তাই ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু ও আবার ফিরবে।”

তিনি আরও বলেছিলেন, “আসলে মহুয়াকে নিয়ে ওঁদের খুব জ্বালা। ও মুখের ওপর কথা বলে দেয়। ভয় পায় না। দেশে কী চলছে সেটা ও বলে দিয়েছিল। সেকারণেই ওকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। মহুয়া লড়ে বাঘের বাচ্চার মতো।”

একইভাবে অভিষেক মহুয়ার সমর্থনে ভোট প্রচারে গিয়ে বলেছিলেন, “আপনারা যাঁকে ভোট দিয়েছেন, গায়ের জোরে তাঁর সাংসদ পদ খারিজ করেছে। আপনারা যাঁকে ক্ষমতা তুলে দিচ্ছেন, বিজেপি তাঁর হাত থেকে ক্ষমতা নিয়ে নিচ্ছে!” তিনি আরও বলেছিলেন, “গত বছরের থেকে দ্বিগুণ ভোটে জয়ী করুন মহুয়াকে। এই ঋণ উন্নয়নের মাধ্যমে শোধ করব। আপনারা প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছেন, তাঁর পদ খারিজ করেছে! যে তাঁর পদ খারিজ করেছে, তাঁর বিসর্জন হবে তো?” মমতা-অভিষেকের কথা রেখেছেন কৃষ্ণনগরের জনসাধারণ। ফের মহুয়াকেই নিজ প্রতিনিধি করে সংসদে পাঠিয়েছেন কৃষ্ণনগরবাসী।