• facebook
  • twitter
Saturday, 23 November, 2024

সকলের দল, সকলের নেত্রী

সুমন ভট্টাচার্য ২০২৪-এর ২১শে জুলাই থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চিতভাবেই ২০২৬-এ বিধানসভা ভোটের দুন্দুভি বাজিয়ে দেবেন। কারণ, ২১শে জুলাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শুধু শহীদ স্মরণ নয়, বাৎসরিক রাজনৈতিক ইস্তেহার প্রকাশও বটে। অর্থাৎ যে মঞ্চকে ব্যবহার করে তিনি দলের কর্মীদের এবং হয়তো নেতাদের জন্য পরবর্তী রাজনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেন। ২১শে জুলাই মানেই জনতার উপচে পড়া ভিড়,

সুমন ভট্টাচার্য

২০২৪-এর ২১শে জুলাই থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চিতভাবেই ২০২৬-এ বিধানসভা ভোটের দুন্দুভি বাজিয়ে দেবেন। কারণ, ২১শে জুলাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শুধু শহীদ স্মরণ নয়, বাৎসরিক রাজনৈতিক ইস্তেহার প্রকাশও বটে। অর্থাৎ যে মঞ্চকে ব্যবহার করে তিনি দলের কর্মীদের এবং হয়তো নেতাদের জন্য পরবর্তী রাজনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেন। ২১শে জুলাই মানেই জনতার উপচে পড়া ভিড়, আবেগের বিচ্ছুরণ এবং হয়তো বৃষ্টিও। তৃণমূলের অন্দরমহলে চালু কথা হচ্ছে, “বৃষ্টি ২১শে জুলাইতে যেমন বাধ্যতামূলক, তেমনই শ্রাবণের ধারা দল এবং নেত্রীর জন্য লাকি!” এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই রবিবার ২১শে জুলাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগামী বিধানসভা নির্বাচনের জন্য কী বার্তা দেন সেই দিকে তাকিয়ে থাকবে সকলে।

এতে কোনও সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, তৃণমূল নেত্রী আগামী ২ বছরের জন্য বিজেপিকেই তাঁর আক্রমণের নিশানা করবেন। কারণ, এখনও পর্যন্ত রাজ্যে গেরুয়া শিবিরই প্রধান প্রতিপক্ষ। লোকসভা নির্বাচনে লক্ষ্যপূরণ না হওয়ার ফলে হতোদ্যম রাজ্য বিজেপির জন্য আরও বড় ধাক্কা হিসেবে এসেছে বিধানসভার চারটি উপ-নির্বাচনের ফলাফল। একের পর এক ভোট রাজ্য বিজেপিকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে আরও গুরুত্বহীন করে দিচ্ছে এটা বোঝার পর মরিয়া শুভেন্দু অধিকারী একেবারে খোদ নরেন্দ্র মোদির স্লোগানকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছে। যে রাজ্যে প্রায় ২৭ শতাংশ সংখ্যালঘু মানুষের বাস এবং ১০০টির কাছাকাছি বিধানসভা কেন্দ্রে মুসলিম ভোটই নির্ণায়ক শক্তি, সেই রাজ্যে যদি মুসলিমরা এককাট্টাভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেয়, তাহলে কী রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে, সেটা আন্দাজ করেই সম্ভবত বিধানসভার বিরোধী দলনেতা আর সকলের জন্য বিকাশের কথা বলতে রাজি নন। অর্থাৎ, শুভেন্দু অধিকারীর নিদান হচ্ছে তিনি পশ্চিমবঙ্গে ঘোষণা করেই বিজেপিকে শুধুমাত্র হিন্দুদের দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এগোতে চান। শুভেন্দুর এই মরিয়া বক্তব্য যতটা সর্বভারতীয় মিডিয়ার নজর কেড়েছে, ততটাই অস্বস্তিতে ফেলেছে বিজেপি নেতৃত্বকে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্যকে বাতিল করে দিলেও গোটা ঘটনাটি গেরুয়া শিবিরের মেরুকরণের রাজনীতিকে একেবারে ‘বেআব্রু’ করে দিয়েছে।

শুভেন্দু অধিকারীর মরিয়া বক্তব্য, গেরুয়া শিবিরের মেরুকরণের রাজনীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিশ্চয়ই নিজেকে ‘সকলের নেত্রী’ হিসেবে তুলে ধরেই রাজনৈতিক প্রচারে যেতে চাইবেন। তাঁর ‘ব্র্যান্ড অফ পলিটিক্স’ অনুযায়ী তিনি দেখাতে চাইবেন যে, তিনি দীঘাতে জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ করে রথযাত্রা চালু করতে যেমন উদ্যোগী, তেমনই আবার রেড রোডে ইদের নামাজে যেতে কখনও ভুলে যাননি। তৃণমূল নেত্রীর তরফে যেমন সর্বধর্ম সমন্বয়ের চিত্রটিকে তুলে ধরা হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এতদিনের রাজনৈতিক এবং তারপরে ১৩ বছরের প্রশাসনিক জীবনকে ‘শো-রিল’ হিসেবে দেখানোর জন্য, তেমনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মহিলা ভোট ব্যাঙ্ককে আরও জমাট করার দিকে হাঁটবেন। এ বিষয়ে তো কোনও সংশয় নেই যে, বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প থেকে লক্ষ্মীর ভান্ডার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পশ্চিমবঙ্গের মহিলা ভোটারদের কাছে নিশ্চিত আশ্রয়স্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বলে, আগে বিজেপির ‘ঘাঁটি’ বলে পরিচিত এমন এলাকাতেও, যেমন ঝাড়গ্রাম বা বাঁকুড়ায়, তৃণমূল হিন্দু মহিলা ভোটারদের ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতিতে যতটা স্বতস্ফূর্ততা আছে, অনেক সময়ই তাঁর সিদ্ধান্তও ততটা তাৎক্ষণিকভাবেই আসে। সেই কারণেই রেড রোডে ১০০ দিনের কাজের বকেয়া টাকা আদায়ের ধরনায় বসে আচমকাই তিনি ঘোষণা করে দিতে পারেন যে, কেন্দ্র টাকা না দিলেও রাজ্য সরকার নিজেদের অর্থ থেকে ওই টাকা মিটিয়ে দেবে। তাহলে কি ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে এরকম কোনও ঘোষণা এবার থাকতে পারে? রাজনৈতিক মহলে যেমনটা গুঞ্জন যে, রাজ্য সরকার লক্ষ্মীর ভান্ডারের জন্য বরাদ্দ বাড়াবে, অর্থাৎ প্রত্যেক মহিলা মাথা পিছু আরও বেশি টাকা পাবেন, সেই ঘোষণা কি এই ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকেই হয়ে যাবে? কেউ জানে না, কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময়ই রাজনীতিতে নিজের কাছে কিছু লুকোনো ‘তাস’ রেখে দিতে পছন্দ করেন। সেটা প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেই হোক কিংবা দলের অথবা সরকারের নীতি ঘোষণার মধ্যে দিয়ে সবাইকে হতবাক করে দেওয়ার প্রক্রিয়াতেই হোক। এই বছরের ২১শে জুলাই তৃণমূলের কাছে অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, রাজ্যের একাধিক বিধায়ক এবং মন্ত্রী সাংসদ হয়ে গেছেন। যেমন নৈহাটির পার্থ ভৌমিক ব্যারাকপুরের সাংসদ হয়েছেন, মেদিনীপুরের বিধায়ক জুন মালিয়া লোকসভায় পৌঁছে গিয়েছেন।

স্বভাবতই বিধানসভার যে ৬টি আসনে আগামী দিনে উপ-নির্বাচন হতে চলেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রার্থী বাছবেন। আবার মন্ত্রিসভায় যেসব ফাঁকা জায়গা রয়েছে, সেই সবগুলিতেও তৃণমূল নেত্রীকে পূর্ণ করতে হবে। তাই দলের নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাদের তুলে আনছেন, নতুন কাদের বাছছেন, তারও একটা ইঙ্গিত হয়তো ২১শে জুলাই থেকেই পেয়ে যাওয়া যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইতিমধ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক করে নবীন প্রজন্মের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। তিনিই যে আগামী দিনে দলের মুখ, এটা বোঝাতে। তৃণমূল নেত্রী ইতিমধ্যেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের বৈঠকে দলের প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠিয়েছেন, আমরা সংসদে লোকসভার বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধীকে স্পিকার নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করতে দেখেছি। এই পরিস্থিতিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তরুণ প্রজন্মের যেসব নেতাদের তুলে আনছেন এবং আগামী দিনের কথা ভেবে দলকে যেভাবে সাজাতে চাইছেন, তারও একটা প্রতিফলন হয়তো ২১শে জুলাই দিয়ে যাবে।

২০২৪-এর ২১শে জুলাই যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে নতুন রাজনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করার রাজনৈতিক মঞ্চ, তেমনই তৃণমূলকেও আগামী যুদ্ধের জন্য, ‘ভোট যুদ্ধ’-এর জন্য প্রস্তুতি শুরু করার জন্য ‘খুঁটিপুজো’।