বিচারপতিরা ‘ভগবান’ না হলেও এখনও আমজনতার চরম আশ্রয়, পরম নির্ভরতা

স্বপনকুমার মণ্ডল

সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টের বার লাইব্রেরির দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাকাডেমি আয়োজিত এক আলোচনাসভায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় তাঁর বক্তব্যে কোর্টের বিচারপতিকে ‘ভগবান’,আদালতকে মন্দির ভাবায় ‘ঘোর বিপদে’র চেতাবনি দিয়েছেন । সেখানে তিনি মানুষ আদালতকে ন্যায়ের মন্দির ভাবলে যেমন ঘোর বিপদের কথা শুনিয়েছেন, তেমনই বিচারপতির নিজেকে ঈশ্বর ভাবাতেও সেই একই বিপদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন । সেক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি কোর্টের বিচারপতিকে ‘জনগণের সেবক’ ভাবার নিদান দিয়েছেন। তা হলে দয়া,সহানুভূতি ও সহমর্মিতার সমন্বয়ে সুবিচারের পথ সুগম হয়ে ওঠে । এজন্য পূর্বধারণার বশবর্তী হয়ে বিচার না করার বিষয়েও সতর্ক করেছেন প্রধান বিচারপতি । তাঁর কথাগুলো আপনাতেই ভাবিয়ে তোলে। অথচ তারপরেও যেন মনের সায় পুরোপুরি মেলে না। আসলে সকলে বিচার চায় না,মানেও না। যে অন্যায় বা অপরাধ করে তার বিচার চাইলেই ক্ষতি, হলেই বিপদ আর মানলেই শাস্তি ভোগ। আর যে অন্যায়-অপরাধের শিকার তার বিচারই একমাত্র ভরসা ।

সেক্ষেত্রে বিচারের ঐশ্বরিক বিভূতি জগৎজুড়ে। দুষ্টের দমন,শিষ্টের পালনের স্ববাকমূর্তি ধর্মীয় আধারেও সম্প্রসারিত। সেখানে বিচারকের ঐশ্বরিক অস্তিত্ব নানাভাবে হাতছানি দেয়, রাজার ত্রাতার ভূমিকাও জেগে ওঠে। যার কেউ নেই, তার ভগবান থাকার মতো সুবিচারের আশা জেগে থাকে আজীবন । শুধু তাই নয়, সুবিচারের প্রত্যাশাই বেঁচে থাকার বিশল্যকরণী হয়ে ওঠে । সেক্ষেত্রে বিচারের প্রতি আস্থা বা বিশ্বাস যত সুদৃঢ় হয়,বিচার ব্যবস্থার প্রতি ততই পরম নির্ভরতা জেগে থাকে । তাতে সুবিচার প্রাপ্তিতে যেমন ধর্মের জয়ধ্বনি বেজে ওঠে , সুবিচার দাতা বিচারককে তেমনই বিধাতার অবতার মনে হয় । আর সেখানেই বিচারকের নিরপেক্ষ ভূমিকা শ্রদ্ধার বেদিমূলে যেভাবে প্রত্যাশায় নিবিড়তা লাভ করে, সেভাবেই তাঁর নিরপেক্ষতার প্রতি সদা সতর্ক দৃষ্টি অন্তর্দৃষ্টিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে । তাঁর ব্যক্তিগত মতামতও বিচারকের নিরপেক্ষতার অভাবে জুড়ে যায়, তাঁর সক্রিয়তাকেও অতি সক্রিয়তায় পক্ষপাতদুষ্ট করে তোলে । বিচারের মূল কাণ্ডারি হিসাবে বিচারকের ভূমিকা সম্পর্কে সাধারণ্যের ধারণা অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং সংবেদনশীল । তাঁর নিরপেক্ষতার বিষয়টি যেভাবে সদা সতর্কতায় সক্রিয়তা লাভ করে, তাঁর সক্রিয় উদ্যোগও তেমনই অতি সক্রিয়তা বোধে বিচারের পরিপন্থী মনে হয়।


অন্যদিকে বিচারকের সহৃদয় মানসিকতা নিয়ে আমাদের গড়ে তোলা ধারণা সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে । শুধু তাই নয়, সেক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ বিচারের চেতনা যেভাবে মহত্ত্ব লাভ করেছে,তা আজও প্রবহমান । স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাহিনী'(১৩০৬) কাব্যের ‘গান্ধারীর আবেদন’ কবিতার মধ্যে গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রকে শুনিয়েছেন সেই ‘শ্রেষ্ঠ বিচারে’র কথা : ‘প্রভু, দণ্ডিতের সাথে/দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে/ সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।’ বিচারকের সমানুভূতিতে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারের কথা নানাভাবেই প্রচার লাভ করে । কবিতায় প্রকাশিত সংজ্ঞাটি ভাব সম্প্রসারণ থেকে বিচারকের মাহাত্ম্য বর্ণন সবেতেই ব্যবহার করা হয় । অথচ শুধু শাস্তি প্রদান করাই তো বিচারের লক্ষ্য নয়। আবার তথ্যপ্রমাণ সহযোগে যান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেও বিচার চলে না, তা সামাজিক দায়বদ্ধতায় সম্পৃক্ত,মানবিক অধিকার ও মূল্যবোধে বিজড়িত, আধুনিক সভ্যতার উত্তরণেও সমান সক্রিয় । এজন্য তথ্য ও যুক্তি দিয়ে প্রমাণের যান্ত্রিকতার পরেও সামাজিক দায় ও মানবিক আবেদন তার সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে বিচারকে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের ছকে শাস্তি ও পুরস্কারে যেমন মেলানো যায় না, তেমনই তার প্রকৃতিতে নিছক সাদা-কালো বা ভালোমন্দের ছকবন্দি ধারণাও অচল । সেখানে দৃষ্টির চেয়ে অন্তর্দৃষ্টি সক্রিয় হয়ে ওঠে । স্বাভাবিক ভাবেই বিচারের ক্ষেত্রে বিচারকের অন্তর্দৃষ্টির গভীরতাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথচ তাঁর সদর্থক সক্রিয়তাও বিপক্ষের কাছে সন্দেহের কারণ মনে হয়, সুবিচারের পরিপন্থী মনে হয় ।

আসলে বিচারের নিরপেক্ষ প্রকৃতির সঙ্গে বিচারকের নিরপেক্ষতাকে আমরা এক করে দেখি। অথচ ভেবে দেখি না বিচারকও একজন সমাজ সচেতন স্বতন্ত্র মানুষ । তাঁরও নিজস্ব কণ্ঠস্বর রয়েছে । সামাজিক দায়বদ্ধতাও বর্তমান । নিজস্ব মূল্যবোধের আলোয় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা না থাকলেও মতামত প্রকাশের সদিচ্ছা থাকতেই পারে। শুধু তাই নয়, তাঁকে নিরপেক্ষ ভাবার কারণও যথোপযুক্ত নয়। তিনি তো সৎ-এর পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে । সেক্ষেত্রে তাঁর নিরপেক্ষতার ছদ্মবেশ জরুরি নয়, সবচেয়ে জরুরি বিচারকে নিরপেক্ষ করা বা রাখা। বিচারের নিরপেক্ষতা দিয়ে বিচারকের পক্ষপাতিত্বকে হেয় করা বা হীন চোখে দেখে তাঁকে আক্রমণ বা অপমান করা সমীচীন নয়। সুবিচারের স্বার্থেই তাঁকে যেমন লক্ষ্যভেদী অর্জুন হতে হয়,তেমনই তাঁর বিচারকে নির্মমতার সঙ্গে নিরপেক্ষ রাখা সমীচীন ।

তাঁর লক্ষ্য শুধু শাস্তি দেওয়া নয়, উপযুক্ত ব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্যার উৎসমূলে পৌঁছানোয় পাখির চোখ করা । সেখানে চোরের চেয়ে চুরিকে জানা আবশ্যক ; পাপীর চেয়ে পাপের স্বরূপ বোঝা জরুরি । অন্যায় বা অপরাধের সমূলে বিনাশ করার লক্ষ্যে শুধু শাস্তি বিধান করেই তাঁর দায় শেষ হয় না,সেইসঙ্গে যারা তার শিকার তাদের প্রাপ্য ফিরিয়ে দেওয়াও একান্ত কাম্য। সেক্ষেত্রে বিচারে কালক্ষেপ করা যেমন অনুচিত,তেমনই তা অবিচারের সামিল । কথায় আছে ‘Justice delayed is Justice denied’ । বিচার ব্যবস্থার এই দীর্ঘসূত্রিতা অভিযুক্ত দোষীর পক্ষে আশীর্বাদ মনে হয়, বিচারপ্রার্থীর কাছে অভিশাপ হয়ে ওঠে । একইভাবে বিচারকের লক্ষ্যভেদী তৎপরতা যখন বৃদ্ধি পায়, তখন তাঁর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়,অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করে। সেক্ষেত্রে বিচারকের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসলে অভিযুক্ত পক্ষ তাদের অস্বচ্ছতাকে আড়াল করতে চায়, ধরা পরার ভয়ে বিচারককেই পক্ষপাতদুষ্ট বলে কলঙ্ক রটায়।

সেদিক থেকে বিচারকের নিরপেক্ষতার চেয়েও জরুরি তাঁর সৎসাহসের । কেননা বিচারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা তাঁর কর্তব্য । সেখানে নিরপেক্ষতার অপর নাম নির্মমতা যা সুবিচারের লক্ষ্যে একান্ত আবশ্যিক। ‘গান্ধারীর আবেদন’-এ সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারের গড়ে তোলা ধারণাই আবার অব্যবহিত পরিসরে গান্ধারীর মুখেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভিন্নভাবে তুলে ধরেছেন । পাপী দুর্যোধনকে ক্ষমা না করে ত্যাগ করার কথায় গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন: ‘পাপী পুত্রে ক্ষমা কর যদি/ নির্বিচারে, মহারাজ, তব নিরবধি/ যত দণ্ড দিলে তুমি যত দোষীজনে, / ধর্মাধিপ নামে, কর্তব্যের প্রবর্তনে, / ফিরিয়া লাগিবে আসি দণ্ডদাতা ভূপে—/ ন্যায়ের বিচার তব নির্মমতারূপে / পাপ হয়ে তোমারে দাগিবে।’ এই ‘নির্মমতা’ যেমন বিচারের নিরপেক্ষতার অভাবে নেমে আসে,তেমনই তার ব্যবস্থার পক্ষে অপরিহার্য হয়ে ওঠে । সেখানে ক্ষমতাশালী অভিযুক্তের বিপক্ষে বিচারকের সৎসাহসের পরিচয়ই তাঁর নিরপেক্ষ বিচারের সহায়ক হতে পারে । তাঁর সুবিচারের আদর্শেই পক্ষপাতহীন নির্মম প্রকৃতিই দোষীর উৎসমূলকে চিহ্নিত করে যথোপযুক্ত শাস্তি থেকে নিরপরাধীর অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব । সেখানে সৎসাহসের অভাবে নিরপেক্ষতার সংকট অনিবার্য হয়ে ওঠে, নিরপক্ষেতার অভাবে পক্ষপাতদুষ্ট সন্দেহ নিবিড়তা লাভ করে । অন্যদিকে দণ্ডিতের সঙ্গে দণ্ডদাতার অধিক গুরুত্বে নির্মম নিরপেক্ষতার বিষয়টি গুরুত্ব হারায়।

আসলে বিচারের লক্ষ্যে দোষীর শাস্তি নয়,দোষের সংস্কার ও সংশোধন । সেখানে সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারের কথায় দণ্ডিতের সঙ্গে দণ্ডদাতার সম্পর্ক নিয়ে যেভাবে বিচারের শ্রেষ্ঠত্ব উঠে আসে,তা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা জরুরি । বিচার দোষীর প্রতিশোধের ব্যবস্থা করে না, দোষের প্রতিরোধ থেকে প্রতিবাদই তার লক্ষ্য। সে লক্ষ্যে বিচারের নিরপেক্ষতা একান্ত জরুরি । তার সঙ্গে বিচারককে নিরপেক্ষতার কৃত্রিম ছদ্মবেশে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি যথোচিত নয়। তাঁর সদর্থক সক্রিয়তাই বিচারকে গতি দান করে, সুবিচারের পথকে মসৃণ করে তোলে। বিচারকও যে সমাজের কল্যাণকামী মানবাত্মার দোসর হতে পারে,তা আমরা আজও ভেবে উঠতে পারি না, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য ।

অন্যদিকে বিচারপতিকে নিছক ‘জনগণের সেবক’ও বলা যায় না। যেখানে রক্ষা বা ত্রাণের ভূমিকাই প্রাধান্য লাভ করে, সেখানে সেবা আপনাতেই ত্রাতা হয়ে ওঠে । সেবকের দাসত্বের মানসিকতার চেয়ে সেক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বীরত্বের সৎসাহস একান্ত কাম্য। সেদিক থেকে বিচারপতি শাসক নন, প্রশাসক নন, অনুশাসকও নন, একান্তভাবেই দেশের সংবিধানের রক্ষক, মানুষের পরমনির্ভর ন্যায়ধর্মের ত্রাতা। এজন্য শাসক-প্রশাসক থেকে রাষ্ট্রনেতার শ্রীবৃদ্ধি যত পেয়েছে, ততই বিচার ব্যবস্থার প্রতি আমজনতার আস্থা বেড়েছে । আবার জনমানসে বিচার ব্যবস্থায় আস্থা যত বেড়েছে, বিচারের প্রতি সরকার বা দলের আশঙ্কা তত সক্রিয় হয়েছে। সেক্ষেত্রে বিচারকের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাবে শাসকদলের পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। বরং তাতে জনমানসে বিচারকের প্রভাব একটুও কমে না, প্রতিদ্বন্দ্বিতার আলোয় তা বর্ণরঙিন হয়ে ওঠে । কেননা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রশ্ন'(পৌষ, ১৩৩৮) কবিতায় যুগে যুগে ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’র বিপরীতে বিচারকের ভূমিকাই যে আমজনতার চরম আশ্রয়, পরম নির্ভরতা !