নিজস্ব প্রতিনিধি– গত বিধানসভার ভোটের পর এবার লোকসভা নির্বাচনেও বাংলায় পর্যুদস্ত বিজেপি৷ কিছুটা মুখরক্ষা করেছে শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গ৷ গতবার একচেটিয়া আধিপত্য ছিল বিজেপির৷ ৮ আসনের মধ্যে ৭ এসেছিল তাদের দখলে৷ এবার গেরুয়া ঝডে়র ছবিটা অনেকটাই ফিকে৷ মোদি-শাহদের দখলে থাকা সাতটির মধ্যে ৬ টিতে জয় এসেছে৷ তবে কমেছে মার্জিন৷ একটিতে ফুটেছে ঘাসফুল৷ কোচবিহারে হেরেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামানিক৷ আলিপুরদুয়ারে জিতেছেন বিজেপি প্রার্থী মনোজ টিগ্গা৷ জলপাইগুডি়তে জিতেছেন বিজেপি প্রার্থী জয়ন্ত রায়৷ এক লক্ষের কিছু বেশি ভোটে জিতেছেন দার্জিলিংয়ের রাজু বিস্ত৷ জিতেছেন রায়গঞ্জের বিজেপি প্রার্থী কার্তিক পালও৷ উত্তর মালদহ ধরে রেখেছেন খগেন মুর্মুও৷ জিতেছেন বালুরঘাটের বিজেপি প্রার্থী সুকান্ত মজুমদারও৷ তবে তৃণমূলের জগদীশ বর্মা বসুনিয়া হারিয়েছেন বিজেপির নিশীথকে৷ শুধু কোচবিহার দখল নয়, ভোটও বাডি়য়েছে তৃণমূল৷ কোন ম্যাজিকে বিপর্যয়ের মাঝেও ৫ আসন ধরে রাখল গেরুয়া শিবির? কোন অঙ্কেই বা নিশীথ প্রামানিকের মতো হেভিওয়েটকে গোল দিল তৃণমূল? কোচবিহারে বড় ফ্যাক্টর রাজবংশী ভোট৷ সেই কথা মাথায় রেখে রাজবংশী সমাজের প্রতিনিধি অনন্ত মহারাজকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছিল বিজেপি৷ কিন্ত্ত সেই দলের প্রতিই রুষ্ট ছিলেন তিনি৷ প্রার্থী নিশীথকেও তাঁর পছন্দ ছিল না৷ প্রকাশ্যেই সে কথা জানিয়েছিলেন৷ মনে করা হচ্ছে, তিনি ও তাঁর অনুগামীদের ভোট গিয়েছে তৃণমূলের ঝুলিতেই৷ উপরন্ত্ত দলের পুরনো কর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন৷ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে দূরত্ব বেডে়ছিল দলীয় কর্মীদের৷ তারই প্রতিফলন পডে়ছে ভোটবাক্সে৷ অনেক চেষ্টা করেও বিজেপিকে আলিপুরদুয়ার থেকে সরাতে পারল না তৃণমূল৷ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জন বার্লাকে এবার এই কেন্দ্রে টিকিট দেয়নি বিজেপি৷ আর সেই কারণেই এই কেন্দ্রে এবার জিততে জিততেও তৃণমূল শেষ হাসি হাসতে পারল না বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল৷ উল্লেখযোগ্যভাবে, নাগরাকাটা বিধানসভা যেখানে জন বার্লার বাডি় সেই বিধানসভাতে বিজেপিকে পেছনে ফেলেছে তৃণমূল৷ জন বার্লার কারণেই ওই বিধানসভায় তৃণমূল বিজেপির থেকে বেশি ভোট পেয়েছে বলেও দাবি অনেকের৷ বাকি সব বিধানসভাতে লিড রেখেছ বিজেপি৷ তৃণমূলের চা সুন্দরী প্রকল্প, সংগঠন কোনও কিছুই কাজ করেনি চাবলয়ে৷ অভিযোগ, জমির পাট্টা নিয়ে নাখুশ ছিলেন চা বলয়ের শ্রমিকরা৷ এই সমীকরণেই জলপাইগুডি়তে মাত দিয়েছে বিজেপি৷ এবার পাহাডে় বিজেপির পথের কাটা ছিল অনেক৷ তাদের মধ্যে অন্যতম কার্শিয়াংয়ের বিদ্রোহী বিধায়ক বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা অন্যতম৷ তিনিই নির্বাচনের নির্ঘন্ট ঘোষণার আগে থেকে রাজু বিস্তার বিরোধিতা করে ভূমিপুত্র প্রার্থীর দাবিতে সরব ছিলেন এবং দলের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেন৷ পাহাডে়র রাজনৈতিক নেতৃত্বের একাংশের দাবি, গুরুং দিল্লিতে দরবার করে চেয়েছিলেন তাই প্রার্থী পরিবর্তনের পরম্পরা ভেঙে, দলের আভ্যন্তরীণ ক্ষোভ উপেক্ষা করে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব রাজু বিস্তাকে টিকিট দেন৷ কেন ঘরে-বাইরে বিরোধিতা দেখেও গুরুং রাজু বিস্তাতেই ভরসা রেখেছেন? পাহাডে়র বিভিন্ন মহলে যে কথাটি বেশ চালু রয়েছে সেটা হলো রাজু বিস্ত মানেই বিমল গুরুং৷ যে কারণে রাজু বিস্তও প্রকাশ্যে গুরুংকে রাজনৈতিক গুরু দাবি করেছেন৷ ঘনিষ্ঠতার সুবাদে গুরুং চালকের আসনে রাজুকে চেয়েছেন৷ যে বিরোধিতা ছিল তিনি জানতেন জাতিসত্তা ও গোর্খাল্যান্ডের আবেগের সামনে কিছুই টিকবে না৷ অজয় এডওয়ার্ডের সমর্থন থাকলেও কংগ্রেস-বাম প্রার্থী মুনীশ তামাং মোটেও ফ্যাক্টর হবেন না৷ তবে ভোটের ব্যবধান যে ২০১৯ সালের মতো থাকবে না, কমবে সেটা টের পেয়ে চাণক্যের স্টাইলে গুরুং আগাম জানিয়ে রেখেছিলেন৷ সেটাই হয়েছে৷ ত্রিমুখী লড়াই দেখেছে রায়গঞ্জ৷ তৃণমূলের কৃষ্ণ কল্যাণীকে দলেরই অনেকে মেনে নিতে পারেনি৷ বিশেষ করে তাঁর ‘দলবদলু’ ভাবমূর্তিও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দিয়েছে৷ কানাইয়ালাল আগরওয়ালকে প্রার্থী না করায় দলেরই একাংশ নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছে৷ বিধায়ক আবদুল করিম চৌধুরীও খুশি ছিলেন না৷ এরফলে তৃণমূলের লড়াইটা বেশ কঠিন হতে চলেছে৷ অন্যদিকে বিজেপির সংগঠনের অবস্থা ভালো নয়৷ এবার নির্বাচনে ফ্যাক্টর হল হিন্দু-মুসলিম ভোট কাটাকাটি৷ রামমন্দিরের জিগির তুলে হিন্দু ভোট পকেটে পুরে নিল গেরুয়া শিবির৷ রেল উন্নয়নে বাজি রেখে বালুরঘাট জিততে মরিয়া সুকান্ত মজুমদার৷ পালটা রাজ্যের একের পর এক জনকল্যাণমূলক প্রকল্প হাতিয়ার করে তাঁকে ‘কাঁটে কা টক্কর’ দিচ্ছেন তৃণমূলের বিপ্লব মিত্র৷৷ একইভাবে মালদহ উত্তরও পকেটে পুরেছে বিজেপি৷ সবমিলিয়ে বাংলার খারাপ সময়েও উত্তর ‘আচ্ছে দিন’ এনেছে বিজেপির জন্য৷