নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: চলতি সপ্তাহে আদালতে কেন্দ্রীয় আর্থিক তদন্তকারী সংস্থা ইডি দাবি করেছে, -‘এসএসসিতে প্যানেলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ১৮৩ জন অযোগ্য প্রার্থীকে চাকরি দেওয়া হয়েছিল’।
কীভাবে অযোগ্য প্রার্থীদের নাম স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)-এর প্যানেলের জন্য সুপারিশ করা হত? কী ভাবে দেওয়া হত নিয়োগপত্র? তা আদালতে নথি দিয়ে তা জানাল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। বেআইনি নিয়োগের ক্ষেত্রে এক দফতর থেকে অন্য দফতরে কী ভাবে ইমেল চালাচালির মাধ্যমে সমন্বয় সাধন করা হত, তা-ও জানতে পেরেছে বলে ইডির দাবি। আদালতে ইডি দাবি করেছে, এসএসসিতে প্যানেলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ১৮৩ জন অযোগ্য প্রার্থীকে চাকরি দেওয়া হয়েছিল। সেই নিয়োগের জন্য তৈরি করা হয়েছিল ভুয়ো সুপারিশপত্র। এর পর সেই সুপারিশপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল মধ্য শিক্ষা পর্ষদ (ডব্লিউবিবিএসই)-এর কাছে। সেই দফতরের কয়েক জন কর্মীর মাধ্যমে অযোগ্য প্রার্থীদের ভুয়ো নিয়োগপত্র প্রকাশিত হত। এমনটাই দাবি করেছে ইডি। তাদের আরও দাবি, এই ভুয়ো সুপারিশপত্র তৈরির কাজটি করেছিলেন এসএসসির অস্থায়ী কর্মী সমরজিৎ আচার্য। আর তিনি এ সব করেছেন এসএসসির উপদেষ্টা কমিটির প্রাক্তন প্রধান শান্তিপ্রসাদ সিন্হার নির্দেশে।ইডির চার্জশিটে নাম রয়েছে সমরজিতের।
ইডি নিজেদের নথিতে দাবি করেছে, ১৮৩ জন অযোগ্য প্রার্থীর ভুয়ো সুপারিশপত্র ‘প্রিন্ট’ করিয়েছিলেন তিনি। প্যানেলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর করিয়েছিলেন এই কাজ। সবটাই করেছিলেন শান্তিপ্রসাদের নির্দেশে। সেই সুপারিশপত্রের ‘সফ্ট কপি’ পাঠিয়েছিলেন পর্ষদের দফতরে, যারা নিয়োগপত্র দেয়। এর পর ওই দফতর ভুয়ো নিয়োগপত্র দিয়েছিল অযোগ্য ১৮৩ জনকে।ইডির দাবি, এই সুপারিশগুলো এসেছিল মূলত ‘মিডলম্যান’ প্রসন্নকুমার রায়ের থেকে। তাঁর হয়ে আবার কাজ করতেন প্রদীপ সিংহ ওরফে ছোটু। ইডি দাবি করেছে, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এজেন্টদের সঙ্গে যোগ ছিল প্রসন্নের। ওই এজেন্টদের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে অযোগ্য প্রার্থীদের বিষয়ে তথ্য জোগাড় করতেন প্রসন্ন। তার পর বেআইনি ভাবে তাঁদের চাকরির সুপারিশ করতেন শান্তিপ্রসাদের কাছে। নিজের কর্মী প্রদীপের মাধ্যমে এই অযোগ্য প্রার্থীদের বিষয়ে প্রসন্ন তথ্য জোগাড় করতেন। প্রসন্নের নির্দেশে প্রদীপ বিভিন্ন এজেন্টের কাছ থেকে অযোগ্য প্রার্থীর নাম জোগাড় করতেন।
তাঁদের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য টাকাও তুলতেন। সেই অযোগ্য প্রার্থীদের সুপারিশপত্র কখনও সরাসরি, কখনও সমরজিতের মাধ্যমে শান্তিপ্রসাদকে দিতেন প্রসন্ন।সমরজিৎকে অযোগ্য প্রার্থীদের নাম সুপারিশ করে যে ইমেল করেছিলেন ছোটু, তা হাতে এসেছে ইডির। ইডি জানিয়েছে, একটি মেল ২০২০ সালের ১৬ জুন সমরজিৎকে করেছিলেন প্রদীপ। মেলের সঙ্গে ‘একাদশ-দ্বাদশ অ্যালটেড স্কুল-২১’ নামাঙ্কিত একটি ‘অ্যাটাচমেন্ট’ পাঠানো হয়েছে। তাতে ২১ জন প্রার্থীর নাম পাঠানো হয়েছে। সেটি ‘প্রিন্ট’ করিয়েছেন সমরজিৎ। আর একটি অ্যাটাচমেন্ট ‘একাদশ-দ্বাদশ পিপি’-তে রয়েছে স্কুল–সহ বিস্তারিত তথ্য। এ রকম ভাবেই কখনও ২১ জন, কখনও দু’জন প্রার্থীর নাম সুপারিশ করে সমরজিৎকে ইমেল করা হয়েছে বলে দাবি ইডির।
নিয়োগকাণ্ডে শান্তিপ্রসাদ এ বার গ্রেফতার ইডির হাতে! কেন তাঁকে হেফাজতে চাই? কী যুক্তি কেন্দ্রীয় সংস্থার?ইডির আরও দাবি, সমরজিৎ এই সুপারিশপত্রের প্রিন্ট করিয়ে পাঠিয়ে দিতেন পর্ষদের দফতরে। সেখানে রাজেশ লায়েক নামে এক কর্মী নিয়োগপত্র প্রিন্ট করাতেন। সেই কাজটা করতেন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে। নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির জন্য নিয়োগপত্র প্রিন্ট করাতেন রাজেশ। ইডি দাবি করেছে, ছোটু শুধু অযোগ্য প্রার্থীদের সুপারিশ দিতেন না, কারা কোন স্কুলে নিয়োগ পাবেন, তা-ও জানিয়ে দিতেন। ইডির দাবি, স্কুলে জায়গা থাকুক বা না থাকুক, ছোটু শূন্যপদ তৈরি করতেন যে কোনও স্কুলে। তিনি যে ইমেল পাঠাতেন, তা থেকে তেমনটাই মনে করছে ইডি। সরকারি নথি অনুযায়ী শূন্যপদ রয়েছে কি না, তা দেখতেন না।
নিজে স্কুলের নাম সুপারিশ করে পাঠিয়ে দিতেন। আর এটা করতেন শান্তিপ্রসাদের সাহায্যে। মেল করে সে সব প্রার্থীর তথ্য তিনি সমরজিৎকে পাঠাতেন। ইডির দাবি, অনেক ক্ষেত্রে সমরজিৎ মেল করে ছোটুকে জানিয়ে দিতেন, কোন ‘ফরম্যাটে’ অযোগ্য প্রার্থীর বিষয়ে সমস্ত তথ্য পাঠাতে হবে। সেই মতো ছোটু পাঠিয়ে দিতেন তথ্য। ইডির দাবি, আবার অনেক ক্ষেএে কোন স্কুলে কোন চিঠি পাঠাতে হবে, সেই তথ্যও ইমেল করতেন ছোটু। পরবর্তী কালে ওই প্রার্থীদের নিয়োগপত্র প্রকাশের আগে সমরজিৎকে আবার একই ভাবে ‘ফরম্যাট’ পাঠিয়ে দিতেন অন্য এক জন। তিনি জানিয়ে দিতেন, সমরজিৎ কী ভাবে অযোগ্যদের সুপারিশপত্র তাঁর কাছে পাঠাবেন। সেই মতো প্রকাশিত হবে নিয়োগপত্র।ইডি দাবি করেছে, সমরজিৎ অযোগ্য প্রার্থীদের সুপারিশপত্র প্রিন্ট করিয়ে পাঠিয়ে দিতেন শান্তিপ্রসাদকে। এর পর শান্তিপ্রসাদের নির্দেশে সেগুলি পাঠিয়ে দিতেন পর্ষদের দফতরে। সেখানে কল্যাণময়ের নির্দেশে অনেক সময়ই টেকনিক্যাল অফিসার রাজেশ প্রিন্ট করাতেন অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগপত্র। ২০২০ সালে লকডাউনের সময়ও এই ইমেল চালাচালি হয়েছে বলে আদালতে দাবি করেছে ইডি।