নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: তখন সবে সকাল সাতটা৷ মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে মিঠে রোদ৷ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা ধীরে ধীরে তখন ভিড় জমাতে শুরু করেছেন শিয়ালদহ স্টেশনে৷ স্টেশন চত্বরের বাইরে মাইকে অনবরত বেজে চলছে ‘সাবধানবাণী’৷ একই সঙ্গে সমর্থকদের জন্য যে গাড়ির ব্যবস্থাও করে রেখেছে দল, তাও বলে দেওয়া হচ্ছে৷ শিয়ালদহ স্টেশন চত্বর ছেড়ে বেরতেই দেখা গেল মানুষের ঢল৷ গুটি গুটি পায়ে দলীয় পতাকা হাতে একুশে জুলাইয়ের মঞ্চের উদ্দেশে তখন অগণিত পা৷ রাস্তার ধারে বাস দাঁড় করিয়ে চলছে মধ্যাহ্ন ভোজনের প্রস্ত্ততিও৷ এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ ছাড়িয়ে ছোট-বড় মিছিল তখন সমাবেশমুখী৷ আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস রোডকে পিছনে ফেলে মিছিল তখন ডান দিকে বাঁক নিয়েছে লেনিন সরণি ধরে৷ কেউ মাথায় পরেছেন ‘ঘাসফুল’ টুপি, আবার কারও গায়ে জড়ানো দলের পতাকা৷ সকলের মুখে মুখে অহরহ একটাই স্লোগান, ‘জয় বাংলা’৷
লেনিন সরণি, এসএন ব্যানার্জী রোড ছাড়িয়ে মিছিল তখন প্রবেশ করেছে মূল মঞ্চের সামনে৷ ঠিক যেমন পাহাড়, পর্বত পেরিয়ে নদী গিয়ে মেশে সমুদ্রে৷ একুশের ধর্মতলা ঠিক তেমনই এক মোহনা৷ প্রত্যন্ত গ্রাম, শহর থেকে তিলোত্তমাতে উঠে এল এক টুকরো রাজ্য৷ তখন মঞ্চে চলছে সংগীত পরিবেশন৷ একে একে গান করছেন শিল্পীরা৷ তারই মধ্যে শুধু মাত্র একটিবার ‘দিদি’কে দেখার বাসনা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বছর পঁচাশির প্রৌঢ় মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার বাসিন্দা আনারুল শেখ৷ কাছ থেকে না হোক, দূর থেকে শুধু একবার দলনেত্রীর উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেই শান্তি৷ তবে থিক থিকে ভিড়ে মঞ্চের সামনে কীভাবে পেঁৗছবেন জিজ্ঞেস করতেই অস্ফুট কন্ঠে বললেন, ‘‘এতদূর যখন দিদির টানে আসতে পেরেছি, তখন সেটাও পারব’’৷
অন্যদিকে, দেখা হয়ে গেল পুরুলিয়ার আদিবাসী অধু্যষিত গ্রাম বলরামপুর থেকে আসা বছর বারোর অনীশ টুডু, নেপাল মাহাতোদের সঙ্গে৷ বাবা-কাকাদের সঙ্গে প্রথম কলকাতায় আসা তাদের৷ শনিবার সকালেই তারা জনা বিশেক মিলে হাজির হয়েছে শহরে৷ দেখেছে হাওড়া ব্রিজ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল৷ নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে রাত কাটিয়ে হাজির হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে সামনে থেকে দেখার জন্য৷
ঘড়ির কাটায় তখন সকাল দশটা পেরিয়ে গিয়েছে৷ এদিকে ঘোর কালো করে এসেছে আকাশ৷ দেখতে দেখতেই নামল বৃষ্টি৷ কিন্ত্ত তাতে কী! কুছ পরোয়া নেহি৷ সমাবেশে এসেছি যখন ‘দিদি’-কে না দেখে ফিরব না৷ বৃষ্টিতে ভিজে রুমালে করে মাথা মুছতে মুছতেই বললেন, দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরের বাসিন্দা অমিত হাজরা৷ দেখতে দেখতে সময় তখন আরও খানিকটা গড়িয়েছে৷ দু’পশলা বৃষ্টিও হয়ে গিয়েছে৷ তারই মাঝে কেউ আসলেন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে৷ কেউ আবার আসলেন দুটো পয়সা রোজগারের আশা নিয়ে৷ রাস্তার ধারেই সাজিয়ে বসলেন ‘খেলা হবে’ লেখা ফুটবল, তো অন্য কেউ প্লাস্টিকের ঝুলি থেকে বের করে সাজিয়ে রাখলেন তৃণমূলের টুপির পসরা৷
তাছাড়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঁধানো ফটো তো ছিলই৷ সমাবেশে বরাহনগর থেকে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন৷ টিএমসি লেখা প্ল্যাকার্ডেই মন্দির, মসজিদ আর গির্জার কাঠামো তুলে ধরে সর্বধর্ম সমন্বয়ের বার্তা দিলেন তাঁরা৷ তাঁদের মধ্যে থেকেই শোভন রায় নামে এক যুবক বললেন, ‘‘বিজেপি ধর্ম বিদ্বেষী৷ ওরা মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ তৈরি করতে চাই৷ কিন্ত্ত আমাদের দিদি তা কোনওভাবেই হতে দেবেন না৷’’ বেলা এগারোটার কিছু পরে আবারও মেঘভাঙা বৃষ্টি৷ তবে বৃষ্টি রোদের খেলা উপেক্ষা করেই ভেসে আসছিল ব্যান্ডপার্টির আওয়াজ৷ বাঁকুড়ার রায়পুর থেকে এসেছিল জনা তিরিশের ওই দলটি৷ তাঁদের মধ্যে থেকেই অনিন্দ্য গড়াই বলে এক যুবক৷ তিনি বললেন, ‘‘একুশের লোকসভায় জিতেছি৷ ছাব্বিশের বিধানসভাতে বিজেপিকে আবারও নাস্তানাবুদ করব৷’’
এদিকে ততক্ষণে মঞ্চে এসে উপস্থিত হয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ একুশের মঞ্চে থাকবেন কিনা,এই জল্পনা উড়িয়ে অভিষেকের কন্ঠ শুনে তখন আপ্লুত তরুণ তৃণমূলিরা৷ সমাবেশে উপস্থিত হয়েছিলেন শহর কলকাতার ৫৯ নম্বর ওয়ার্ড, ৭ নম্বর রায়চরণ লেনের তৃণমূল কর্মীরা৷ একদিকে বড় দলীয় প্রতীক আর একদিকে লক্ষ্মীর ভান্ডারের কাঠামো৷ তবে চোখ গেল একটি ব্যানারে৷ যেখানে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী দশভুজা৷ তার এক হাতে রয়েছে খাদ্যসাথী, অন্য হাতে রয়েছে রূপশ্রী৷ এই রকম করে দশ হাতে জায়গা করে নিয়েছে রাজ্য সরকারের দশটি জনমুখী প্রকল্প৷ তাদের মধ্যে থেকেই একজন বললেন, ‘‘দিদি আমাদের দশভুজা৷ যেমন করে আমাদের একাধিক সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন, ঠিক তেমন করেই বধ করবেন দিল্লির অসুরের।’’
ইতিমধ্যেই মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতি ঘোষণা করা হল৷ বেলা দেড়টা নাগাদ মঞ্চে উঠলেন তিনি৷ মঞ্চে উঠে সকলের উদ্দেশ্যে হাত নাড়তেই সমাবেশ তখন ফেটে পড়ল ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে৷ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন কর্মী-সমর্থকেরা৷ অনেকে বললেন, দুর্যোগ মাথায় নিয়ে এত কষ্ট সার্থক হল৷ দুপুর দুটো কুড়ি৷ সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে সভা শেষ করলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ ভাঙল জমায়েত, ভাঙল চব্বিশের একুশে সমাবেশ৷