নিজস্ব প্রতিনিধি— দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক অতিসাধারণ লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবার৷ কোনো উল্লেখযোগ্য ইতিহাস, সংগ্রাম না থাকা সত্ত্বেও আজ এই কেন্দ্র বহু চর্চিত৷ কিন্ত্ত কেন? এই কেন্দ্রের বিদায়ী সাংসদ তথা তৃতীয়বারের তৃণমূল প্রার্থী অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের মস্তিস্কপ্রসূত ‘ডায়মন্ড হারবার মডেল’ এর জন্য৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী হয়ে নিজ জন্মভূমি কলকাতা ছেড়ে ডায়মন্ড হারবারে প্রথম পদার্পন করেছিলেন অভিষেক৷ তাঁর ভাষায়, “সেসময় ডায়মন্ড হারবারের বিস্তীর্ণ এলাকার কিছুই চিনতাম না৷ কিভাবে নির্বাচনী প্রচার চালাবো তাও ঠিকঠাক জানতাম না৷ ডায়মন্ড হারবারের করুন পরিস্থিতির জন্য মানুষ ভোট বয়কট করেছিলেন৷ শুধু বলেছিলাম, আমার ওপর একবার ভরসা করে দেখুন৷ তারপর মানুষ আমায় ফেরায়নি৷ ” বছর ২৬ এর অভিষেক প্রথমবার লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়েই বাজিমাত করেছিলেন, সালটা তখন ২০১৪৷ তবে সেসময় ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র ৭১ হাজার৷ তখনই শপথ নেন অভিষেক, জয় এবং উন্নয়ন উভয়ের নিরিখেই রাজ্য তথা দেশের সেরা লোকসভা কেন্দ্র বানাবেন এই ডায়মন্ড হারবারকেই৷ এরপর আসে ২০১৯ এর নির্বাচন৷ ততদিনে ডায়মন্ড হারবারের চিত্রটা সম্পূর্ণ বদলে যায়, এই কেন্দ্র জুড়ে ছুটতে শুরু করে ‘উন্নয়নের অশ্বমেধের ঘোড়া’৷
২০১৯ এ ডায়মন্ড হারবার লোকসভার অন্তর্গত সকল বিধানসভা – ফলতা, সাতগাছিয়া, বিষ্ণুপুর, মহেশতলা, বজবজ, মেটিয়াবুরুজ এবং ডায়মন্ড হারবার থেকে ভোট ব্যবধান বাডে় তৃণমূলের৷ এক লাফে ৩ লাখ ২০ হাজার ভোট ব্যবধানে জেতেন অভিষেক৷ তখনও তিনি শুধুই সাংসদ, যুবর দায়িত্ব থাকলেও মূল দলে কোনও পদ ছিল না তাঁর৷ ২০২১ সালের নীলবাডি়র লড়াই থেকেই দলের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন অভিষেক৷ বড় সাফল্য পায় দল৷ অভিষেকও দায়িত্ব পান সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের৷ ততদিনে অভিষেকের মাথায় বসে যায় দলের সেনাপতির মুকুট৷ ক্যামাক স্ট্রিটে তাঁর অফিস এখন তৃণমূলের অন্যতম ‘ভরকেন্দ্র’৷ গোটা রাজ্য জানে, তৃণমূল তো বটেই এমনকি রাজ্য রাজনীতিতেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি একমাত্র তিনিই৷ বছর ঘুরে এসেছে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচন৷ এবারে অভিষেকের টার্গেট ৪ লক্ষ ভোট ব্যবধানে ডায়মন্ড হারবার জয়৷ ‘খ্যাতি’ থাকলেও রাজ্য রাজনীতিতে হাইভোল্টেজ নয় এই কেন্দ্র৷ কারণ এখানে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ই জিতবেন, দাবি রাজনৈতিক মহলের৷ আর তাঁর জয়কে ইন্ধন জোগাবে ‘ডায়মন্ড হারবার মডেল’৷
এবার এই কেন্দ্রের ইতিহাস দেখা যাক৷ দক্ষিণ ২৪ পরগনার মূলত গ্রামনির্ভর এই আসনে তৃণমূলের দখলে আসে ২০০৯ সালে৷ জিতেছিলেন প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র৷ সেসময় তাঁর পাশে ছিলেন এখন রাজনীতি থেকে দূরে থাকা কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়৷ সিপিএমের শমীক লাহিডি়কে দেড় লাখ ভোটে হারিয়েছিলেন তৃণমূলের সোমেন৷ তার আগে কয়েক বার কংগ্রেস জিতলেও মূলত সিপিএমের হাতেই ছিল ডায়মন্ড হারবার৷ জ্যোতির্ময় বসু, অমল দত্ত টানা চার বার করে জিতেছেন এই কেন্দ্রে৷ দুর্ভ্যেদ্য সেই বাম দুর্গে শমীকও চার বার জিতে পঞ্চম বারে হারেন সোমেনের কাছে৷ সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের অস্বস্তি কাটাতে শমীক উদ্যোগী হয়ে ডায়মন্ড হারবারে নিয়ে এসেছিলেন ‘বিশ্ব ফুটবলের রাজপুত্র’ দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনাকে৷ ফুটবল অ্যাকাডেমি এবং স্টেডিয়াম গড়ার অঙ্গীকার করে মারাদোনার পায়ের ছাপ নেওয়া হয়েছিল৷ ফুটবল অ্যাকাডেমি কিংবা স্টেডিয়াম তো হয়নি, ফুটবলের ঈশ্বরের সেই পদচিহ্ন যে কালের নিয়মে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে, তাও বর্তমানে ডায়মন্ড হারবারবাসীর কাছে অজানা৷ এভাবেই ডায়মন্ড হারবারের মানুষ বারংবার দেখেছেন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হতে৷
তৃণমূল যুবরাজ অভিষেক সেসব ভুলিয়ে দিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছেন ডায়মন্ড হারবারবাসীকে৷ কেন্দ্রের প্রতি ভালবাসা থেকেই সাংসদ অভিষেক ‘ডায়মন্ড হারবার ফুটবল ক্লাব’ শুরু করেছেন৷ ডায়মন্ড হারবারবাসীর জন্য পৃথক ‘হেল্পলাইন’ খুলে রেখেছেন সারা বছর৷ শীতের মরসুমে নিয়ম করে দেশের নামজাদা সঙ্গীতশিল্পীদের জাঁকজমক পূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়৷ কখনও সোনু নিগম, কখনও মিকা, কখনও আবার হিমেশ রেশমিয়া এসে অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই গ্রামীণ লোকসভা কেন্দ্রে৷ এ ছাড়াও পালা করে প্রতি বছর সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে ‘এমপি কাপ’ -এর আয়োজন সাংসদ হিসাবে অভিষেকের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিই করেছে৷ কোভিডের সময়ে ‘কমিউনিটি কিচেন’ করে ডায়মন্ড হারবারবাসীর জন্য পৃথক চিকিৎসার বন্দোবস্ত থেকে সেখানকার গরিব জনতার মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন অভিষেক৷ ‘শ্রদ্ধার্ঘ্য ভাতা’ চালু করে দেশবাসীর নজর কেড়েছেন৷ সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল থেকে মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তা থেকে পানীয় জল পরিষেবা কোনো কিছুই বাদ রাখেননি নিজ উন্নয়নকার্যের তালিকায়৷ এভাবেই রাজ্য রাজনীতিতে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে তাঁর ‘ডায়মন্ড হারবার মডেল’৷ উন্নয়নের নিরিখে বর্তমানে রাজ্যের মধ্যে অভিষেক-গড় প্রথম স্থানাধিকারী৷ অভিষেকের ভাষায়, “উন্নয়নের নিরিখে রাজ্যে এক নম্বর হতে পারলে, জয়ের নিরিখেও এক নম্বর হবো৷”