• facebook
  • twitter
Sunday, 8 September, 2024

মরিয়া বাবার রোজ ফোন ২০০০ জনকে

মমতার উন্নয়ন ফেরি করে টক্কর দিতে তৈরি তৃণমূলও দেবাশিস দাস: প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া কাঁথিতে, নাকি অন্য স্রোত, আপাতত এই নিয়ে মশগুল এই লোকসভা কেন্দ্রের ভোটাররা৷ প্রতিষ্ঠান বিরোধী বলতে এক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধাচারণ নয়৷ এখানে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কথার অর্থ হল তিল তিল করে অধিকারী পরিবার তাঁদের যে আধিপত্য তৈরি করেছেন, তার বিপরীতে মানুষজন

মমতার উন্নয়ন ফেরি করে টক্কর দিতে তৈরি তৃণমূলও

দেবাশিস দাস: প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া কাঁথিতে, নাকি অন্য স্রোত, আপাতত এই নিয়ে মশগুল এই লোকসভা কেন্দ্রের ভোটাররা৷ প্রতিষ্ঠান বিরোধী বলতে এক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধাচারণ নয়৷ এখানে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কথার অর্থ হল তিল তিল করে অধিকারী পরিবার তাঁদের যে আধিপত্য তৈরি করেছেন, তার বিপরীতে মানুষজন রায় দেয় কিনা, সেটাই এখানকার মূল বিচার্য বিষয়৷ বেশ কয়েক দশক পর শারীরিক কারণে ভোটের আঙিনা থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন এই লোকসভার প্রাক্তন সাংসদ শিশির অধিকারী৷ মাঠে ময়দানে নেমে রাজনীতি করা থেকে কিছুটা নিজেকে দূরে রাখলেও ছেলে সৌমেন্দু অধিকারীকে জেতানোর জন্য ৮৭ বছরের এই প্রবীণ মানুষটির ফুরসত নেই৷ প্রার্থী তালিকায় সৌমেন্দু অধিকারীর নাম ঘোষণা হওয়ার আগে থেকেই এই লোকসভার অধীন সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের ঘনিষ্ঠজনদের তিনি ফোন করে যাচ্ছেন নিয়মিতভাবে৷ প্রায় প্রতিদিন গড়ে ২০০০ করে ফোন করছেন শিশিরবাবু৷ আর্জি একটাই, এবার আমি নই, সৌমেন্দু দাঁড়িয়েছে৷ আপনারা যেমন এতদিন আমাকে আশীর্বাদ করেছেন আমাদের পরিবারের উপর ভরসা রেখেছেন, তা থেকে যেন এবারও বঞ্চিত না হই৷’ এই ফোন শুধু বিজেপি মনোভাবাপন্ন মানুষজনের কাছে যাচ্ছে, এমনটা নয়, এই তালিকায় তৃণমূল এবং বাম মনোভাবাপন্ন সমর্থকও রয়েছেন৷
অন্যদিকে একটা সময় শুভেন্দুর ছত্রচ্ছায়ায় রাজনীতি করা পটাশপুরের বিধায়ক উত্তম বারিক এবার তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী৷

অনেকেই ভেবেছিলেন কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রে সৌমেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে তৃণমূলের ট্রাম্প কার্ড হতে পারেন মন্ত্রী অখিল গিরির পরিবারের কোনও সদস্য৷ কিন্ত্ত বাস্তবে তা হয়নি৷ পটাশপুরের এই বিধায়ক তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুনজরে রয়েছেন বেশ কয়েকবছর৷ তারই ফলশ্রুতি উত্তমের এই পদ প্রাপ্তি৷ অধিকারী পরিবারের প্রার্থীর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন তৃণমূলের উত্তম৷ দিঘার সৌন্দর্যায়ন থেকে শুরু করে জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, তাজপুর বন্দর, মৎস্যজীবীদের জন্য প্রকল্প সবকিছুই তুলে ধরছেন এই তৃণমূল প্রার্থী৷ ভোটযুদ্ধে এই দুই ভূমিপুত্রের পাশাপাশি রয়েছে কংগ্রেসের উর্বশী ভট্টাচার্য৷ তিনি কলকাতার বাসিন্দা৷ তাঁর মনোনয়নের দিন বাম ও কংগ্রেসের যৌথ মিছিল হয়েছে৷ তবে, প্রচারে সেভাবে সাড়া মিলছে না৷ তৃণমূলের উত্তম ভোট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিধায়ক হলেও সৌমেন্দু একেবারে কাঁথির পুরপ্রধান থেকে লোকসভার মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছেন৷ উত্তমের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শুভেচ্ছা রয়েছে৷ স্বাভাবিকভাবে অধিকারীগড়ে উত্তম কতটা নিজেকে মেলে ধরতে পারেন, এখন সেটাই দেখার৷ কাঁথি লোকসভার অধীন রয়েছে উত্তর কাঁথি, দক্ষিণ কাঁথি, রামনগর, পটাশপুর, ভগবানপুর, খেজুরি ও চণ্ডীপুর৷ ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের ফল অনুযায়ী চারটিতে এগিয়ে বিজেপি, তিনটিতে এগিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস৷ এই লোকসভায় ২৯,১৫৪ ভোটে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি৷ পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের পাল্লা ভারী ছিল৷ লোকসভা নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কী হয় সেটাই দেখার৷

অন্যদিকে, এর আগে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিকে হেলায় অনুকূলে এনে তৃণমূলে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী৷ সেই তিনি দল বদলে এখন বিজেপিতে৷ তৃণমূলে পর্যবেক্ষক পদ বিলুপ্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত একটা সময় তিনি প্রায় ৫০টি বিধানসভা কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন৷ মুর্শিদাবাদের মতো জেলায় তৃণমূলকে শক্তিশালী করার পিছনে তাঁর অবদান কোনও অংশে কম ছিল না৷ ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক-মুহূর্তে বিজেপিতে যোগদান করে তিনি এখন মোদি-অমিত শাহদের গুড বুকে স্থান করে নিয়েছেন৷ ১৯৫৬ ভোটে নন্দীগ্রামে মমতাকে হারানোর পর তাঁর গুরুত্ব অনেকাংশে বেড়ে যায় মোদি-অমিত শাহের কাছে৷ বিজেপি রাজ্য সভাপতি থাকাকালীন দিলীপ ঘোষের সময়ে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্য থেকে ১৮টি আসন পেয়ে চমকপ্রদ ফল করে বিজেপি৷ সেই দিলীপ ঘোষকে ব্যাকফুটে চলে যেতে হয় শুভেন্দুর ক্যারিশ্মার কাছে৷ স্বল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গ বিজেপির অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন বিধানসভার এই বিরোধী দলনেতা৷ বঙ্গবিজেপির অন্দরে কান পাতলে শোনা যায় এবারের লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী তালিকা তৈরি করার ক্ষেত্রে বিজেপির এই প্রভাবশালী নেতার মতামত সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে৷ স্বাভাবিকভাবে শুভেন্দু অধিকারীর কাছে এবারের লোকসভা নির্বাচন নিঃসন্দেহে অ্যাসিড টেস্ট৷ ষষ্ঠ দফা নির্বাচন হতে চলেছে এ রাজ্যের আটটি লোকসভা কেন্দ্রে৷ সেগুলি হল জঙ্গলমহলের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ছাড়া বিষ্ণুপুর, মেদিনীপুর, ঘাটাল, তমলুক এবং কাঁথিতে৷ এই লোকসভা কেন্দ্রগুলিতে বিজেপির যথেষ্ট আধিপত্য রয়েছে৷ শুভেন্দুকে ছাড়াই গত লোকসভা নির্বাচনে লড়াই করে বিজেপি এই আটটি আসনের তিনটিতে জয়লাভ করেছিল৷ এর মধ্যে কাঁথি ও তমলুকে তৃণমূলের টিকিটে জয়ী হয়েছিলেন শিশির ও সৌমেন্দু অধিকারী৷ এবার প্রেক্ষাপট আলাদা৷

স্বাভাবিকভাবে এই আটটি কেন্দ্রে জয়ী হওয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস৷ কাঁথি ও তমলুকে বিজেপিকে টক্কর দেওয়ার জন্য তৃণমূল চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেনি৷ এই একই অবস্থা দেখা গিয়েছে মেদিনীপুর এবং ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রেও৷ নির্বাচন ঘোষণার পর তৃণমূলের জুন মালিয়া অনেকটা এগিয়ে থাকলেও দিন যত সামনের দিকে এগিয়েছে, বিজেপি প্রার্থী অগ্নিমিত্রা পালের দিকে পাল্লাও ক্রমশ ভারী হচ্ছে৷ ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রে জনপ্রিয়তার নিরিখে তারকা প্রার্থী দেব এগিয়ে থাকলেও, এক্ষেত্রে শুভেন্দুর সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং বামেদের ভোট শেষ পর্যন্ত কোন দিকে যায়, তার উপর নির্ভর করছে বিজেপি প্রার্থী হিরণ চট্টোপাধ্যায়ের ভবিষ্যত৷ প্রার্থী তালিকায় তাঁর নাম ঘোষণা হওয়ার পর থেকে মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন হিরণ৷ ভোট যত এগিয়ে এসেছে, হরিণের মতো হিরণের ক্ষিপ্রতাও বেড়েছে৷ জনসংযোগ নিবিড় করতে তিনি কোনও খামতি রাখেননি৷ দেবও ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্র থেকে তৃতীয়বার সাংসদ হওয়ার জন্য বুথস্তর পর্যন্ত জনসংযোগে নেমেছেন৷

তবে, পুরুলিয়াতে কুর্মি প্রার্থী কতটা ভোট কাটতে পারে, তার উপর নির্ভর করছে জয়-পরাজয়৷ যদিও রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, বিজেপির ভোট গতবারের তুলনায় কমলেও, পদ্মের দাপট অব্যাহত থাকবে পুরুলিয়াতে৷ বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুর এই দুই লোকসভা আসনে বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে জোর টক্কর হওয়ার সম্ভাবনা৷ গতবারের তুলনায় ঝাড়গ্রাম আসনে ভালো ফল করার জন্য মুখিয়ে রয়েছে তৃণমূল৷ বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ কুনার হেমব্রমকে তৃণমূলে যোগদান করিয়ে বার্তা দিয়েছে শাসক দল৷ এই লোকসভা আসনেও কুর্মি ভোট বড়সড় ফ্যাক্টর হতে চলেছে৷ ঘরোয়া আলোচনায় শুভেন্দু অধিকারী বলেছিলেন, পাঁচটি লোকসভা আসন এবার বিজেপিকে উপহার দিতে চাই৷ বাস্তবে তা সম্ভব হবে কিনা, তা জানা যাবে ৪ জুন৷