শিক্ষার পর এবার প্রতিরক্ষা৷ মোদি সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ সম্পর্কে বিরোধী দলগুলি তো বটেই, বহু শিক্ষাবিদ আপত্তি জানিয়েছে৷ কারণ এর নেপথ্যে রয়েছে একাধিক বিপদের গন্ধ৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল— শিক্ষায় পুরোপুরি বেসরকারিকরণের রাস্তা খুলে যাবে, লোপ পাবে গণতান্ত্রিক চেতনা এবং জাঁকিয়ে বসবে কর্পোরেটতন্ত্র৷ একই সঙ্গে বিস্তৃত হবে অবিজ্ঞান ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবও৷ জাতীয় শিক্ষানীতি বস্ত্তত চেহারা নেবে দলীয় শিক্ষানীতির৷ নানা সমালোচনা ও নিরপেক্ষ শিক্ষাবিদদের একাধিক পরামর্শ অগ্রাহ্য করেই দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে মোদির শিক্ষানীতি৷ দেশ যখন এমন এক বিপদের মধ্য দিয়ে চলছে, তখন আরও একটি দুঃসংবাদ৷ সৈনিক স্কুলগুলিও সংঘের হাতে তুলে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার৷
আরএসএস ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের হাতে তুলে দেওয়া হল ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে সমাদৃত সৈনিক স্কুলগুলি৷ তালিকায় রয়েছে এমন ৪০টি স্কুলের নাম৷ ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি হস্তান্তর হয়ে গিয়েছে৷ সম্প্রতি যে নেতাকে বিজেপির একাংশ যোগী আদিত্যনাথের সমান্তরাল হিসেবে তুলে আনার চেষ্টায় ছিল, সেই বাবা বালকনাথ এমনই একটি স্কুলের মাথায় রয়েছে৷ সংঘ ও তাদের হিন্দুত্ববাদী কট্টরপন্থী সহযোগী সংগঠনগুলির হাতে এমন ১৪টি স্কুল চলে গিয়েছে৷ ১১টির মাথায় রয়েছেন কোনও না কোনও বিজেপি নেতা৷ এই বিস্ফোরক তথ্য উঠে এসেছে রিপোর্টাস কালেকটিভের আরটিআই তথ্য থেকে৷ এরপরই শুরু হয়েছে বিতর্ক৷ বিরোধীরা তো বটেই, প্রাক্তন সেনা আধিকারিকরাও সরাসরি প্রতিরক্ষায় গেরুয়াকরণের অভিযোগ তুলছেন৷ তাঁদের দাবি, শিক্ষার গৈরিকীকরণ তো হয়েই গিয়েছিল, এবার নিশানা সেনাবাহিনীও৷
২০১৩-১৪ সালের হিসাব অনুসারে, দেশের প্রতি পাঁচজন সেনা অফিসারে একজন কোনও না কোনও সৈনিক স্কুলের প্রাক্তনী৷ এই তথ্য থেকেই জাতীয় ক্ষেত্রে সৈনক স্কুলগুলির গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে যায়৷ শুধু শিক্ষাই নয়, তার পাশাপাশি দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত রাখার ব্যাপারেও এই প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকা অনবদ্য৷
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শিক্ষা ও প্রতিরক্ষা বিভাগের কাছে সব মানুষের বিরাট প্রত্যাশা৷ কিন্ত্ত উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের আদর্শে পরিচালিত বিজেপি সরকার যে সেই পথের পথিক নয়, তার নয়া নমুনা তারা পেশ করল সৈনিক স্কুল নিয়ে৷ রিপোর্টার্স কালেকটিভের আরটিআই তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, সৈনিক স্কুলগুলির দায়িত্ব তুলে দিচ্ছে মোদি সরকার আরএসএস ও তার সহযোগী বিশ্ব হিন্দু পরিষদের হাতে৷ ২০২২ সালের আগে পর্যন্ত কেন্দ্র ও রাজ্যগুলি যৌথভাবে ৩৩টি সৈনিক স্কুল চালাত৷ পরিচালনার মূল দায়িত্বে সেখানে ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনে স্বশাসিত সংস্থা সৈনিক স্কুল সোসাইটি (এসএসএস)৷ কিন্ত্ত ২০২১ সালের অক্টোবরে মোদি সরকার স্কুলগুলি পিপিপি মডেলে চালাবার সিদ্ধান্ত নেয়৷ তার জন্য আরএসএস-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন৷ ফলে স্কুলগুলি তারাই চালাবার অধিকারী হয়েছে৷ এই ফর্মুলায় ২০২২-২৩ সালের মধ্যে অন্তত ৪০টি স্কুলের পরিচালন ভার চলে যাবে আরএসএস-এর হাতে৷
বিশ্ব বিন্দু পরিষদের মহিলা শাখা দুর্গা বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ঋতাম্ভরার হাতে দু’টি স্কুল রয়েছে৷ এ দু’টি হল সম্বিদ গুরুকুলাম গার্লস ও রাজলক্ষ্মী সম্বিদ গুরুকুলাম৷ এদের সঙ্গে চুক্তি দু’টি বদলে গিয়েছে সৈনিক স্কুলে৷ এখানেই শেষ নয়৷ তালিকায় রয়েছে ১৯৩৭ সালে হিন্দুত্ববাদী নেতা বি এস মোনজের তৈরি করা ভোঁসলা মিলিটারি স্কুলও৷ বর্তমানে নাসিকের এই স্কুলটি চালায় সেন্ট্রাল হিন্দু মিলিটারি এডুকেশন সোসাইটি৷ মহারাষ্ট্রে অ্যান্টি-টেরর স্কোয়াডের অভিযোগ, ২০০৬ সালে নানদেদ বিস্ভোরণ ও ২০০৮ সালে মালেগাঁও বিস্ফোরণের অভিযুক্তরা এই স্কুলেই পেয়েছিল প্রশিক্ষণ৷
সৈনিক স্কুলগুলি আরএসএসের হাতে তুলে দেওয়ার অর্থ হল, আরও বেশি কট্টর হিন্দুত্ববাদী জঙ্গি ওইসব স্কুলে প্রশিক্ষিত হবে এবং দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে ধ্বংস করার দিকে এগিয়ে যাবে৷ এখনই এর প্রতিবাদ প্রয়োজন এবং বর্তমান ও ভাবী সেনাবহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে মোদি সরকারের ওপর৷